নিষেধাজ্ঞা ও বর্জন :বাংলাদেশের নির্বাচনের অস্থিরতাপূর্ণ ইতিহাস
১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর থেকে দেশের হাতেগোনা কয়েকটি নির্বাচন ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ বলে বিবেচিত হয়েছে। রবিবার, ১৭ কোটি মানুষের দেশ বাংলাদেশ তার ১২ তম সাধারণ নির্বাচন করছে। কিন্তু সন্দেহপূর্ণ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সহিংসতা এবং প্রতিবাদের একটি দীর্ঘ ইতিহাস সহ একটি দেশে এই নির্বাচনটিও ইতিমধ্যেই বিতর্কের মুখে পড়েছে।
১৯৭১ সাল থেকে বাংলাদেশের ১১টি নির্বাচনের মধ্যে মাত্র ৪টি ‘অবাধ ও সুষ্ঠু’ বলে বিবেচিত হয়েছে। বাকিগুলি সহিংসতা, বিক্ষোভ এবং ভোট কারচুপির অভিযোগে নিমজ্জিত হয়েছে। অতীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলি সাধারণত বিশ্বাসযোগ্য বলে বিবেচিত ফলাফল প্রদান করেছে এবং বিরোধী পক্ষের জন্য জয় নিয়ে এসেছে।
এই বছর, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচন পরিচালনার জন্য নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জন্য বিরোধী দল বাংলাদেশ জাতীয় পার্টির (বিএনপি) দাবি মানতে অস্বীকার করার পর বিএনপি নির্বাচন বর্জন করেছে। ব্যাপক জল্পনা-কল্পনা রয়েছে যে, এই নির্বাচনের মাধ্যমে হাসিনা টানা চতুর্থ এবং সামগ্রিকভাবে পঞ্চম মেয়াদে ক্ষমতাসীন থাকবেন।
তবে, নির্বাচন পরিচালনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলি বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনকে এক চিঠিতে বলেছেন যে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কোনও পূর্ণ পর্যবেক্ষক দল পাঠাবে ন না, কারণ প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করা হবে কিনা, তা যথেষ্ট পরিষ্কার নয়।
এখানে বাংলাদেশের বিতর্কিত নির্বাচনের ইতিহাসের একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরা হল। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের বিচ্ছেদের পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ দেশের প্রথম নির্বাচন পরিচালনা করে। কিন্তু, জয়ের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যাপক জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের নেতাদের অপহরণ করে এবং কিছু নির্বাচনী এলাকায় ব্যালট চুরি করে।
১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংসদে ৩শ’ আসনের মধ্যে ২শ’ ৯৩ আসনে জয়লাভ করে, যা জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল এবং ভাসানি সহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলিকে প্রায় নির্মূল করে দেয়, যারা একটি করে সংসদীয় আসন জিতেছিল। সেই নির্বাচন নতুন দেশে একটি স্বৈরাচারী শাসনের সূচনা করে।
১৯৭৪ সালে শেখ মুজিব সকল বিরোধী দল এবং সংসদের বেশিরভাগ সংবাদদাতাকে নিষিদ্ধ করে বাংলাদেশকে একটি একদলীয় রাষ্ট্রে পরিণত করেন। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয় এবং পরবর্তী দেড় দশকের জন্য বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে।
১৯৭৮ থেকে ১৯৭৯ সালের মধ্যে সাবেক সেনাপ্রধান জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে প্রেসিডেন্ট ও সংসদীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যিনি একটি বহুদলীয় ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং মুজিবুর রহমানের শাসন থেকে দুর্দশাগ্রস্ত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলিকে উদ্ধার করার জন্য প্রশংসিত হয়েছিলেন। সেই নির্বাচনে তার সদ্য প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ দাবি করে যে ভোটে কারচুপি হয়েছে।
১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমানের হত্যার পর ১৫ নভেম্বর সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপি আবার ৬৫ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয়ী হয়। এরপর, সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ১৯৮২ সালের অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা গ্রহণ করেন। ১৯৮৬ সালের ৭ মে সংসদীয় নির্বাচন এবং ১৫ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রধান বিরোধীদের নির্বাচন বর্জনের মধ্য দিয়ে এরশাদের জাতীয় পার্টি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। নির্বাচনে এরশাদ ভোচ কারচুপি করেছিলেন বলে অভিযোগ ছিল।
১৯৮৮ সালে এরশাদের অপসারণের আহ্বানে তীব্র বিক্ষোভের মধ্যে আরেকটি ব্যাপকভাবে সমালোচিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ এবং জিয়াউর রহমানের স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অধীনে বিএনপি একত্রিত হয়ে বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেয়, যার ফলে ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান এরশাদকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে।
১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এবং ভবিষ্যত প্রেসিডেন্ট শাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে সমস্ত প্রধান দল অংশ নেয়। সেই নির্বাচনকে নিরপেক্ষ হিসাবে দেখা হয়েছিল এবং জিয়ার বিএনপি তাতে ১শ’ ৪০টি এবং আওয়ামী লীগ ৮৮টি সংসদীয় আসন লাভ করে। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী বিরোধী দলগুলি নির্ধারিত সাধারণ নির্বাচন বর্জন করে এবং নিবন্ধিত ভোটারদের মাত্র ২১ শতাংশ অংশগ্রহন করে।
