Hot

নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে বাড়ে ওষুধের দাম

জীবন রক্ষাকারী অর্ধশতাধিক ওষুধের দাম আবারও বেড়েছে। গত তিন মাসে কোনো কোনো ওষুধের দাম ১১০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো দাম বৃদ্ধির ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠান ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের নিয়মের তোয়াক্কা করেনি বলে অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিত্যপণ্য কিনতে হাঁপিয়ে ওঠা মানুষ এ ধাক্কা সামলাতে খাদ্যপণ্যে কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছেন। দীর্ঘমেয়াদে পরিবারের সদস্য, বিশেষ করে নারী ও শিশুদের মধ্যে দেখা দেবে পুষ্টি ঘাটতি। নিম্ন ও মধ্যবিত্তকে ওষুধের বাড়তি দাম চুকাতে হবে প্রাণের মূল্যে! যদিও ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, জ্বালানি তেল ও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে কিছু ওষুধের দাম সমন্বয় করা হয়েছে।

জানা যায়, অত্যাবশ্যকীয় ১১৭টি ওষুধের দাম নির্ধারণ করে সরকার। এর বাইরে যত ওষুধ বাজারে রয়েছে, বেশির ভাগ উৎপাদক কোম্পানির ঠিক করা দামে বিক্রি হচ্ছে। তবে এর জন্যও কিছু প্রক্রিয়া মানতে হয় কোম্পানিগুলোকে। নতুন দরের যুক্তিসহ অনুমোদনের জন্য ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে আবেদন করতে হয়। সরকার আমদানি কাঁচামালের সোর্স কান্ট্রি, দর, মানসহ বিভিন্ন বিষয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে যাচাই শেষে সমন্বয় করে। কিন্তু ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিগত কয়েক বছরের মতো এবারও এ নিয়ম মানেনি কোম্পানিগুলো। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাজারে দাম কার্যকর করে তা অনুমোদনের জন্য আবেদন করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, বড় বড় উৎপাদক প্রতিষ্ঠান শুরু থেকেই সরকারকে চাপে রাখে। যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের সক্ষমতা না থাকায় অধিদপ্তরও মেনে নিতে বাধ্য হয়।

এমনিতেই মানুষ তাঁর উপার্জনের বড় অংশ নিজের কিংবা পরিবারের চিকিৎসায় ব্যয় করছে। গত তিন মাসে ওষুধভেদে ১০ থেকে ১১০ শতাংশ দাম বেড়েছে, গড়ে যা ২৯ শতাংশ। হঠাৎ দামের লাফে বিপাকে পড়েছে সাধারণ মানুষ। গত এক সপ্তাহে রাজধানীর বিভিন্ন ফার্মেসিতে অন্তত ৫০টি ওষুধ বাড়তি দামে বিক্রি হতে দেখা যায়। এসব ওষুধের মধ্যে আটটির দাম বেড়েছে ৫০ শতাংশের বেশি। ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ ১১, ১০ থেকে ৩০ শতাংশ ২২ ও ৯টি ওষুধের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১১০ শতাংশ। বৃদ্ধির তালিকায় থাকা ২১টি ওষুধ স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের। এ ছাড়া এসিআই, এরিস্ট্রো ফার্মা, সার্ভিয়ার ফার্মা, ইউনিমেড ইউনিহেলথ, ড্রাগ ইন্টার ন্যাশনাল, বীকন ফার্মা ও নুভিস্তা ফার্মার বিভিন্ন ওষুধের দাম বেড়েছে। বৃদ্ধির তালিকায় যেমন শিশুর সর্দি-কাশির সিরাপ রয়েছে; তেমনি রয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক, ভিটামিন, ব্যথা, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগের ওষুধ।

ঝিনাইদহের দিনমজুর নজরুল ইসলাম উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তিনি জানান, সংক্রামক এ রোগ নিয়ন্ত্রণে তাঁকে মাসে ৪-৫ হাজার টাকার ওষুধ খেতে হতো। এখন লাগছে ৬-৭ হাজার। চাল-ডাল কিনতে নাভিশ্বাস ওঠা নজরুল কী করবেন, দিশা পাচ্ছেন না। একই অবস্থা রাজধানীর আজিমপুরের বাসিন্দা মো. শাহিনূরের। দুই মাস আগে হার্টে রিং বসিয়ে নিয়মিত ওষুধ সেবন করছেন। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী প্রতি মাসে তিন হাজার টাকার ওষুধ লাগছে। প্রাণ বাঁচাতে খাদ্যপণ্যে কাটছাঁট করে পরিবারকে কষ্ট দিচ্ছেন বলে আক্ষেপ করেন তিনি।

ফার্মেসি দোকানিদের তথ্যে, অনিয়ন্ত্রিত-২ ডায়াবেটিস রোগীর ব্যবহৃত এমজার্ড এম ট্যাবলেট ৫/৫০০ মিলিগ্রামের প্যাকেট ৫০০ থেকে হয়েছে ৫৪০ এবং ডাইমাইক্রন এম ৩০ মিগ্রা ৩৮০ থেকে হয়েছে ৪২০ টাকা। এমপামেট ৫ মিগ্রা+৫০০ ট্যাবলেট ১০০ টাকা বেড়ে ৬০০, এরিস্ট্রো ফার্মার প্লুভান প্লাস ৫০ মিগ্রা ২২০ টাকা বেড়ে ৭২০, লিনাগ্লিপ-এম ৫০০ মিগ্রা ৩৬০ টাকা থেকে ৪২০, কমেট ৫০০ মিগ্রা ৪০০ থেকে ৫০০, গ্যাস্ট্রিকের ফ্যামোট্যাক ২০ মিগ্রা ট্যাবলেট ৩০০ থেকে ৪৫০, মোটিগাট ১০ মিগ্রা ৩৫০ থেকে ৪২৫, ১০ টাকার অ্যানাফ্লেক্স ম্যাক্স ২১ এবং ২০ টাকার ভায়োডিন মাউথওয়াশ ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

একইভাবে মূত্রথলির অতিকার্যকারিতায় ব্যবহৃত ইউট্রোবিন ৫ মিগ্রা ট্যাবলেট ৪৫০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০০ টাকা। পাইলস রোগীদের ড্যাফলন ৯০০+১০০০ মিগ্রা ৬৯০ থেকে ৮৪০, বাত চিকিৎসার অ্যানাফ্লেক্স ৫০০ মিগ্রা ৯ থেকে ১৬, উচ্চ রক্তচাপের ন্যাট্রিলিক্স এসআর ১.৫ মিগ্রা ২৭০ থেকে ৩৩০, হৃদরোগের ভাস্টারেল এমআর ট্যাবলেট ৫৪০ থেকে ৭২০ (সার্ভিয়ার ফার্মা), ওএমজি-৩ ক্যাপসুল ২৭০ থেকে ৩৩০, প্রাথমিক হৃদরোগ প্রতিরোধে রসুভা ৫ মিগ্রা ট্যাবলেট ৫০০ থেকে ৬০০ ও রসুভা ৫ মিগ্রা. ৬০০ থেকে এক লাফে হয়েছে ৬৬০ টাকা।

ভিটামিন বি ট্যাবলেট বিকোবিয়ন ৯০ টাকা বেড়ে ৩৯০, হাড়ের ক্ষয়রোধে ওভোক্যাল ডি ৩০০ থেকে ৩৬০, ব্যথা নিরাময়ে এভেনাক ১০০ মিগ্রা ট্যাবলেট ২৫০ থেকে ৩৫০, মারভ্যান ১০০ মিগ্রা ট্যাবলেট ৩০০ টাকা বেড়ে হয়েছে ৭০০। সংবেদনশীল ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের চিকিৎসা ব্যবহৃত জিরোটিল প্লাস ২৫০ মিগ্রা ৪২০ টাকা থেকে হয়েছে ৬৩০, ফেক্সো ১৮০ মিগ্রা ট্যাবলেট ৩০০ থেকে ৩৬০, মাইগ্রেনজনিত সমস্যায় ব্যবহৃত ফ্লুভার ট্যাবলেট ২০০ টাকা বেড়ে ৭০০, ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনোলজি ডিজিজ (সিওপিডি) বা অ্যাজমা রোগীদের ডক্সোমা ২০০ মিগ্রা ট্যাবলেট ২৫০ থেকে ৪০০, শীতকালীন অ্যালার্জিজনিত রুপিন ১০ মিগ্রা ১০০ টাকা বেড়ে ৬০০, পপুলার ফার্মাসিউটিক্যালসের বিলাস্টিন ২০ মিগ্রা ট্যাবলেট ৪৫০ থেকে ৪৮০, অ্যালাট্রোল ৫ মিগ্রা ৩০ থেকে ৩৫, ফেবুস ৪০ মিগ্রা ট্যাবলেট ৩৬০ থেকে বেড়ে ৪৫০ টাকা করেছে কোম্পানিগুলো।

নারীর প্রজননজনিত ব্যাধি নিরাময়ে ডাইনোজেস্ট ২ মিগ্রা ট্যাবলেট ২০০ টাকা বেড়ে ১ হাজার, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভাবস্থা প্রতিরোধে ডাইড্রোন ১০ মিগ্রা ট্যাবলেট ৩০০ টাকা বেড়ে ১ হাজার ২০০, অস্ত্রোপচার-পরবর্তী ব্যথা নিরাময়ের টোরাক্স ১০ মিগ্রা ট্যাবলেট ৬০০ থেকে ১ হাজার এবং ৩৬০ টাকার অ্যানাডল এসআর ১০০ মিগ্রা ট্যাবলেট এক লাফে হয়েছে ৫১০ টাকা।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির মহাসচিব এম শফিউজ্জামান বলেন, গত ছয় মাসে সব ধরনের ওষুধে ৩৫ শতাংশ উৎপাদন খরচ বেড়েছে। এর পরও তিন মাসে কোনো ওষুধের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়নি। কিছু ওষুধের দাম সমন্বয় করা হয়েছে, যেগুলোর আবেদন তিন থেকে চার বছর আগের। তবে এটা সত্যি, কিছু ওষুধের দাম না বাড়ালে উৎপাদন বন্ধ রাখতে হবে।

নতুন দামকে অযৌক্তিক আখ্যা দিয়ে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সাবেক উপপরিচালক (আইন) নুরুল আলম সমকালকে বলেন, সম্প্রতি ওষুধ প্রশাসন অযৌক্তিকভাবে বিভিন্ন ওষুধের অতিরিক্ত মূল্য নির্ধারণ করেছে। তারা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করে এটি করতে পারত। এখন দাম নিয়ে অভিযোগ উঠেছে, মন্ত্রণালয় চাইলে নতুন করে বৈঠকের মাধ্যমে সমাধান করতে পারে। কারণ গত বছর প্রস্তাব পেয়ে অধিদপ্তর, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও কোম্পানির প্রতিনিধিরা বৈঠক করে। যাচাই-বাছাই করে তখন স্বাস্থ্য সচিব বলেছিলেন, নতুন করে ওষুধের দাম বাড়ানোর সুযোগ নেই। তাহলে কী এমন হলো যে, বছর না যেতেই বাড়ল?

তিনি বলেন, কোনো কোনো কোম্পানি ১১০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে। কিন্তু উৎপাদন খরচ এত বেড়েছে? আসলে এ খাতের মা-বাপ নেই। কোম্পানিগুলো চীন থেকে কাঁচামাল এনে দেখায় শ্রীলঙ্কার। জীবনে একবার ইউরোপ থেকে আনলেও বছরের পর বছর সেটি দেখিয়ে অন্য দেশেরটি চালিয়ে দিচ্ছে। এসব দেখবে ঔষধ প্রশাসন। কিন্তু তারাও তো নির্বিকার।

অবশ্য ঔষধ প্রশাসনের পরিচালক (প্রশাসন) আশরাফ হোসেন বলেন, এবার ৫ থেকে ১০ শতাংশ হারে ওষুধের দাম সমন্বয় করা হয়েছে। নিয়ম মেনে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ বাড়ানো যায়। কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও করতে হয়। যেমন– স্কয়ারের ১২ টাকার একটি ওষুধ হয়েছে ২০ টাকা। একই ওষুধ অন্য কোম্পানির ২৫-৩০ টাকা থাকায় সমন্বয়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

ঔষধ প্রশাসনের সক্ষমতায় ঘাটতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, ওষুধের যৌক্তিক মূল্য নির্ধারণের সক্ষমতায় ঘাটতি রয়েছে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের। তাদের নিয়ম কোনো কোম্পানি মানে না। এমনকি তারাও মানতে বাধ্য করতে পারে না। তাই মাঝেমধ্যে মাত্রাতিরিক্ত দাম বৃদ্ধির অভিযোগ ওঠে। এতে বিক্রেতা লাভবান হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ভোক্তা।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, এমনিতেই হতদরিদ্র, নিম্ন ও মধ্যবিত্তরা প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবার বাইরে। এখন ওষুধের দাম মাত্রাতিরিক্ত বাড়ায় দেখা দেবে চিকিৎসা বৈষম্য।

জানতে চাইলে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের পরিচালক আকতার হোসেন বলেন, আমরাও অভিযোগ পাচ্ছি। ভোক্তা থেকে লিখিত পেলে দাম পুনর্বিবেচনার সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া বাজার তদারকির জন্য সারাদেশে চিঠি পাঠনো হয়েছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor