নির্বাচনের দিন সংঘর্ষে জড়াবে না বিএনপি, ভোট বর্জনের ক্যাম্পেইন শান্তিপূর্ণভাবে চালিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা
নির্বাচনের দিন কোনো ধরনের সংঘর্ষে জড়াবে না বিএনপি। ভোট বর্জনের ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে হরতালসহ আগামী দিনে ঘোষিত সব কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে পালনে সংগঠনের সর্বস্তরে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, নির্বাচনের আগের দিন এবং নির্বাচনের দিন হরতালের ডাক দেবে বিএনপি। তবে এ কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হচ্ছে একতরফা নির্বাচনের প্রতিবাদ জানানো এবং ভোটারদের ভোট দিতে নিরুৎসাহিত করা।
নির্বাচনের দিন বিএনপি সহিংসতা চালাতে পারে সরকারি দলের এমন অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে বিএনপি। দলটির নীতি-কৌশলের সাথে জড়িতরা বলেছেন, ভোট ঠেকানো কিংবা প্রতিহত করা বিএনপির কাজ নয়, বিএনপি ভোট বর্জন করেছে। জনগণও বিএনপির এই আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। সেক্ষেত্রে বিএনপির কোনো ধরনের সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি সৃষ্টির প্রয়োজন নেই। তবে নেতাদের আশঙ্কা, আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নির্বাচনের দিনের পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। আর এর দায় বিএনপির উপর চাপানোর চেষ্টা করা হতে পারে।
জনগণকে ভোটদানে নিরুৎসাহিত করতে গত দুই সপ্তাহ ধরে দেশব্যাপী প্রচারণা চালাচ্ছে দলটি। সরকারের কোনো উসকানিতে পা দিয়ে নির্বাচনের দিনও সর্বোচ্চ সংযম ও ধৈর্য প্রদর্শন করতে চায় তারা। কোনো ধরনের সংঘাত-সংঘর্ষে না জড়াতে ইতোমধ্যে দলটির তৃণমূলে কঠোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিএনপি মনে করছে, নির্বাচনের নামে যে তামাশা, নাটক চলছে-জনগণ সে ব্যাপারে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল। ফলে তারা নির্বাচন বয়কটের যে আহ্বান জানিয়েছে, জনগণ সেটাতে সাড়া দিবে এবং ভোট বর্জনের মধ্য দিয়ে সরকার ও নির্বাচনের প্রতি তাদের চূূড়ান্ত অনাস্থা প্রকাশ করবে।
সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের একদফা দাবিতে গত ১৪ জুলাই থেকে আন্দোলন শুরু করে বিএনপি। আন্দোলনের অংশ হিসেবে গত ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে মহাসমাবেশ ডাকে দলটি। কিন্তু পুলিশের সাথে সংঘর্ষে ওই মহাসমাবেশ পণ্ড হওয়ার পর চার দফায় ৫ দিন হরতাল এবং ১২ দফায় ২৩ দিন অবরোধ কর্মসূচি করে বিএনপি। এরপর ভোটের দিন ঘনিয়ে আসায় জনগণকে ভোট বর্জনের পাশাপাশি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়া হয়। তারপর থেকে জনগণকে ভোটদানে নিরুৎসাহিত করতে দেশব্যাপী গণসংযোগ ও লিফলেট বিতরণ কর্মসূচি চলছে। আজ বৃহস্পতিবার পঞ্চম দফার এই গণসংযোগ কর্মসূচি শেষ হবে।
জানা গেছে, চলমান আন্দোলনের অংশ হিসেবে ভোট বর্জনের আহ্বানে আগামীকাল শুক্রবার ঢাকায় গণমিছিল কিংবা পেশাজীবীদের ব্যানারে সমাবেশ করার চিন্তাভাবনা রয়েছে বিএনপি ও যুগপৎ শরিকদের। বিকল্প হিসেবে গণসংযোগ কর্মসূচির বিষয়টিও বিবেচনায় রয়েছে। তবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের ঘোষিত তফসিলে শুক্রবার সকাল ৮টায় সব ধরনের নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার সময় শেষ হওয়ায় এই কর্মসূচি করতে পারা নিয়ে সংশয় রয়েছে তাদের। অবশ্য ৭ জানুয়ারি ভোট এবং আগের দিন হরতাল দেয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে বিএনপির। তবে সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় শুধু ভোটের দিনও হরতাল দেয়া হতে পারে। তবে এই কর্মসূচিও ভোট বর্জনের আহ্বান এবং একদফা দাবিতে দেয়া হবে। সরকারি কোনো উসকানিতে পা না দিয়ে এই কর্মসূচি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণভাবে পালন করতে তৃণমূলে কড়া নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. আব্দুল মঈন খান বলেন, ভোট ঠেকানো কিংবা ভোট প্রতিহত করা বিএনপির আন্দোলনের লক্ষ্য নয়। বিএনপি এই একতরফা, ডামি নির্বাচন বর্জন করেছে। দেশবাসীকেও এই নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানিয়ে আসছে। এ লক্ষ্যে গণসংযোগমূলক কর্মসূচি পালন করছে। বিএনপি মনে করে, জনগণ ইতোমধ্যে তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়েছে। তিনি আরো বলেন, এই নির্বাচন ঘিরে কী হচ্ছে তা শুধু দেশের জনগণই নয়, আন্তর্জাতিক তথা গণতান্ত্রিক বিশ্বও ওয়াকিবহাল রয়েছে। এটি সরকারের একটি পাতানো নির্বাচন- যেখানে সরকারি দলের প্রার্থীরা, সরকারি দলের সমর্থকরাই অংশ নিচ্ছেন এবং যে যেখানেই ভোট দিক না কেন, নির্বাচনে জয়ী হবে আওয়ামী লীগ। বিএনপি এই নির্বাচনী প্রহসন বর্জন করেছে। বিএনপি ভোট বর্জনের যে আহ্বান জানিয়েছে তা অব্যাহত রাখবে। নির্বাচনের দিন ঘিরে বিএনপি যে কর্মসূচি দিবে সেটিও শান্তিপূর্ণ আহ্বানের মধ্য দিয়ে পালিত হবে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের গত শনিবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, বিএনপি আন্দোলনে ব্যর্থ হয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আতঙ্ক ছড়ানোর পরিকল্পনা করছে। জনগণকে ভোটকেন্দ্রে আসা থেকে বিরত রাখতে তারা প্রয়োজনে লাশ বানিয়ে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারে। এ লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও প্রার্থীদের হত্যার পরিকল্পনা করছে দলটি। এ প্রেক্ষাপটে দলীয় প্রার্থী, নেতাকর্মীসহ সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান তিনি।
বিএনপির নেতারা জানিয়েছেন, ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের কয়েক দিন আগে দেয়া সরকারি দলের সাধারণ সম্পাদকের এই বক্তব্যকে আমলে নিয়েছে তারা। দলটি মনে করছে, এটি নির্বাচন ঘিরে বিএনপিকে নতুন করে ফাঁদে ফেলার একটি প্রচেষ্টা। সে কারণে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের সতর্ক থাকা এবং সরকারি কোনো উসকানিতে পা না দিয়ে সংযত থাকতে কেন্দ্র থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, নির্বাচনে নৌকার পাশাপাশি নানা পরিচয়ে আওয়ামী লীগের লোকেরাই অংশ নিচ্ছেন। বাকি দলগুলোও সরকার ও সরকারি দলের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে নির্বাচন করছে। নির্বাচন ঘিরে ইতোমধ্যে প্রার্থীদের নিজেদের মধ্যে একাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। ভোটের দিন এই সংঘর্ষের ঘটনা আরো বাড়তে পারে। এসব ঘটনার দায় যাতে বিএনপির ওপর চাপাতে না পারে সেজন্য নেতাকর্মীদের সজাগ ও সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
এদিকে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি ঘিরে সংঘটিত নাশকতার ঘটনায় গত রোববার জাতিসঙ্ঘসহ ঢাকায় অবস্থিত বিভিন্ন দূতাবাসে চিঠি দিয়েছে দলটি। ই-মেইলে পাঠানো সাত পৃষ্ঠার এই চিঠিতে সম্প্রতি সংঘটিত অগ্নিসন্ত্রাস ও নাশকতার জন্য সরকারকে দায়ী করা হয়েছে। দলটির দাবি, জনসম্পৃক্ত চলমান আন্দোলন নস্যাৎ করতে সরকারি মদদে বিভিন্ন ঘটনা ঘটিয়ে বিএনপির ওপর তার দায় চাপানো হচ্ছে। তবে এসব অগ্নিসন্ত্রাস ও নাশকতার ঘটনা প্রকৃতপক্ষে কারা ঘটিয়েছে, তা দেশবাসী এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ওয়াকিবহাল বলে দাবি বিএনপির।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শীর্ষনেতা ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক সার্বিক বিষয়ে বলেন, বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে দাবিতে আন্দোলন করছে। এই দাবি অত্যন্ত ন্যায্য এবং গণদাবি। ফলে বিরোধী দলগুলো কেন সহিংসতা ঘটাবে? বিরোধী দলগুলো অত্যন্ত সচেতনভাবে সহিংসতা পরিহার করে জনগণকে সম্পৃক্ত করে পুরোপুরি অহিংস আন্দোলন অব্যাহত রেখেছে। কর্মসূচি ঘিরে যে বিচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত ঘটনা ঘটেছে, রাষ্ট্রীয় মদদে সেটা ঘটেছে। এরপর বিএনপিসহ বিরোধী দলগুলোর ওপর তার দায় চাপিয়ে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে চিহ্নিত করার যে অপতৎপরতা, শুরু থেকেই আমরা এই সুযোগ সরকারকে দেইনি।
তিনি আরো বলেন, সরকার ও সরকারি দল আন্দোলনের শুরু থেকেই এমনকি ৭ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনের আগেও বিরোধী দলকে উসকানি ও নাশকতার ফাঁদে ফেলার অপতৎপরতা চালিয়েছে। কিন্তু বিরোধী দলগুলোর অহিংস আন্দোলনে সেটা পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। এটাতে সরকারের ওপর বড় ধরনের রাজনৈতিক চাপের জায়গা তৈরি হয়েছে। সরকারি উসকানি, হামলা-মামলা, নির্যাতন-নিপীড়ন উপেক্ষা করে সর্বোচ্চ সংযম দেখিয়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আমরা জনগণকে জাগিয়ে তুলতে পেরেছি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সেটা লক্ষ রাখছেন। ফলে বিরোধী দলগুলোর আন্দোলনের প্রতি নিশ্চয় তাদের নৈতিক সমর্থন রয়েছে। তা ছাড়া আগামী ৭ জানুয়ারি বিরোধী দলবিহীন একতরফা ‘তথাকথিত’ নির্বাচন নিয়েও পশ্চিমা বিশ্বের মনোযোগ রয়েছে। ফলে আমাদের ধারণা, একতরফা ভোটের পরপরই নির্বাচন ও সরকারের ব্যাপারে তারা তাদের মনোভাব-অবস্থান পরিষ্কার করবেন। সেদিক থেকে মনে করি, এটা বিরোধী দলগুলোর জন্য নৈতিক বিজয়।