Bangladesh

নির্বাচন কমিশন শুধুই দেখছে

জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরও থেমে নেই বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের ধরপাকড়। প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে সরকারবিরোধী দলের নেতাকর্মীদের। এদের অনেকেই গ্রেপ্তার হচ্ছেন পুরনো মামলায় অথবা চলমান আন্দোলনকে কেন্দ্র করে। গ্রেপ্তার এড়াতে কেউ হয়েছেন ঘরছাড়া। এ ছাড়া রাজধানী ও দেশের বিভিন্ন জেলায় বিএনপি-জামায়াত ও বামপন্থি নেতাকর্মীরা হেলমেটধারী ও মুখ-ঢাকা দুর্বৃত্তদের হামলার শিকার হচ্ছেন। ফলে নির্বাচনী পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

যদিও পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, যানবাহনে আগুন ও সহিংসতার মামলা বা সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতেই তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বিরোধী পক্ষের নেতারা বলেন, নির্বাচন কমিশন একদিকে বিএনপিসহ বিরোধী দলকে নির্বাচনে আসার আহ্বান জানাচ্ছে। আবার অন্যদিকে সরকার হামলা-মামলা দিয়ে হয়রানি করছে। মূলত একতরফা নির্বাচন করতেই তফসিলের পরও বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও সাজা দেওয়া হচ্ছে।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২ অনুসারে তফসিল ঘোষণার পরপরই শুরু হয় ‘নির্বাচন-পূর্ব সময়’। নির্বাচন শেষে ফলাফলের সরকারি গেজেট প্রকাশ পর্যন্ত এই ‘নির্বাচন-পূর্ব সময়’ বহাল থাকবে। এ সময়ে সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদ এবং গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২-এর ৫(২) অনুচ্ছেদ কার্যকর হবে।

সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা সব নির্বাহী কর্তৃপক্ষের অবশ্যকর্তব্য। আর গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ-১৯৭২-এর ৫(২) ধারায় বলা আছে, নির্বাচন কমিশন যেকোনো ব্যক্তি বা কর্তৃপক্ষকে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য প্রয়োজনীয় যেকোনো দায়িত্ব পালনের বা সহায়তা প্রদানের নির্দেশ দিতে পারবে।

বিশ্লেষকদের মতে, তফসিলের পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসন ইসির অধীনে চলে আসে বলা হলেও তা সঠিক নয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসন সব সময় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অধীনেই থাকে। পুলিশ প্রশাসন নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করবে নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা মেনে। পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবে সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হয়ে এবং আদালতের সমন পালন করবে আদালতের হয়ে।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘এখানে নির্বাচন কমিশনের সান্ত¡না বক্তব্য দেওয়া ছাড়া আইনি কোনো কিছু করার অবকাশ নেই। নির্বাচন কমিশনের কাছে কেউ অভিযোগ নিয়ে এলে তারা বলবে দেখছি, দেখব বা পুলিশকে বলবে কোনো হয়রানিমূলক মামলা করা যাবে না। পুলিশও বলবে, আমরা কাউকে হয়রানিমূলক মামলা দিচ্ছি না।’ তিনি মনে করেন, একটাই সমাধান, তা হলো নির্বাচন কমিশন, সরকার, বিরোধী দল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী একটা সমঝোতায় আসা। তবে সেটারও আপাতত কোনো লক্ষণ নেই।

তফসিলের পর কি গ্রেপ্তার করা যাবে : গত ১৬ অক্টোবর নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর বলেছেন, তফসিল ঘোষণার পরে কোনো ধরনের রাজনৈতিক হয়রানি যেন না হয়। তবে কারও বিরুদ্ধে যদি কোনো অভিযোগ থাকে, যদি গ্রেপ্তারযোগ্য অভিযোগ থাকে অথবা আদালতের নির্দেশে গ্রেপ্তার করতে পারবে। রাজনৈতিক কারণে কাউকে যেন হয়রানি না করে। গ্রেপ্তার যদি করতেই হয় সেটা যেন তফসিলের আগেই করা হয়।

তিনি বলেন, তফসিল ঘোষণা করার পর কাউকে গ্রেপ্তার করলে হস্তক্ষেপ করবে নির্বাচন কমিশন। তফসিলের আগে মামলা নেই, এমন কাউকে গ্রেপ্তার করা হলে তাহলে তারা সেটা বিচার-বিশ্লেষণ করবেন। সেই হিসেবে সরকারের প্রতি কোনো বক্তব্য বা পরামর্শ থাকলে দেবেন।

দেশের বিভিন্ন স্থানে হেলমেট পরে, মুখে গামছা বেঁধে বিএনপি-জামায়াত কর্মীদের ওপর হামলা, তুলে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনায় কাউকে শনাক্ত করার খবর পাওয়া যায়নি। নওগাঁয় এ রকম হামলায় বিএনপির এক নেতা নিহত হয়েছেন। এর মধ্যেই গত মঙ্গলবার সকালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও রাতে বিএনপি নেতা সিলেট নগরীর সাবেক মেয়র আরিফুল হকের বাড়িতে ককটেল হামলা হয়। এর আগে যশোরে বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক অনিন্দ্য ইসলাম অমিতের বাড়িতে ককটেল হামলা হয়। বিএনপি-জামায়াত ছাড়াও বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতাকর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছে।

