নির্ধারণের পরও দফায় দফায় বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম, নিত্যপণ্যের বাঁধা দর এক মাসেও কার্যকর হয়নি
এক মাস আগে (১৪ সেপ্টেম্বর) সরকার আলু, দেশি পেঁয়াজ ও ডিম—এই তিন পণ্যের দাম বেঁধে দিয়েছিল। বেঁধে দেওয়া এ দাম কার্যকরে শুরু থেকে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বাজারে অভিযান চালাচ্ছে। সরকারের নানামুখী তৎপরতার পরও এই এক মাসে আলুর দাম যেখানে ছিল, সেখানেই আছে। আর কমার বদলে উল্টো বেড়েছে ডিম ও পেঁয়াজের দাম। সরকার শুধু দেশি পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ করে দিলেও এ সময়ের মধ্যে দেশি পেঁয়াজের সঙ্গে আমদানি করা পেঁয়াজের দামও বেড়েছে। ফলে বেঁধে দেওয়া দামে এসব নিত্যপণ্য কেনার কোনো সুযোগ পাননি ভোক্তারা।
আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের বাইরে চিনি, সয়াবিন তেল ও তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) সিলিন্ডারের নির্ধারিত দর রয়েছে। এর মধ্যে শুধু সয়াবিন তেল নির্ধারিত দামে বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। চিনি ও এলপিজি সিলিন্ডার সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।
আলুর সরবরাহ কম থাকায় দাম কমেনি। এখনো অনেক হিমাগার আলু ছাড়ছে না। এ জন্য সরকারের বেঁধে দেওয়া দামও কার্যকর হয়নি।
কারওয়ান বাজারের পাইকারি আলু বিক্রেতা আফতাব আহমেদ
বুধ ও বৃহস্পতিবার রাজধানীর রামপুরা, মালিবাগ, মগবাজার, পলাশী, নিউমার্কেট, হাতিরপুল ও কাঁঠালবাগান বাজার ঘুরে দেখা যায়, বাজারে প্রতি কেজি আলু বিক্রি হচ্ছে ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়। যদিও সরকার নির্ধারিত দাম ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা। সরকার যখন দাম বেঁধে দেয়, তখনো বাজারে আলুর দাম ছিল ৪৫ থেকে ৫০ টাকা। সেই হিসাবে এক মাসে আলুর দামের কোনো নড়চড় হয়নি বাজারে।
কারওয়ান বাজারের পাইকারি আলু বিক্রেতা আফতাব আহমেদ বলেন, আলুর সরবরাহ কম থাকায় দাম কমেনি। এখনো অনেক হিমাগার আলু ছাড়ছে না। এ জন্য সরকারের বেঁধে দেওয়া দামও কার্যকর হয়নি।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায়। যদিও সরকার নির্ধারিত দাম ১৩০ টাকা। ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডারের দাম বাজারে ১ হাজার ৪০০ থেকে দেড় হাজার টাকা। যদিও সরকার নির্ধারিত দর ১ হাজার ৩৬৩ টাকা। বাজারে সরকার নির্ধারিত দামে শুধু বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৬৯ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
সরকার প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম বেঁধে দিয়েছে ৬৪ থেকে ৬৫ টাকা। যদিও বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৯৫ থেকে ১০০ টাকায়। কোথাও কোথাও দেশি পেঁয়াজের দাম আরও একটু বেশি। সরকার যখন দেশি পেঁয়াজের দাম বেঁধে দিয়েছিল, তখন বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজের দাম ছিল ৮৫ থেকে ৯০ টাকা। সেই দামেও এখন আর দেশি পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না; বরং এক মাসে কেজিতে দেশি পেঁয়াজের দাম ১০ থেকে ১৫ টাকা বেড়েছে। দেশি পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমদানি করা পেঁয়াজের দামও বেড়েছে। আমদানি করা প্রতি কেজি পেঁয়াজ মানভেদে বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়।
চলতি সপ্তাহের মাঝামাঝি দেশের বাজারে আমদানি করা ডিম আসবে। আশা করছি, আমদানি করা ডিম বাজারে এলে দাম কিছুটা কমবে।
টাইগার ট্রেডিংয়ের মালিক সাইফুর রহমান
রাজধানীর বাদামতলীর পেঁয়াজ আমদানিকারক মো. কামরুজ্জামান বলেন, দেশে পেঁয়াজের দাম এই সময়ে একটু বাড়তি থাকে। ভারত পেঁয়াজ রপ্তানিতে বাড়তি শুল্কারোপ করায় এবার আমদানিতেও দাম বেশি পড়ছে। তাই বাজারে দাম কমছে না; বরং কিছুটা বেড়েছে।
বাজারে ডিমের ডজন এখন ১৬০ থেকে ১৬৫ টাকা। এক মাস আগে ছিল ১৫০ থেকে ১৫৫ টাকা। সরকার প্রতিটি ডিমের সর্বোচ্চ দাম বেঁধে দিয়েছিল ১২ টাকা। সেই হিসাবে প্রতি ডজন ডিমের দাম পড়ে ১৪৪ টাকায়। ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার এ পর্যন্ত ১৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতিও দিয়েছে। এরপরও দেখা যাচ্ছে, বাজারে দাম না কমে উল্টো বেড়েছে। এদিকে ১৫ কোটি ডিম আমদানির অনুমতি দেওয়ার তিন সপ্তাহ পার হলেও এখনো আমদানি করা কোনো ডিম বাজারে আসেনি।
ডিম আমদানির অনুমোদন পাওয়া প্রতিষ্ঠান টাইগার ট্রেডিংয়ের মালিক সাইফুর রহমান বলেন, ‘চলতি সপ্তাহের মাঝামাঝি দেশের বাজারে আমদানি করা ডিম আসবে। আশা করছি, আমদানি করা ডিম বাজারে এলে দাম কিছুটা কমবে।’
এদিকে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ১৩৫ থেকে ১৪০ টাকায়। যদিও সরকার নির্ধারিত দাম ১৩০ টাকা। ১২ কেজির এলপিজি সিলিন্ডারের দাম বাজারে ১ হাজার ৪০০ থেকে দেড় হাজার টাকা। যদিও সরকার নির্ধারিত দর ১ হাজার ৩৬৩ টাকা। বাজারে সরকার নির্ধারিত দামে শুধু বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৬৯ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সুযোগ না থাকলেও বিশেষ অবস্থায় যদি দাম নির্ধারণ করতেই হয়, তবে সেক্ষেত্রে বাজারে পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখতে হয়। তাহলেই কেবল সুফল মেলে।
ক্যাব সভাপতি ও সাবেক বাণিজ্যসচিব গোলাম রহমান
সরকারের পক্ষ থেকে সর্বশেষ ভোজ্যতেলের দাম বেঁধে দেওয়া হয় সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি। আর চিনির দাম সর্বশেষ বেঁধে দেওয়া হয়েছিল আগস্টে। কিন্তু চিনি নির্ধারিত দরে কখনোই বিক্রি হয়নি। এলপিজিও না। এবার দেখা যাচ্ছে, দাম কার্যকর না হওয়ার তালিকায় পেঁয়াজ, ডিম, আলুও ঢুকছে।
দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ ছাড়িয়ে যাওয়ার (আগস্ট মাসে) খবর আসার পর ১৪ সেপ্টেম্বর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক বৈঠকে আলু, ডিম ও দেশি পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। আর আগের ধারাবাহিকতায় সয়াবিন তেলের নতুন দাম জানানো হয়। চিনির দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল গত আগস্টে। কিন্তু সেই দামে চিনি তো বাজারে মিলছেই না, উল্টো টান পড়েছে সরবরাহে। এর বাইরে প্রতি মাসে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) এলপিজি সিলিন্ডারের দাম ঠিক করে দেয়। কিন্তু বেঁধে দেওয়া এ দামও বাজারে মানা হচ্ছে না। ফলে ভোক্তারা পাচ্ছেন না কোনো সুফল।
অভিযানের সুফল নেই
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে বেঁধে দেওয়া দাম কার্যকরে বাজারে অভিযান চালানো হচ্ছে। সারা দেশে অভিযান চালিয়েছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা। তবে অভিযানের সুফল ক্রেতারা পাননি।
এ বিষয়ে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেন, অভিযানের ফলে বাজারে নতুন করে দাম বাড়েনি। অভিযান না চালালে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতো। বাজারে অভিযানের পরও সফলতা আসেনি বলে মানছেন তিনিও।
তবে বিক্রেতা থেকে শুরু করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরবরাহব্যবস্থা না বাড়িয়ে কোনো পণ্যের দাম বেঁধে দিলে তা কার্যকর হয় না। মুক্তবাজার অর্থনীতিতে এ ধরনের পদক্ষেপ কাজে দেয় না।
এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি ও সাবেক বাণিজ্যসচিব গোলাম রহমান বলেন, মুক্তবাজার অর্থনীতিতে সুযোগ না থাকলেও বিশেষ অবস্থায় যদি দাম নির্ধারণ করতেই হয়, তবে সেক্ষেত্রে বাজারে পণ্যের সরবরাহ ঠিক রাখতে হয়। তাহলেই কেবল সুফল মেলে।