নির্বাচনের সময় ঘোষণায় মিশ্র প্রতিক্রিয়া

জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে আসছে এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় নির্বাচন হবে বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। শুক্রবার সন্ধ্যায় প্রধান উপদেষ্টার ভাষণ প্রচারের পর রাজনৈতিক দলগুলো এই সময়সীমা নিয়ে নানা প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। বিএনপিসহ সমমনা অনেক দল ডিসেম্বরে নির্বাচন চায় বলে আগে থেকেই বলে আসছিল। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার পর তারাও জানিয়েছে, ঘোষিত সময় নির্বাচনের জন্য উপযোগী নয়। এ সময়ের মধ্যে বিচার, সংস্কার, জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্র এবং ভোটের সমতল মাঠ তৈরি হলে রোডম্যাপ অনুযায়ী নির্বাচন সম্ভব হবে বলে জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। ওদিকে, এপ্রিলের প্রথমার্ধের মধ্যে যদি জুলাই সনদ, জুলাই ঘোষণাপত্র ও সংস্কার বাস্তবায়নের ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয় তাহলে ঘোষিত এ সময়ে নির্বাচনে আপত্তি নেই বলে জানিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি। এ ছাড়া, এপ্রিলে ঘোষিত নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর যেমন নানা প্রশ্ন রয়েছে, তেমনি আবার কোনো কোনো রাজনৈতিক দল এটাকে স্বাগতও জানিয়েছে।
শুক্রবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনসংক্রান্ত চলমান সংস্কার কার্যক্রম পর্যালোচনা করে আমি আজ দেশবাসীর কাছে ঘোষণা করছি যে আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো একটি দিনে অনুষ্ঠিত হবে। এই ঘোষণার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন উপযুক্ত সময়ে আপনাদের কাছে নির্বাচনের বিস্তারিত রোডম্যাপ প্রদান করবে।’ এই ভাষণের মধ্যদিয়ে গণতন্ত্র এবং নির্বাচনের পথ আরও প্রশস্ত হয়েছে বলে মনে করছে কোনো কোনো দল ও সংগঠন। আবার কোনো দল বলছে এই ঘোষণা সংস্কার ও জাতীয় সনদ, নির্বাচন এবং গণহত্যার বিচার অনুষ্ঠানের গণ-অভ্যুত্থানের অভিপ্রায় পূরণের লক্ষ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। তবে, এপ্রিলে জাতীয় নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত সময় নয় বলে দাবি করেছে কোনো কোনো দল। এপ্রিলে নির্বাচন কেন, ডিসেম্বরে নয় কেন- সরকারের কাছে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল এর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা চেয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পরপরই বিএনপি’র সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্যরা জরুরি বৈঠকে বসেন। বৈঠক শেষেই এক বিবৃতিতে দলের সিদ্ধান্ত জানানো হয়। এতে বলা হয়, এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন হলে একদিকে আবহাওয়ার সংকট এবং অন্যদিকে রমজানের মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণা ও কার্যক্রম এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে যা নির্বাচনকে পিছিয়ে দেয়ার কারণ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। কেন ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব নয়, এমন কোনো সুনির্দিষ্ট কারণ প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে উল্লেখ নেই বলেও মনে করছে দলটি। একইসঙ্গে রমজান, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বা সমপর্যায়ের পরীক্ষা এবং আবহাওয়াসহ নানা কারণ বিবেচনায় ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রস্তাব পুনর্ব্যক্ত করছে বিএনপি।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, যে সময়টি (এপ্রিল মাস) নির্ধারণ করা হয়েছে, সেই সময়টি বাংলাদেশে নির্বাচনের জন্য সঠিক সময় নয়। এপ্রিল মাসে প্রচণ্ড গরম, ঝড়-বৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকবে, ওই সময়টি রোজার পরে পরেই, পাবলিক পরীক্ষা আছে। সময়টা খুব চিন্তা করে দেয়া হয়েছে বলে আমাদের কাছে মনে হয় না। আমরা মনে করি যে, ডিসেম্বরই নির্বাচন হওয়া সম্ভব এবং সেটাই জাতির জন্য সবচেয়ে উপযোগী হবে।
