নিয়ন্ত্রণে আসছে না মূল্যস্ফীতি
দেশে দীর্ঘদিন ধরেই উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজ করছে। মূল্যস্ফীতির হার প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে। গত জানুয়ারিতে মুদ্রানীতি ঘোষণার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এনে মানুষকে স্বস্তি দেয়ার আশ্বাস দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। পরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ঋণের সুদহার বাড়ায় সংস্থাটি। তবে সুদহার বৃদ্ধির প্রভাব মূল্যস্ফীতিতে দেখা যায়নি। অর্থাৎ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মতে, গত মে মাসে দেশে গড় মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়িয়েছে ৯.৮৯ শতাংশ।
অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ সূচক মূল্যস্ফীতির এমন প্রেক্ষাপটে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসের জন্য নতুন মুদ্রানীতি ঘোষণা করতে যাচ্ছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, আগের মুদ্রানীতিগুলোর মতো ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথমার্ধের জন্য ঘোষিত মুদ্রানীতিতেও সংকোচনমুখীর ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। এক্ষেত্রে সুদহার আরও বাড়ানোর ঘোষণা আসতে পারে। বাড়ানো হতে পারে নীতি সুদহার, রেপো, রিভার্স রেপোর মতো মুদ্রানীতির মৌলিক সুদ কাঠামোগুলোও।
এ ছাড়া ডলারের দর পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করা হতে পারে। ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) নির্দেশিত ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি চালু করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে এতে লক্ষ্য অনুযায়ী সুফল পাওয়া যায়নি। তবুও আসন্ন মুদ্রানীতিতে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি আগের মতোই রাখা হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। আব্দুর রউফ তালুকদার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে ২০২২ সালের জুলাই মাসে যোগদান করেন। এরপর তিনি ৩টি মুদ্রানীতি ঘোষণা করেছেন। এ মাসে যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করা হবে সেটি নিয়ে হবে ৪টি। গত মে মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৮৯ শতাংশ। তার মানে হলো ২০২২ সালে একজন মানুষের যাবতীয় খরচ যদি ১০০ টাকা হয়, তাহলে ২০২৪ সালে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৯ টাকা ৮৯ পয়সা। অর্থাৎ প্রতি ১০০ টাকায় খরচ বেড়েছে ৯ টাকা ৮৯ পয়সা। আর মানুষের ভোগ্য ব্যয়ের এই বাড়তি বোঝা চেপেছে বর্তমান গভর্নরের সময়েই।
সুদহার বৃদ্ধির কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে স্থবিরতার পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যের চাপ সরকারের অনেক অর্জনই ম্লান করেছে। এতে চাপে রয়েছে গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। তাই এবারের মুদ্রানীতির মূল লক্ষ্যই থাকবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ। গত জানুয়ারিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি ঘোষণার মূল লক্ষ্য ছিল মূল্যস্ফীতি কমিয়ে ‘সাড়ে ৬ শতাংশে’ আনা। সেটি সম্ভব হয়নি; বরং উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে।
এদিকে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা ও জিডিপি ৬.৭৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। একই লক্ষ্য ঠিক রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকও মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে ঘোষণা করবে বলে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চাল, ডাল, চিনি, আটা-ময়দা, শাকসবজি, মাছ-মাংস, ডিম, পিয়াজসহ প্রায় সব নিত্যপণ্যের দামই বেড়েছে। এগুলো কিনতেই স্বল্প আয়ের মানুষের আয়ের সিংহভাগ চলে যায়। সাধারণত মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের অন্যতম প্রধান হাতিয়ার হলো সুদের হার বাড়ানো। কিন্তু সেটি করেও অর্থাৎ সুদহার বাড়ানো হলেও মূল্যস্ফীতি লাগাম ছাড়াই রয়ে গেছে; যে কারণে নিম্ন আয়ের মানুষ এখন বেশ কষ্টে আছে।
জানা গেছে, আগামী ৭ই জুলাই থেকে মুদ্রানীতি নিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠক হবে। এরপর ১১ই জুলাই মুদ্রানীতি সংক্রান্ত কমিটির চূড়ান্ত বৈঠক হবে। সেখান থেকে গভর্নরের কাছে একটি তারিখ চাইবে কমিটি। এই কমিটিতে গভর্নরসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের পাশাপাশি রয়েছেন অর্থনীতিবিদ সাদিক আহমেদ, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের চেয়ারম্যান মাসুদা ইয়াসমীন। সবকিছু ঠিক থাকলে জুলাই মাসের মধ্যভাগে ঘোষিত হবে নতুন মুদ্রানীতি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান চ্যালেঞ্জ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। লক্ষ্য বাস্তবায়নে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি প্রণয়ন করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে ডলারের দাম এবং সুদের হার নির্ধারণে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হবে। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নতুন করে পদক্ষেপ নেয়ার সুযোগ কম। ব্যাংক ঋণের সুদহার ইতিমধ্যে ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে ১৫ শতাংশ ছাড়িয়েছে। তারপরও নীতি সুদের হার বাড়িয়ে টাকাকে আরও দামি করে তোলা হতে পারে। এতে ঋণের সুদের হার আরও বাড়বে।
এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি বছরে নীতি সুদের হার দুই দফা বাড়িয়েছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়েছে সরকারের ব্যাংক ঋণের সুদে। সুদহারের সীমা তুলে দেয়ায় এর প্রভাব পড়েছে ব্যাংক ঋণের সুদে। প্রথম দফায় গত জানুয়ারিতে নীতি সুদহার ২৫ শতাংশীয় পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮ শতাংশ করা হয় ও গত মে মাসে তা ৫০ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে ৮.৫ শতাংশ করা হয়। এর ফলে ঋণের সুদের হার বেড়ে সাধারণত ঋণের চাহিদা কমে যায়। ফলে গত এপ্রিলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবাহ কমে ৯.৯০ শতাংশে নামে।
জানা গেছে, দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সংকট হয়ে দেখা দিয়েছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি। জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে নাজেহাল সাধারণ মানুষ। আর অর্থনীতির ভিতকে ধারাবাহিকভাবে দুর্বল করছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ধারাবাহিক পতন। এতে ডলার সংকট আরও তীব্র হচ্ছে। সমপ্রতি আইএমএফ ও অন্যান্য সংস্থা থেকে ধার দেনা করে রিজার্ভ কিছুটা বাড়িয়েছে আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ব্যাংক।
এদিকে ডলার সংকট কাটাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও ভালো ফল আসেনি। রিজার্ভ থেকে ধারবাহিকভাবে ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর ফলে রিজার্ভ আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট রিজার্ভ ২৭ বিলিয়ন ডলার। আর আইএমএফ স্বীকৃত বিপিএম-৬ হিসাবে রিজার্ভ ২২ বিলিয়ন।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংক খাতের করুণ অবস্থা ঠিক করাটা এখন অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। সঠিক তদারকি ও সুশাসনের অভাবে পুরো খাত মৃতপ্রায় হয়ে গেছে। এ কারণে অনেক নীতি কাজে দিচ্ছে না। কোনো অবস্থাতেই টাকা ছাপানো যাবে না। তাহলে মুদ্রানীতির লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না।
গত শনিবার ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের উপর সমাপনী বক্তব্যে অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী বলেছেন, মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে যেসব সংকোচনমূলক নীতি গ্রহণ করা হয়েছে তাতে প্রবৃদ্ধির গতি শ্লথ হয়ে যেতে পারে।
এদিকে সম্প্রতি বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতি কমাতে মুদ্রানীতি আরও সংকোচনের পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। সংস্থাটি বলেছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি বহুমুখী চ্যালেঞ্জের মুখে আছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের সার্বিক কার্যক্রমের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার সুপারিশ করেছে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন নিশ্চিতের মাধ্যমে ক্ষমতা আরও বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে।