নির্বাচনেও উপেক্ষিত প্রতিবন্ধীরা

নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে প্রতিবন্ধীদের জন্য ভোটব্যবস্থায় সংস্কারের কোনো প্রস্তাব নেই
সরকারের হিসাবমতে, এই রিপোর্ট লেখার সময় ১৪ আগস্ট পর্যন্ত দেশে ৩৬ লাখ ৪৪ হাজার ২৮৬ জন প্রতিবন্ধী নাগরিক আছেন। এই তথ্য সংগ্রহ চলমান। এদের মধ্যে ২০ বছরের ঊর্ধ্বে ২৯ লাখ ৩৮ হাজার ৬৩৮ জন, যারা ভোটার। দিন যতই যাচ্ছে ভোটের প্রস্তুতি কার্যক্রম গতি বাড়ছে। আলোচনা পরিকল্পনা এগিয়ে চলছে, তবে এই কার্যক্রমে উপেক্ষিত প্রতিবন্ধীরা বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি, ‘নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের ২০২৫ সালের প্রতিবেদনে প্রতিবন্ধীদের জন্য ভোটব্যবস্থায় সংস্কার আনার কোনো প্রস্তাব নেই। প্রবাসী বাংলাদেশিরা কীভাবে ভোট দেবেন, তা বেশ প্রশংসনীয়ভাবে স্থান করে নিয়েছে। কিন্তু নির্বাচনকে প্রতিবন্ধীবান্ধব করার জন্য সমান চেষ্টা বা উদ্যোগের নেই প্রতিবেদনে।’
নির্বাচন কমিশন বলছে, ‘নির্বাচন বিধিমালা-২০০৮-এর ১৩-তে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির যে ভোটাধিকার সংরক্ষণ করেছে, আপাতত এর বাইরে কিছু করা সম্ভব নয়। তবে প্রতিবন্ধীদের অধিকার আদায়ে কাজ করা ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এবং সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞজনেরা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ভোটাধিকার নিশ্চিত করার বিশেষ সুযোগ করার দাবি করছেন। একই সঙ্গে প্রতিবন্ধীর অধিকার বাস্তবায়নে নির্বাচনে প্রতিনিধিত্ব করতে দলে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির এক বা একাধিক কোটা অন্তর্ভুক্ত করার বিষয়ও কার্যক্রম গ্রহণের দাবি করেন তারা।
যেসব প্রতিবন্ধকতার শিকার হন প্রতিবন্ধী ভোটার
ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের মাস্টার্সের দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী তফসারুল্লাহ জানান, ২০২৪ সালে তিনি ভোটার হন। গত বছর ভোটার হলেও জানুয়ায়ি মাসে ভোট দিতে পারেননি। এবার ভোট দেওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করে তফসারুল্লাহ বলেন, ‘শুনেছি একজন পোলিং এজেন্ট দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ভোট দিয়ে দেন। এক্ষেত্রে ভোটারের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেওয়া নিশ্চিত হওয়া জরুরি। ভোটকেন্দ্র প্রতিবন্ধীবান্ধব হওয়া জরুরি।’ নাজমা বেগম একজন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী ব্যক্তি। ২০০১ সালে তিনি প্রথম ভোটার হন। ২০০৮ সালে তিনি প্রথম ও শেষ ভোট দেন। জীবনে একবার ভোট দেওয়ার কারণ হিসেবে বলেন, ‘যাতায়াত প্রধান সমস্যা। অনেক দূর হেঁটে ভোটকেন্দ্রে যেতে হয়। যারা হুইলচেয়ার ব্যবহার করেন তাদের জন্য ভোট দেওয়া আরো কঠিন।
অধিকারকর্মীরা যা বলেন ২০০৭ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘের প্রতিবন্ধীদের অধিকারের কনভেনশন (সিআরপিডি) অনুমোদন করলেও এর বাস্তবায়ন কম বলে উল্লেখ করে হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী ‘উইমেন ইউথ ডিজঅ্যাবিলিটি ডেভেলপম্যান্ট ফাউন্ডেশন’ ডব্লিউডিডিএফের নির্বাহী পরিচালক আশরাফুন নাহার মিষ্টি বলেন, ‘আশা করা যায় পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভোটের মাধ্যমে জনমানুষের সরকার নির্বাচিত হবে। কেন্দ্রগুলো মূলত প্রতিবন্ধীবান্ধব হয় না। যারা ভোট গ্রহণের কাজ করেন তারাও প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার বান্ধব হন না। শারীরিক প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য প্রবেশগম্য ভোটকেন্দ্রে প্রয়োজন, অন্য প্রতিবন্ধীর জন্য সহযোগী প্রয়োজন। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য ব্রেইলে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা, মেশিন রিডেবল হলে এখানে অডিও থাকতে হবে। এখনো পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ভোট দেওয়ার বিষয় নিয়ে কিছু ভাবছেন না, প্রতিবেদনেও কিছু নেই। অনেক সময় যারা কথা বলতে পারে না, তারা ভোট দিতে পারে না ইশারাভাষীর অভাবে। তিনি রাজনৈতিক দলগুলো প্রতিশ্রুতির উপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘নির্বাচন মেনিফ্যাস্টুতে প্রতিবন্ধীর অধিকার আসতে হবে, তা না হলে পরে তারা যখন কাজ করবেন তখন প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর প্রতি দায়িত্বশীল হবে না। সহিংসতা হলে অপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরও প্রতিবন্ধী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য কাজ করে সমাজসেবা অধিদপ্তর, অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. সাইদুর রহমান খান বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রতিবন্ধীর ভোটাধিকার প্রয়েগের বিষয় তাদের কোনো প্রকার কার্যক্রম নেই। তবে নির্বাচন কমিশন চাইলে তারা যে কোনো রকমের সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত।
অধিকার আদায়ে প্রতিবন্ধী অধিকারকর্মীরা জোর দিয়ে বলেন, ‘সংরক্ষিত আসনে যেন দুই জন নারী অংশ নিতে পারেন। গত বছর তিন জন প্রতিবন্ধী নারী মনোনয়ন ফর্ম কিনেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচন করতে পারেননি। তাদের একজন বি-স্ক্যান সাধারণ সম্পাদক সালমা মাহবুব। তিনি বলেন, ‘প্রতিবন্ধী নারীকে নমিনেশন দেওয়া হয় না, কারণ মনে করা হয় তারা দলের জন্য কাজ করতে পারবেন না। কিন্তু প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা নির্বাচিত হলে প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর কাজ এগিয়ে যাবে, এটা দশের ও দেশের কাজ হবে।’
তিনি বলেন, ‘২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আহত একজন প্রতিবন্ধী নারী দশম জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত আসনের সংসদ সদস্য ছিলেন। কিন্তু তিনি প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্ব করতেন না।’ এ বছর আবার নির্বাচনে অংশ নেবেন কি না-প্রশ্ন করলে সালমার উত্তর, ‘ইচ্ছে নেই।’ কিন্তু ভোট দেওয়ার ইচ্ছে আছে, নাগরিক অধিকার প্রয়োগ করতে চাই। তিনি একজন হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী। তাই বিশেষ যানবাহনের সুযোগ দেওয়ার কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘নারী উন্নয়ন নীতিমালায় প্রতিবন্ধীর ভোটের অংশ নেওয়ার বিষয় আছে।’
বিজ্ঞজনেরা যা বলেন ২০১৮ সালের নির্বাচন-পরবর্তী ভোটার অংশগ্রহণ মূল্যায়ন প্রতিবেদন মতে দেশের ৩০ লাখের বেশি প্রতিবন্ধী ভোটার নিবন্ধনে নাম লিখিয়েছেন। কিন্তু ২০১৮ সালের নির্বাচনে ১০ শতাংশের কম প্রতিবন্ধী নাগরিক ভোট দিয়েছেন। ৯০ ভাগ ভোটারই কেন ভোট দিলেন না বা দিতে পারলেন না? নির্বাচন সংস্কার কমিশন প্রধান ও সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক, ড. বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ভোটাধিকার প্রয়োগ বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে না। গণমাধ্যমকর্মীদের মতো প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদেরও মোটরসাইকেলে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করেন। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির ভোট দেওয়ার বিষয়টি আরো বিস্তৃত হওয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ। তবে তিনি বলেন, আপাতত শুধু ভোটকেন্দ্রে এলে ভোট দেওয়া নিশ্চিতের ব্যবস্থা করা ছাড়া কোনো ব্যবস্থা নেই।