ওদিকে, নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করায় সন্তোষ প্রকাশ করেছে জামায়াতে ইসলামী। দলটি বলছে, ‘ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো একটি দিনে অনুষ্ঠিত হবে।’ প্রধান উপদেষ্টার এই ঘোষণায় জাতি আশ্বস্ত হয়েছে এবং ঘোষিত সময়ের মধ্যেই একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান করার ব্যাপারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন বলে জাতি আশা প্রকাশ করছে। একইসঙ্গে জাতির তীব্র আকাঙ্ক্ষা সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন- এই তিনটি বিষয়ের ভিত্তিতে এবং ‘জুলাই সনদ’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বাংলাদেশকে একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবে বলেও প্রত্যাশা দলটির।
জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমান বলেন, জাতি যেনতেন নির্বাচন চায় না। বিচার, সংস্কার, জুলাই সনদ ও জুলাই ঘোষণাপত্র এবং ভোটের সমতল মাঠ তৈরি হলে রোডম্যাপ অনুযায়ী নির্বাচন সম্ভব হবে। পরপর তিনবার মানুষ ভোট দেয়ার কোনো সুযোগ পায়নি। এবার নতুন ভোটার যুব সমাজকে ভোটের সুযোগ করে দিতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা আমাদের কোনো সহযোগিতা চাইলে আমরা সহযোগিতা করবো। তবে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য দেশের সংকট দূর করা খুবই জরুরি।
অন্যদিকে, আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধের মধ্যে যদি জুলাই সনদ, জুলাই ঘোষণাপত্র ও সংস্কার বাস্তবায়নের ব্যাপারে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া হয় তাহলে ঘোষিত এই সময়ে নির্বাচনের বিষয়ে তাদের পক্ষ থেকে কোনো আপত্তি নেই এনসিপি, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পরে গণতন্ত্র এবং নির্বাচনের পথ আরও প্রশস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে নাগরিক ঐক্য, জাতীয় সনদ ও নির্বাচন প্রশ্নে গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি বলে মনে করেছে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, এপ্রিল জাতীয় নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত সময় নয় বলে জানিয়েছে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, এপ্রিলে নির্বাচন হওয়ার কথাটি এপ্রিল ফুল হতে পারে বলে মনে করছে ১২ দলীয় জোট। ওদিকে, এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচনের সময় ঘোষণা করে অস্থিরতা প্রশমিত করায় প্রধান উপদেষ্টাকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানিয়েছে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। তবে, নির্বাচনের ঘোষণা পূর্ববর্তী প্রস্তাব ও এ সংক্রান্ত পর্যালোচনার সঙ্গে না মিললেও তার ওপর আস্থা রেখেছে এবি পার্টি এবং আবহাওয়াজনিত কারণে এপ্রিল মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠানে কিছু সমস্যা তৈরি হতে পারে বলেও আশঙ্কা করছে দলটি। এ ছাড়া, অধিকাংশ দল ও জনগণের মতকে উপেক্ষা করে বিশেষ দল-গোষ্ঠীর স্বার্থে এপ্রিলে নির্বাচন ঘোষণার মধ্যদিয়ে সরকার নিরপেক্ষতা হারিয়েছে বলে মনে করছে বাম গণতান্ত্রিক জোট।
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, দেশে রাজনীতি ও নির্বাচন প্রসঙ্গে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণের পরে সেই উত্তাপ প্রশমিত হবে। নির্বাচন নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছিল কেন প্রধান উপদেষ্টা নির্বাচনের দিনক্ষণ স্পষ্ট করে ঘোষণা করছেন না। তবে, শুক্রবার তার জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণের পরে গণতন্ত্র ও নির্বাচনের পথ আরও প্রশস্ত হয়েছে।
ওদিকে, ডিসেম্বরে নির্বাচনের পক্ষে দলগুলো জানিয়েছে, এপ্রিল মাস রোজার মাস, রোজ শেষ হবে, ঈদ শেষ হবে, এর কয়েকদিন পরে নির্বাচন। রোজায় প্রার্থীরা প্রচারণা করতে পারবেন না, ইফতার পার্টি করতে হবে। এজন্য প্রার্থীদের ব্যয় দ্বিগুণ হবে। এ ছাড়া, ওই সময়ে প্রচণ্ড গরম থাকবে আবহাওয়া, ঝড়-বৃষ্টিও হবে- এজন্য জনসভায় লোকজন আসবে না এবং পরীক্ষাও রয়েছে। এজন্য এপ্রিল মাসকে নির্বাচনের জন্য তারা উপযুক্ত সময় মনে করছে না।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, প্রধান উপদেষ্টার ভাষণে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ সম্পর্কে অধিকাংশ রাজনৈতিক দল ও জনগণের মতামত ও আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটেনি, বাস্তবে নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ সম্পর্কে জনদাবি উপেক্ষিতই হয়েছে। ভাষণে ডিসেম্বরে কেন জাতীয় নির্বাচন করা যাবে না তার যেমন সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই, তেমনি জাতীয় নির্বাচন কেন আগামী বছরের এপ্রিলে নিতে হবে তারও গ্রহণযোগ্য ও যুক্তিগ্রাহ্য কোনো কারণ উল্লেখ নেই।