গত ১৫ নভেম্বর তফসিল ঘোষণার পর এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ১৭৫ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানানো হয় বিএনপির পক্ষ থেকে। তারা জানায়, মামলা হয়েছে ৯৮টি। এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ১১ হাজার ৫২০ জনকে।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, পুলিশ, র‌্যাব বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বাড়িঘরে অভিযান চালাচ্ছে। বিএনপি নেতাকর্মীদের তুলে নিয়ে যাওয়ার পর থেকে নিখোঁজ ব্যক্তিদের কারাগারে খুঁজে বেড়াচ্ছেন স্বজনরা।

তিনি দাবি করেন, গত ২৮ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত সারা দেশে বিএনপি এবং সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোর ১৩ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সারা দেশে বিএনপির প্রায় ২ কোটি নেতাকর্মী দিনের পর দিন ঘরছাড়া।

গত ৪০ দিনে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় করা ২৬টি মিথ্যা মামলায় কথিত বিচার কার্যক্রমের নামে বিএনপির ৪১৫ নেতাকর্মীকে সাজা দিয়েছে ঢাকার আদালত বলেও দাবি করেন রিজভী। তিনি বলেন, ‘এখন গায়েবি মামলার মতো গায়েবি সাজা দেওয়া হচ্ছে। এমনকি মৃত ব্যক্তিকেও সাজা দেওয়া হচ্ছে।’

বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতা বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, ‘এই নির্বাচন কমিশন যে নিরপেক্ষ নয় তার প্রমাণ আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে দলীয় মনোনয়ন ফরম নিতে গিয়ে নৌকার পোস্টারসহ মিছিল হলেও তারা চুপ ছিল। অথচ সেখানে আচরণবিধি লঙ্ঘন হয়েছে। তারা আরপিওর নতুন ব্যাখ্যা দিচ্ছে। আসলে এই নির্বাচন কমিশনের পক্ষে অনুকূল নির্বাচনী পরিবেশ ও সব দলের জন্য সমান সুযোগ তৈরি করা সম্ভব নয়।’

গত ১৫ নভেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা দেয় নির্বাচন কমিশন। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ৭ জানুয়ারি ভোট অনুষ্ঠিত হবে।

তফসিল ঘোষণার পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিসহ বেশ কিছু দল নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। অন্যদিকে তফসিল বাতিলের দাবিতে বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি জোট আন্দোলন করে আসছে। তাদের দাবি, বর্তমান সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে এবং নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে হবে।

গত ১৬ নভেম্বরে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়াল বিবাদমান রাজনৈতিক দলগুলোকে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, নির্বাচন কমিশন নির্বাচনে সব দলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাকে সর্বদা স্বাগত জানাবে। পারস্পরিক প্রতিহিংসা, অবিশ্বাস ও অনাস্থা পরিহার করে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান অসাধ্য নয়।

সংলাপের বার্তা দেওয়া হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকেও। কিন্তু আওয়ামী লীগ বা বিএনপি কোনো পক্ষই তাতে সাড়া দেয়নি।

তবে দেরিতে হলেও বিএনপি যদি ভোটে ফিরতে চায়, তাদের জন্য তফসিল পরিবর্তনের বিষয়টি বিবেচনার কথা বলেছেন নির্বাচন কমিশনার রাশেদা সুলতানা। তিনি বলেন, ‘আমার জানা মতে আগেও তারা একটু পরেই নির্বাচনে এসেছিলেন এবং সুযোগটা পেয়েছিলেন। এবারও তারা যদি ফিরতে চান, কীভাবে কী করা যাবে নিশ্চয়ই আমরা আলোচনা করব। তারা সিদ্ধান্ত নিলে, আসতে চাইলে অবশ্যই আমরা ওয়েলকাম করব।’

তিনি বলেন, ‘তারা যদি আসেন আমরা কমিশনাররা বসব, আইনকানুন দেখব। তারপর যেটা সিদ্ধান্ত হয়, হবে। অগ্রিম কিছু বলতে পারব না। আমরা তো চাই সব দল এসে একটা সুন্দর নির্বাচন হোক।’

তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা ফেরানোর দাবিতে ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়েও বিএনপি দ্বিধায় ছিল। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে তাদের আলোচনা হয়। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নামে নতুন জোট গড়ে বিএনপি ভোটে অংশ নেয়। তবে সব দলের অংশগ্রহণে একাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলেও ব্যাপক কারচুপির অভিযোগ ওঠে। বিএনপিসহ সমমনা দলগুলো ভোটের দিন দুপুরের পর থেকে নির্বাচন বর্জন করে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button