নির্বাচনের পর জোরদার হবে অর্থনৈতিক সংস্কার
বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের মধ্যেও দ্বিতীয় কিস্তির ঋণের জন্য বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) বেশির ভাগ শর্ত পূরণ করেছে। তবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণ এবং কর আহরণের মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। এ ক্ষেত্রে অব্যাহতি দিয়ে দ্বিতীয় কিস্তির প্রায় ৬৯ কোটি ডলার ছাড় করেছে বহুজাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানটি। গতকাল শুক্রবারই সেই অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা হয়েছে। জাতীয় নির্বাচন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধসহ বহিঃস্থ আঘাতের কারণ দেখিয়ে সরকার এ অব্যাহতি নিতে পেরেছে। তবে নির্বাচনের পর নতুন বছরে অর্থনীতিতে সংস্কার জোরদারের অঙ্গীকার করা হয়েছে।
দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়, অপূর্ণ থাকা শর্ত পূরণের জন্য অব্যাহতি এবং লক্ষ্যমাত্রার সংশোধন চেয়ে সরকার আইএমএফকে গত মাসে যে চিঠি দিয়েছে, তাতে সংস্কার ত্বরান্বিত করার জোরালো প্রতিশ্রুতি রয়েছে। ঋণ অনুমোদনের পর প্রথম পর্যালোচনা-সংক্রান্ত বাংলাদেশ কান্ট্রি রিপোর্টে আইএমএফ ওই চিঠি প্রকাশ করেছে। অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার স্বাক্ষরিত চিঠিতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এতে জ্বালানি খাতের ভর্তুকি কমানোর অঙ্গীকারের মধ্যে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনার কথা জানানো হয়েছে। এ ছাড়া আগামী মার্চের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে নির্দিষ্ট সময় পরপর জ্বালানি তেলের ফর্মুলাভিত্তিক দর সমন্বয় করার অঙ্গীকার রয়েছে। চিঠির সঙ্গে ২০২৪-২৬ সাল মেয়াদে অর্থনৈতিক ও আর্থিক নীতিসংক্রান্ত স্মারক সংযুক্ত রয়েছে।
কান্ট্রি রিপোর্ট প্রকাশের আগে শুক্রবার সকালে বাংলাদেশ বিষয়ে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলন করে আইএমএফের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগ। আইএমএফ মিশনপ্রধান রাহুল আনন্দ এ সময় বলেন, ঋণ কর্মসূচির আওতায় সংস্কার পদক্ষেপ সঠিক পথে রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নীতি সুদহার বাড়িয়েছে। গ্রাহক পর্যায়ে সুদের হার বাড়ানোর পদক্ষেপ নিয়েছে। ঋণের সুদহার এখন ১১ শতাংশে পৌঁছেছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির আরও সংকোচন প্রয়োজন। অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ বাড়ানোর মাধ্যমে রিজার্ভ বাড়াতে বিনিময় হার অধিকতর নমনীয় হতে হবে।
এক প্রশ্নের উত্তরে রাহুল আনন্দ বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর আইএমএফ কোনো মন্তব্য করে না। অবশ্য সংস্থাটির রিপোর্টে বলা হয়েছে, জানুয়ারিতে বাংলাদেশের নির্বাচন অর্থনীতিতে অনিশ্চয়তা বাড়াতে পারে। আইএমএফ ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়াকে বিবেচনায় নেয় কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, তারা এ সমস্যা প্রতিরোধে বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করছে।
