Hot

নির্বাচন ছিল একপক্ষীয় পাতানো, অনুঘটক ইসি

এবারের সংসদ নির্বাচনকে একপক্ষীয় ও পাতানো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। দুর্নীতিবিরোধী সংস্থাটি বলেছে, এবারের নির্বাচন অবাধ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়নি। এ ধরনের ভোট দেশের গণতন্ত্র ও ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক নির্বাচনের জন্য অশনিসংকেত। একে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার চেতনা ও স্বপ্নের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হিসেবেও অভিহিত করেছে টিআইবি।

গতকাল বুধবার রাজধানীর ধানমন্ডিতে টিআইবির কার্যালয়ে ‘দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রক্রিয়া ট্র্যাকিং’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলা হয়। এতে নির্বাচন নিয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান।

দৈবচয়নের ভিত্তিতে ৭ জানুয়ারির ভোটের ২৯৯টি আসনের মধ্যে টিআইবি আটটি বিভাগের ৫০টিকে গবেষণা প্রতিবেদনে তুলে ধরেছে। পাশাপাশি কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশনের দায়িত্ব নেওয়ার পর আইন ও বিধির সংস্কার, সীমানা পুনর্নির্ধারণ, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধনসহ নির্বাচনবিষয়ক বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরা হয় এই সংবাদ সম্মেলনে।

ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার নামে কৌশলে একতরফা নির্বাচনের এজেন্ডা বাস্তবায়নের অন্যতম অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে। অন্য রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও প্রশাসনও একই এজেন্ডার সহায়ক ভূমিকায় ছিল।

টিআইবির পক্ষ থেকে বলা হয়, ভোট প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক দেখাতে নিজ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী দেওয়া হলেও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ছিল না ২৪১ আসনের ভোট। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা যেখানে শক্তিশালী ছিল, সেই আসনগুলোয় প্রতিযোগিতা ছিল অসুস্থ ও সহিংস। নির্বাচনে শেষের এক ঘণ্টায় ১৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ ভোটসহ মোট ৪১ দশমিক ৮ শতাংশ ভোট পড়া বিতর্কের জন্ম দিয়েছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি।

৫০ আসনের ওপর গবেষণা চালানো হলেও নির্বাচনকালে দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি এ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে। গবেষণার সময় হিসেবে গত জুন থেকে চলতি জানুয়ারি পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ের তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ ও প্রতিবেদন প্রণয়ন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নির্বাচনের দিন শতভাগ আসনেই একাধিক অনিয়মের ঘটনা ঘটে। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনায় নিষ্ক্রিয় থাকে। ৫০ আসনের ৮৫ দশমিক ৭ শতাংশ আসনে এ ঘটনা ঘটেছে। সমসংখ্যক আসনে সব দলের প্রার্থীদের জন্য সমানভাবে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়নি। ৭৭ দশমিক ৬ শতাংশ আসনে তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ বা যোগাযোগে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়। প্রতিপক্ষের পোলিং এজেন্টকে কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হয়নি ৭৫ শতাংশ আসনে। সাংবাদিক ও নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের কেন্দ্রে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়েছে ৬১ শতাংশ আসনে।

গুরুতর অনিয়মের মধ্যে টিআইবি পেয়েছে, ভোটারদের জোর করে নির্দিষ্ট মার্কায় ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছে ৫৫ শতাংশ আসনে। বুথ দখল, প্রকাশ্যে সিল ও জাল ভোটের ঘটনা ঘটেছে ৫১ শতাংশ আসনে। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের অনিয়মের অভিযোগের ৫১ শতাংশ তদন্তই করা হয়নি। প্রতিপক্ষের ভোটারদের কেন্দ্রে ঢুকতে দেওয়া হয়নি ৪৯ শতাংশ আসনে। ভোট গণনায় জালিয়াতি হয়েছে প্রায় ৪৩ শতাংশ আসনে। নগদ টাকা বা পরিবহন খরচ ও খাবার দিয়ে ভোট কেনার ঘটনা ঘটেছে ৩৮ শতাংশ আসনে। 

