Bangladesh

নির্বাচনের আগে পুলিশ ও প্রশাসনকে খুশি করছে সরকার

প্রথমে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের জন্য দামি গাড়ি এবং তারপর পুলিশ কর্মকর্তাদের জন্য বিশেষ পদোন্নতি নির্বাচনের কয়েকমাস আগে সরকারের এমন পদক্ষেপ নানা প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। অনেকে মনে করছেন, নির্বাচনের আগে প্রশাসন ও পুলিশকে ‘খুশি করার জন্য’ এসব পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে।

পর্যবেক্ষকরা বলছেন, প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্বাচনের আগে আগে এ ধরনেরর সুবিধা দেয়া হলে নির্বাচনের মাঠে সমান প্রতিযোগিতার পরিবেশে নষ্ট হবে।

তবে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেছেন, এ ধরনের মন্তব্য ‘অহেতুক’। কারণ প্রয়োজনের জন্যই নৈমিত্তিক বিষয় হিসেবে সরকারি সেবাদানকারী কর্মকর্তাদের সুবিধা দেয়া হচ্ছে।

গত ২৫ অক্টোবর ৩৬৫জন পুলিশ কর্মকর্তাকে এক বছরের জন্য বিশেষ পদোন্নতি দেয়ার বিষয়টিতে অনুমোদন দিয়েছে সরকারের অর্থবিভাগ। প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটি ও প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিলে এসব পদ সৃষ্টি চূড়ান্ত হবে।


এর আওতায় ৩৬৫ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে সুপারনিউমারারি বা সংখ্যাতিরিক্ত পদে পদোন্নতি দেয়া হবে। অস্থায়ীভাবে সৃষ্ট এসব পদে কর্মকর্তারা আগের পদেই দায়িত্ব পালন করবেন। তাদের নতুন কোন দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে না। শুধু বেতনসহ আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধা বাড়বে। এতে প্রতি মাসে সরকারের এক কোটি টাকা খরচ বাড়বে।

এর আগে গত ১১ অক্টোবর অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতির আওতায় ২৬১টি মিৎসুবিশি পাজেরো স্পোর্ট কিউএক্স গাড়ি কেনার সিদ্ধান্তে অনুমোদন দেয়া হয়। জেলা প্রশাসক বা ডিসি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা-ইউএনওদের জন্য এসব গাড়ির কিনতে প্রায় ৩৮১ কোটি টাকা খরচ হবে বলে জানানো হয়।

নির্বাচনের সময় ডিসি ও ইউএনও-রা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকেন। জেলা পর্যায়ে ডিসিরা রিটার্নিং অফিসার এবং ইউএনও-রা সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।


নির্বাচনের আগে ‘খুশি’ রাখা?
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে নভেম্বরের মাঝামাঝিতে তফসিল ঘোষণা এবং জানুয়ারিতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা রয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নির্বাচনের আগে আগে প্রশাসন ও পুলিশকে খুশি রাখতেই এ ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার। জনগণের অর্থেই রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের কাজ করছে বলে মনে করেন অনেক পর্যবেক্ষক।

নির্বাচন পর্যবেক্ষক শারমিন মুরশিদ বলেন, নির্বাচনের এই আগ মুহূর্তে সরকারের এরইমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মতো আচরণ করাটা উচিত ছিল। এসব ‘বিশেষ সুবিধা’ দেয়াটা এখন ঠিক হচ্ছে না। এটা নির্বাচনকে, নির্বাচনের প্রস্তুতিকে প্রভাবিত করবে এবং এক ধরনের নেতিবাচক বার্তা দিবে।

মুরশিদ প্রশ্ন তোলেন, সরকারকে এই মুহূর্তেই কেন এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে হলো? তিনি মনে করেন, এমন পদক্ষেপের কারণে জনমনে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে এক ধরনের রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্যই আসলে এ ধরনের সুবিধা দেয়া হচ্ছে কিনা?

এই নির্বাচনী পর্যবেক্ষক বলেন, বর্তমান সরকার যেহেতু তার অধীনেই নির্বাচনটি করতে চায়, তাই এই সরকারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে একটি বার্তা দেয়া যে তারা কোনোভাবেই প্রশাসনকে, কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে প্রভাবিত করছে না, কোনোভাবেই কোনো বাড়তি সুবিধা দিচ্ছে না। এটি প্রতিযোগিতার পরিবেশকে ‘নষ্ট করে দিবে’ বলেও মনে করেন তারা।

তিনি বলেন, একটি দল যদি এত রকমের প্রিভিলেজ দিয়ে দেয় তাহলে বাকি দলগুলো কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? তাদের প্রতি আচরণটা তখন এই প্রশাসনের অন্য রকম তো হতে পারে। এটা তো ঠিক হচ্ছে না।

পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের প্রধান আহসান এইচ মনসুর বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে এটা আসলে এক ধরনের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।

তার মতে, নির্বাচনগুলো এখন অনেকটাই নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে হয়। আর এমন পরিস্থিতিতে প্রশাসন ও পুলিশ একটা বড় ভূমিকা রাখে। সে কারণেই তাদের ‘খুশি’ রাখতে চায় সরকার।

অর্থনৈতিক অবস্থার সাথে সরকারি এমন সিদ্ধান্ত কিছুটা বিরোধিতামূলক হলেও সরকার আসলে তার নির্বাচনী লাভ-ক্ষতিটাই বড় করে দেখে বলে মনে করেন তিনি।

তিনি বলেন, ‘প্রমোশন বা এর সাথে পছন্দের লোককে ডিসট্রিক্ট অ্যাডমিনিস্ট্রেশনে নিয়ে যাওয়া এবং তাদের আশা হলো যে তারা সরকারের স্বার্থটাকে ভালভাবে দেখবে, এটা তো এখন আমাদের কালচারের সাথে মিশে গেছে।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, গাড়ি কেনা এবং পদন্নোতির বিষয়গুলো যদি স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় হতো, তাহলে সেটি নিয়ে কোনো বিতর্কের সুযোগ থাকতো না। কিন্তু যে পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে, তার কারণে এটি পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।

তার মতে, বাংলাদেশে বর্তমানে দুটি প্রেক্ষাপট রয়েছে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে নির্বাচন।

বাংলাদেশে গত দুটি নির্বাচন নিয়েই বিতর্ক আছে এবং এসব নির্বাচনে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ভূমিকা নিয়েও সমালোচনা আছে। সে পরিপ্রেক্ষিতে এমন পদক্ষেপ নির্বাচনে সমান প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র তৈরির পরিপন্থী বলে মনে করছেন তিনি। কারণ প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্বাচনের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে বলেই ধরে নেয়া হয়।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন,‘নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা সংস্থার প্রতি কর্তৃপক্ষের তুষ্টির যে মাত্রা সেটাকে উচ্চতর পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার একাধিক প্রয়াস এগুলো। এ কারণেই এই দুটি বিষয়কে একই দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখার যৌক্তিকতা রয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি।’

দ্বিতীয়ত, সরকার ইউক্রেন যুদ্ধ এবং আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে দেশে কৃচ্ছতার নীতি অনুসরণের ঘোষণা দিয়েছে এবং সেটি এখনো বলবত রয়েছে।

গত জুলাই মাসে অর্থমন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে পরিচালন ও উন্নয়ন বরাদ্দের আওতায় সরকারি অফিসগুলোতে যানবাহন ক্রয় বন্ধ থাকবে।

ব্যক্তিগত খাতেও খরচ কমানোর আহ্বান জানানো হয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার জনগণকে ব্যয়সংকোচনের যে নীতি মানার নির্দেশনা দিচ্ছে, সেখানে বিশেষ শ্রেণীকে ‘তুষ্ট’ রাখার হাতিয়ার হিসেবে সরকারি অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে বলে এ নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন ড. ইফতেখারুজ্জামান।

একই সাথে এ ধরনের সিদ্ধান্ত একটা ‘দ্বিচারিতার দৃষ্টান্ত’ বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সরকার যেটা বলছে আর বা প্রচার করছে, সেটা প্রয়োগ করতে সরকার কিন্তু দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারছে না। বরং তার বিপরীতমুখী কাজ করছে।’

যা বলছে সরকার
সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ডিসি ও ইউএনওদের জন্য গাড়ি কেনার বিষয়ে বলেন, সেগুলোর প্রয়োজনীয়তা আছে বলেই সরকার সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

‘এগুলোর দরকার আছে, না হলে সরকার কেন করবে? সরকার বিবেচনা করে, খোঁজ খবর নিয়ে তারপর এগুলা করে।’

এ ধরনের পদক্ষেপ সরকারের কৃচ্ছতা নীতির বিরোধী নয় বলেও জানান মন্ত্রী।

মান্নান বলেন, মিতব্যয়িতা মানে হচ্ছে বাহুল্য বর্জন করা। আমরা বাহুল্য কিছু করবো না। অপচয় করবো না। প্রয়োজনীয় কাজ, আজকালকার যুগে আমাদের অফিসারদের সেবা দেয়ার জন্য গাড়ির প্রয়োজন তো হয়ই।’

তার মতে, গাড়ি কেনার সিদ্ধান্ত খুবই নৈমিত্তিক একটা কাজ।

‘সরকারের যে মিতব্যয়িতার নীতি সেটির সাথে এটা কনফ্লিক্ট নয়। কারণ নতুন কোনো পদ তৈরি করা হয়নি। এরইমধ্যে যারা কর্মরত আছে তাদের মধ্যে যাদের গাড়ি ছিল না তাদের গাড়ি দিবো, যাদের মন্দ গাড়ি ছিল, ভাল গাড়ি ছিল না, চেইঞ্জ করবো, এইতো কাজ। ভেরি অর্ডিনারি ওয়ার্ক। এই কাজ সরকার তো করবেই।’

পদোন্নতির বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান বলেন, অন্য বিভাগে পদোন্নতি হওয়ায় এবং কিছুটা জট লেগে থাকার কারণে এই সময়টাতে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে।

পদোন্নতির বিষয়টিও খুবই নৈমিত্তিক ব্যাপার উল্লেখ করে তিনি বলেন, এটাকে অন্যভাবে দেখা উচিত নয়। তবে কেউ চাইলে দেখতে পারে।

‘এটা নিয়ে বিবাদ নয়। আমাদের প্রয়োজন ছিল আমরা করেছি।’

নির্বাচনে প্রশাসনকে ‘তুষ্ট’ রাখার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন পরিকল্পনামন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘এটা অহেতুক। কিছু লোকের মন্দ পরিবেশ তৈরিতে আগ্রহ ও ফায়দা আছে। তারা এ ধরনের মন্তব্য করে থাকে।’

‘জনগণকে সেবা করতে হলে আমাদের সেবার লোক বাড়াতে হবে, তাই আমরা করছি। সেবার লোক যারা আছে তাদের বেতন-ভাতা বাড়াই, পদন্নোতি দেই, এটা ভাল কাজ।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d