আইএমএফের রিপোর্টে বলা হয়েছে, বাংলাদেশকে গত জানুয়ারিতে যখন ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়, তখনকার তুলনায় নিকট মেয়াদের দৃশ্যকল্প দুর্বল। যথাযথ নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে অর্থনীতির পরিস্থিতির ধীরে ধীরে উন্নতি হবে। মুদ্রানীতির আরও সংকোচন হলে বেসরকারি খাতে চাহিদা কম থাকবে। তবে রপ্তানির ওপর ভর করে ৬ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে। আমদানি ব্যয় মেটানোর বিবেচনায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিকট মেয়াদে কিছুটা কমলেও মধ্য মেয়াদে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। মূল্যস্ফীতি অর্থবছর শেষে কমে ৭ দশমিক ২ শতাংশে দাঁড়াবে।
রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা কমলো
বাংলাদেশ গত জুন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংরক্ষণের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারায় আইএমএফের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে যে অব্যাহতি চেয়েছিল, তা অনুমোদন করেছে সংস্থাটির পর্ষদ। একই সঙ্গে ডিসেম্বর শেষে রিজার্ভ সংরক্ষণের সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ডিসেম্বর শেষে নিট রিজার্ভ থাকার কথা ছিল ২৬ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। সংশোধিত লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১৭ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার। জুন শেষে কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। তবে এ ক্ষেত্রে ডিসেম্বরের লক্ষ্যমাত্রা সংশোধন করা হয়নি।
আইএমএফের রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশ পরিমাণগত পারফরম্যান্স ক্রাইটেরিয়ার তিনটি বিষয়ের মধ্যে রিজার্ভ ছাড়া বাকি দুটি অর্জন করেছে। এ দুটি শর্ত সরকারের বাজেট ঘাটতি এবং সরকারের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ-সংক্রান্ত।
চারটি ইন্ডিকেটিভ টার্গেটের মধ্যে কর সংগ্রহ ছাড়া বাকি তিনটি পূরণ হয়েছে। এ তিনটি সরকারের সামাজিক ব্যয়, মূলধনি বিনিয়োগ এবং মুদ্রা সরবরাহ-সংক্রান্ত শর্ত। এ ছাড়া ব্যাংক কোম্পানি সংশোধন, রাজস্ব বাড়ানোর পরিকল্পনা প্রণয়ন, সুদহার করিডোর ব্যবস্থা চালুসহ কাঠামোগত সংস্কারের বেশির ভাগ শর্ত পূরণ করা হয়েছে। কাঠামোগত বেঞ্চমার্ক-সংক্রান্ত সাতটি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ছয়টি পূরণ করেছে। শুধু আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইন সংশোধন নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সংসদে উত্থাপন করা হয়নি।
লক্ষ্যমাত্রা পূরণ ও আইএমএফের পর্যবেক্ষণ সম্পর্কে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দুটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি। তবে আইএমএফ হয়তো নির্বাচন সামনে রেখে ছাড় দিয়েছে। মনে রাখতে হবে, আইএমএফ বারবার ছাড় নাও দিতে পারে। বহুজাতিক ঋণদানকারী ব্যাংকটির সাবেক এ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, মৌলিক কিছু শর্ত পূরণ করতে না পারলে আইএমএফ তার কর্মসূচি স্থগিতও করতে পারে।
আহসান এইচ মনসুর মনে করেন, বর্তমানে নিট রিজার্ভ আছে ১৫ বিলিয়ন ডলারের মতো। ডিসেম্বরের জন্য লক্ষ্যমাত্রা কমানো হলেও তা পূরণ করতে বাড়াতে হবে অন্তত ২ বিলিয়ন ডলার, বর্তমান পরিস্থিতিতে যা অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। খেয়াল রাখতে হবে, আইএমএফের ঋণ গ্রস রিজার্ভে যোগ হলেও তা নিট রিজার্ভের অংশ নয়। কারণ এটি একই সঙ্গে সম্পদ ও দায়।
অর্থমন্ত্রী ও গভর্নরের চিঠি এবং স্মারকে যা আছে
আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের কাছে দেওয়া অর্থমন্ত্রী ও গভর্নরের চিঠির প্রথমে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সারমর্ম উপস্থাপন করা হয়েছে। বলা হয়েছে, বহিঃস্থ আঘাত চলমান থাকায় বাংলাদেশকে নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে, যা সামষ্টিক অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে বাধা সৃষ্টি করছে। রপ্তানিতে টেকসই পরিস্থিতির মধ্যে আমদানি কমানোর মাধ্যমে দেশের চলতি হিসাবে ঘাটতি কমানো গেছে। কিন্তু অভূতপূর্বভাবে আর্থিক হিসাবে ঘাটতির কারণে রিজার্ভ বাড়ানো যাচ্ছে না। এর সঙ্গে বহিঃস্থ আঘাত এবং টাকার মূল্যমান কমে যাওয়ায় মূল্যস্ফীতি উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও আইএমএফের কর্মসূচি বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সময়মতো বাস্তবায়ন হচ্ছে। নির্বাচন, বিশ্ববাজারে উচ্চ পণ্যমূল্য এবং বৈশ্বিক আর্থিক পরিস্থিতির কারণে আগামী কয়েক মাস চ্যালেঞ্জ অব্যাহত থাকলেও সরকার আশা করছে, ধীরে ধীরে পরিস্থিতির উন্নতি হবে।
চিঠিতে বলা হয়, সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা রক্ষায় সরকার প্রয়োজনীয় নীতি পদক্ষেপ নেবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ইতোমধ্যে মুদ্রানীতি সংকোচনের মাত্রা বাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়া বন্ধ করা হয়েছে। সমন্বিত বিনিময় হার চালু করা হয়েছে এবং অধিকতর বাজারমুখী হয়েছে। বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়েছে। মুদ্রানীতির কাঠামো আরও আধুনিক করা হবে। আর্থিক খাতের ঝুঁকি কমানোর পাশাপাশি পুঁজিবাজারের উন্নয়নে পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বিনিয়োগ পরিবেশের উন্নতি ঘটানো হবে।
চিঠির সঙ্গে সংযুক্ত স্মারকে বলা হয়েছে, রাজস্ব আয় বাড়াতে আগামীতে করছাড় বা অব্যাহতি আরও কমানো হবে। করের আওতা বাড়াতে করহারের কাঠামো সহজ করা হবে। বাজেটের ওপর ভর্তুকির চাপ আরও কমানো হবে। তেলের দাম বাড়ানোর কারণে গত অর্থবছরে বিপিসিকে বাজেট থেকে কোনো সহায়তা দেওয়ার প্রয়োজন হয়নি। এ ছাড়া সার, গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়িয়ে বাজেটে ভর্তুকির চাপ কমানো হয়েছে। আগামীতে জ্বালানি পণ্যে সব ধরনের কাঠামোগত ভর্তুকি বন্ধের পরিকল্পনা রয়েছে এবং নির্দিষ্ট সময় পরপর ফর্মুলাভিত্তিক দর সমন্বয়ের দিকে যাবে সরকার। এ বিষয়ক প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে এবং আগামী মার্চের মধ্যে বাস্তবায়ন করা হবে।
দ্বিতীয় কিস্তি জমা বাংলাদেশ ব্যাংকে
গতকাল রিজার্ভে যোগ হয়েছে আইএমএফের ৬৮৯.৮৩ মিলিয়ন ও এডিবির ৪০০ মিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মেজবাউল হক এ তথ্য জানান। এতে রিজার্ভ ২০ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে। গত বুধবার রিজার্ভ ছিল ১৯.১৭ বিলিয়ন ডলার। তবে আইএমএফ ও এডিবির ঋণের টাকা যোগ হওয়ার পর রিজার্ভ কত হয়েছে তা দু-এক দিন পরে জানা যাবে বলে মুখপাত্র মন্তব্য করেন। এর আগে গত ২ ফেব্রুয়ারি প্রথম কিস্তিতে আইএমএফের ৪৪৭.৮ মিলিয়ন ডলার ঋণ পেয়েছিল বাংলাদেশ।