১৯৯৪ সালে সংসদীয় উপ-নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগ ও ক্ষমতাসীন বিএনপির মধ্যে বিরোধ চরমে ওঠে। বিরোধীরা দাবি করে যে, ভোটে কারচুপি করা হয়েছে। তারা খালেদা জিয়ার পদত্যাগের জন্য এবং ১৯৯১ সালের মতো একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য চাপ দিতে শুরু করে। তবে এটি ঘটেনি। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে বিএনপি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচনে জয়লাভ করে।
১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারির নির্বাচনের পর বিরোধী সংসদ সদস্যদের ধর্মঘটের পর প্রশাসন মাত্র ১২ দিন স্থায়ী হয়েছিল। সেবছর ১২ জুন একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এটি প্রায় ৭৫ শতাংশ ভোটারদের অংশগ্রহনে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন বলে বিবেচিত হয়েছিল, যেখানে শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১শ’ ৪৬ সংসদীয় আসন লাভ করে প্রথম মেয়াদে জয়ী হন। বিএনপি পেয়েছিল ১শ’ ১৬ আসন।
২০০১ সালের অক্টোবরে আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ববর্তী সংসদ (দেশের ইতিহাসে সপ্তম) প্রথমবারের মতো পাঁচ বছরের মেয়াদ পূর্ণ করার পর জুলাই মাসে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। ৭৫ শতাংশ ভোটারের অংশগ্রহনে বিএনপি ১শ’ ৯৩টি আসনে জয়ী হয়, যেখানে আওয়ামী লীগ কেবল ৬২ আসন লাভ করে।
২০০৬ সালের জন্য নির্ধারিত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি, কারণ বিদায়ী বিএনপি এবং প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য প্রার্থীর বিষয়ে একমত হতে ব্যর্থ হয়েছিল। ২০০৮ সালে রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে সামরিক বাহিনী দেশে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। অবশেষে, সেবছর ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে ৮০ শতাংশ ভোটার অংশগ্রহন করে, যা এ পর্যন্ত দেশের সর্বোচ্চ। এবার আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃতে অন্যান্য বিরোধী দলগুলোর সাথে একটি মহাজোট গঠন করে।
২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী জোট ২শ’ ৩০টি আসনের সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। বিএনপি ও তার সহযোগীরাও একটি জোটও গঠন করেছিল, যা মাত্র ৩০টি আসন পেয়েছিল। সামরিক শাসিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। আওয়ামী লীগ ২০১১ সালের নির্বাচন তত্ত্বাবধানের জন্য একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকান ব্যবস্থা বাতিল করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক বিধান অপসারণ করে। এরপরই বিরোধীদের ওপর দমন-পীড়ন পরিচালিত হয়।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনের আগে বিএনপি নেতা খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দী করা হয় এবং বিরোধী দলের অন্যান্য সদস্যদের প্রতি ব্যাপক সহিংসতার খবর পাওয়া যায়। বিএনপি সহ বিরোধী দলগুলি ভোট বর্জন করে এবং হাসিনার আওয়ামী লীগ সংসদে ২শ’ ৩৪ টি আসন দখল করে।
২০১৮ সালে বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক ভোটিং চালু হয়। কিন্তু বিএনপি এবং অন্যান্য বিরোধী দলগুলি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচনে কারচুপির জন্য অভিযুক্ত করে। বিরোধী দল বিএনপির সদস্য ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং ভোটারদের দমন নির্বাচনকে আবারও কলঙ্কিত করে। সরকার নির্বাচন সংক্রান্ত জাল খবর ছড়ানো বন্ধ করার উছিলায় নির্বাচনের দিন মোবাইল ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেয়।
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টির সাথে একীভূত হয়ে মহাজোট গঠন করে সংসদের ৯০ শতাংশের বেশি আসন লাভ করে। কামাল হোসেন, যিনি দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আসার পর জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বিএনপি জোটের নেতৃত্ব দেন, তিনি মাত্র ৭ আসনে জয়ী হন। হোসেন নির্বাচনের সমালোচনা করে পুনরায় নির্বাচনের আহ্বান জানান।
শেখ হাসিনার ক্ষমতাসীন দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি উপেক্ষা করায় বিএনপি আবারও রোববারের নির্বাচন বয়কট করেছে। দলটি তার দাবির পক্ষে চাপ দেওয়ার জন্য ব্যাপক ধর্মঘট এবং বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিয়েছে, কিন্তু কোন লাভ হয়নি।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে এখন পর্যন্ত নির্বাচনী ব্যবস্থাকে অনেকাংশে প্রভাবিত করতে দেখা গিয়েছে এবং এই নির্বাচনে সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলির পুনরাবৃত্তি ঘটবে বলে মনে করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্ভবত তার পঞ্চম মেয়াদে থাকবেন, এবং তার সরকারকে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী প্রশাসনের তকমা দেবেন।