টিআইবির গবেষণায় নমুনা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ৫০ আসনে শতভাগ ক্ষেত্রেই কোনো না কোনো নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। আওয়ামী লীগের শতভাগ প্রার্থী কমপক্ষে একবার হলেও কোনো না কোনো নির্বাচনী আচরণবিধি ভেঙেছেন।

গবেষণায় উঠে আসে, ৫০ শতাংশ ভোটার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে ক্ষমতাসীন দল নানাভাবে বল প্রয়োগ করেছে। ক্ষমতাসীন দলের সভায় না এলে, ভোটকেন্দ্রে না গেলে এবং নির্দিষ্ট প্রতীকে ভোট না দিলে নির্বাচনের পর সাধারণ ভোটারসহ প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের সরকারি সেবা ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির ভাতা বন্ধের হুমকি দেওয়ার ঘটনা রয়েছে। আবার সরকারি কর্মকর্তাদের ক্ষমতাসীন দলের প্রতি আনুগত্য ও পক্ষপাতমূলক কার্যক্রমে অংশ নেওয়াসহ ক্ষমতাসীন দলের সমর্থন ও প্রচারণায় অংশগ্রহণের ঘটনা ঘটেছে।

গবেষণায় দেখা যায়, মোবাইল ফোনে এসএমএস, ফেসবুকে প্রচারণামূলক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের প্রচারণার পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যম বিটিভিকে একচেটিয়া ব্যবহার করে ক্ষমতাসীন দলের প্রচার-প্রচারণা ও সভা-সমাবেশের খবর প্রচার করা হয়েছে। আবার বেসরকারি সংবাদমাধ্যমগুলো হরতাল-অবরোধ-অগ্নিকাণ্ড ও নির্বাচন বর্জনের খবরসহ বিএনপি গণতন্ত্রের জন্য হুমকি– এ বিষয়ক সরকারদলীয় নেতাদের বক্তব্য বেশি প্রচার করেছে। ৫ ডিসেম্বর থেকে ৫ জানুয়ারি পর্যন্ত বিটিভি রাত ৮টার খবরে নির্বাচন সম্পর্কিত সংবাদে ৪৯৩ মিনিট ২৭ সেকেন্ড ব্যয় করেছে। এ বাবদ মোট আর্থিক মূল্য ৪ কোটি ৪২ লাখ ১৫ হাজার ৫০০ টাকা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীবিষয়ক সংবাদ ১১৫ মিনিট ৫১ সেকেন্ড; যার অর্থমূল্য ১ কোটি ৪ লাখ ২৬ হাজার ৫০০ টাকা।

গবেষণায় আরও দেখা যায়, রাজনৈতিক কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা তৈরিসহ বিরোধী দলকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার কৌশল হিসেবে সভা-সমাবেশে বিবিধ শর্ত দেওয়া, নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার ও রাজনৈতিক হয়রানির মামলা দেওয়া, দ্রুততার সঙ্গে বিচার ও সাজা দিতে রাতে বিচারকাজ চালানোর ঘটনা ঘটেছে। তপশিল ঘোষণার আগে বিরোধী দলের সক্রিয় ও নির্বাচনে সম্ভাব্য প্রার্থীসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের নামে নতুন-পুরোনো মামলায় গ্রেপ্তার ও সাজা দেওয়ার কাজে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।

তপশিল ঘোষণার আগে থেকে নির্বাচন পর্যন্ত প্রার্থীদের গড় প্রচারণা ব্যয় ১ কোটি ৫৬ লাখ ৮৩ হাজার ৭৭৭ টাকা, যা নির্বাচন কমিশনের নির্ধারিত ব্যয়সীমার (২৫ লাখ) ছয় গুণ বেশি।

নির্বাচনের বাজেট ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা হলেও খরচ বেড়ে ২ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা হয়েছে, যা একাদশ নির্বাচনের তুলনায় তিন গুণ। টিআইবি বলছে, নির্বাচনী বাজেটের অর্ধেকের বেশি পরিমাণ (৫৪ শতাংশ) অর্থ ব্যয় করা হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জন্য। এ খাতে এত বিপুল পরিমাণ অর্থ বরাদ্দের সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। 

দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা টিআইবির মতে, এ নির্বাচনের ফলে গণতান্ত্রিক অবনমনের অভিজ্ঞতা এবং নির্বাচনী কৌশল ও অভিনবত্ব বিবেচনায় বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ‘টেস্ট কেস’ হিসেবে বিবেচিত হবে।

টিআইবি বলেছে, অংশগ্রহণমূলক ও অবাধ নির্বাচন না হওয়ার প্রধান কারণ হলো, নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে দুই বড় দলের বিপরীতমুখী ও অনড় অবস্থান। এই বিপরীতমুখী ও অনড় অবস্থানকেন্দ্রিক এজেন্ডা বাস্তবায়নের লড়াইয়ে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জিম্মিদশা প্রকট হয়েছে।

টিআইবি তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের নির্বাচনী অঙ্গীকার আরও বেশি অবাস্তব ও কাগুজে-দলিলে পরিণত হওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সংসদে ব্যবসায়ী আধিপত্যের মাত্রাও একচেটিয়া পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, যা রাষ্ট্রীয় কর্মকাণ্ডে ব্যাপকতর স্বার্থের দ্বন্দ্ব ও নীতি-দখলের ঝুঁকি বাড়িয়ে দিয়েছে।

টিআইবি বলেছে, এ নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক অঙ্গন ও শাসন ব্যবস্থার ওপর ক্ষমতাসীন দলের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের চূড়ান্ত প্রাতিষ্ঠানিকতা পেয়েছে এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতার জবাবদিহিহীন প্রয়োগের পথ আরও প্রসারিত হয়েছে।

সংস্থাটি বলেছে, ক্ষমতায় অব্যাহত থাকার কৌশল বাস্তবায়নের একতরফা নির্বাচন সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হয়েছে। নির্বাচনের আইনি বৈধতা নিয়ে কোনো চ্যালেঞ্জ হয়তো হবে না বা হলেও টিকবে না। তবে এ সাফল্য রাজনৈতিক শুদ্ধাচার, গণতান্ত্রিক ও নৈতিকতার মানদণ্ডে চিরকাল প্রশ্নবিদ্ধ থাকবে।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ৬২ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থীর সার্বিক চিত্র হলো– একটা পাতানো প্রতিযোগিতামূলক, অনেক ক্ষেত্রে সহিংস এবং সংঘাতময় নির্বাচন হয়েছে। সার্বিকভাবে এসব আসনে প্রতিযোগিতা হয়েছে। তবে সেটা অসুস্থ প্রতিযোগিতা।

তিনি বলেন, এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার একটি মাত্র ইতিবাচক দিক হচ্ছে, তারা পরস্পরের প্রতি বিষোদ্গার এবং পাল্টা অভিযোগ করায় দুর্নীতি, অনিয়ম, অবৈধতা ইত্যাদি বিষয় যথার্থতা পেয়েছে। অর্থাৎ তারা নিজেরাই নিজেদের সম্পর্কে অভিযোগ করেছেন।

শেষের এক ঘণ্টায় বেশি ভোট পড়া নিয়ে বিতর্কের বিষয়ে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এ বিষয়ে ইসির ব্যাখ্যার কোনো দালিলিক প্রমাণ নেই। পক্ষে-বিপক্ষে বলার কোনো সুযোগ নেই। এটি বিতর্কিত আছে এখনও। তাঁর ধারণা, এটি বিতর্কিতই থেকে যাবে।

অনুষ্ঠানে টিআইবির প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন গবেষণা দলের সদস্য মাহফুজুল হক, নেওয়াজুল মওলা ও সাজেদুল ইসলাম। টিআইবির উপদেষ্টা (নির্বাহী ব্যবস্থাপনা) অধ্যাপক সুমাইয়া খায়ের ও পরিচালক (গবেষণা) মোহাম্মদ বদিউজ্জামান অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto