Hot

নেপথ্যে সাবেক জ্বালানি সচিব মুনিম সিন্ডিকেট, ভুয়া কোম্পানিতে ৯০০ কোটি টাকার কাজ

সাবেক জ্বালানি সচিব আবু হেনা রহমাতুল মুনিমের চাপে কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়া বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ড কোম্পানি লিমিটেডের (বিজিএফসিএল) ৯শ কোটি টাকার প্রকল্পের কার্যাদেশ একটি ভুয়া ও নামসর্বস্ব কোম্পানিকে দেওয়া হয়েছিল। নোয়া (নোটিফেকেশন অব অ্যাওয়ার্ড) ইস্যুর পরপরই পেট্রোবাংলার এক বৈঠকে ফাঁস হয়ে যায় পুরো জাল-জালিয়াতি। কোম্পানিটিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি খাতের একটি বড় বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে দেখিয়ে দরপত্রে অংশ নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিলেন মুনিম সিন্ডিকেট। পরে তদন্তে দেখা গেছে এই নামে কোনো কোম্পানিই নেই যুক্তরাষ্ট্রে। টেকনোস্টিম এনার্জি নামে ওই কোম্পানিটির মালিকানার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন খোদ সাবেক জ্বালানি সচিব রহমাতুল মুনিমের চাচা। যিনি এক সময় তিতাস গ্যাস কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার ও পরবর্তী সময়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক ছিলেন। শুধু তাই নয়, জাল-জালিয়াতির ভয়াবহ এ তথ্য ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর দ্বিতীয় দফায় ফের রহমাতুল মুনিমের চাপে ওই কোম্পানির দেওয়া বিডবন্ডটিও আত্মসাৎ করে নেয় সিন্ডিকেট। পরে ওই টাকা ভাগবাঁটোয়ারা করে নেন তারা সবাই। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে এবং যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।

অভিযোগ আছে-সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই ইলাহীর ঘনিষ্ঠভাজন হওয়ায় এরকম ভয়াবহ জাল-জালিয়াতি ও বিডবন্ড আত্মসাতের সঙ্গে জড়িত থাকার পরও রহমাতুল মুনিমের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উলটো তাকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান করে পুরস্কৃত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা এর কারণ হিসাবে বলেন, এই রহমাতুল মুনিমের মাধ্যমে নসরুল হামিদ সিন্ডিকেট জ্বালানি খাতের শত শত কোটি টাকার প্রকল্প বাগিয়ে নিয়েছিল।

শুধু তাই নয়, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এ ঘটনায় তদন্ত করার জন্য একজন তদন্তকারী কর্মকর্তা নিযুক্ত করলেও তৎকালীন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা রহমাতুল মুনিমের চাপে সেই তদন্ত কার্যক্রমও আলোর মুখ দেখেনি। জানা গেছে, ২০২২ সালের ২৪ ডিসেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনের তৎকালীন উপপরিচালক মো. আবু বকর সিদ্দিক এই ঘটনার তদন্ত করতে পেট্রোবাংলার কাছে এসংক্রান্ত সব ধরনের তথ্য চেয়ে চিঠি দেন। কিন্তু রহমাতুল মুনিমের কারণে পেট্রোবাংলা সেই চিঠির এখন পর্যন্ত কোনো উত্তর দেয়নি। দুদকের পক্ষ থেকেও অদ্যাবধি এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য চেয়ে পালটা চিঠি দেয়নি পেট্রোবাংলাকে। এই সুযোগে সিন্ডিকেটের একটি পক্ষ পেট্রোবাংলা থেকে এই প্রকল্পের সব ধরনের ডকুমেন্ট গায়েব করে দিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে, এর সঙ্গে পেট্রোবাংলার একজন জেনারেল ম্যানেজার জড়িত রয়েছেন। মোটা অঙ্কের টাকা নিয়ে তিনি এই কাজ করেছেন বলে অভিযোগ আছে।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, এই সিন্ডিকেটের আরও যারা সদস্য ছিলেন তারা হলেন-পেট্রোবাংলার সাবেক একজন চেয়ারম্যান, যিনি এখন সচিব হিসাবে কর্মরত আছেন সরকারের একটি মন্ত্রণালয়ে। জানা গেছে, তিনি ওই সময় পেট্রোবাংলার পরিচালক (প্রশাসন) হিসাবে দায়িত্বে থেকে পুরো তদন্ত রিপোর্টটি ধামাচাপা দেন। পরে পুরস্কার হিসাবে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান পদটি বাগিয়ে নেন। এছাড়া বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক তৌফিকুর রহমান তপু, প্রকল্পের তৎকালীন পিডি আবুল জাহিদ এবং বিজিএফসিএলের জেনারেল ম্যানেজার আমীর ফয়সাল, টেকনোস্ট্রিমের দেশীয় অংশীদার কোম্পানি মজুমদার এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী জসিম উদ্দিন চৌধুরী। অভিযোগ আছে-এই মজুমদার এন্টারপ্রাইজের মাধ্যমে এই সিন্ডকেটের মাধ্যমে জ্বালানি বিভাগ থেকে কমপক্ষে ২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প হাতিয়ে নিয়েছে। আমীর ফয়সালের দায়িত্বে ছিল বিডারের সঠিকতা যাচাই করা। কিন্তু তিনি তা না করে প্রস্তাবটি বোর্ডে উঠান।

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ-জাল-জালিয়াতি ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর এই সিন্ডিকেট সদস্যরা প্রকল্পের বিডবন্ডের সাড়ে ১২ কোটি টাকা সরকারের কোষাগারে জমা না দিয়ে পুরো টাকা নিজেরাই আত্মসাৎ করেন। খোদ বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ডের তিতাস লোকেশনে ৭টি ওয়েলহেড কম্প্রেসার স্থাপন প্রকল্প ঘিরেই উল্লিখিত দুর্নীতি ও লুটপাট বাণিজ্য হয়েছে। ৯১০ কোটি টাকার এ প্রকল্পের শুরুতেই প্রভাবশালী এই চক্র দুর্নীতির ফাঁদ পাতে। জাল-জালিয়াতি করে এমন প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হয় যার সক্ষমতা তো দূরের কথা, অফিশিয়াল অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিতর্কিত কোম্পানির নাম টেকনোস্টিম এনার্জি। যাচাই-বাছাই না করেই তড়িঘড়ি করে বিজিএফসিএল টেকনোস্টিম এনার্জিকে নোয়া (নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড) ইস্যু করেছে। কিন্তু পুরো কার্যক্রম জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে তৈরি করার কারণে নোয়া ইস্যুর ২৮ দিনের মধ্যে কোম্পানিটি বিজিএফসিএলের সঙ্গে চুক্তি করতে পারেনি। জমা দিতে পারেনি দরপত্রের ১০ শতাংশ পারফরম্যান্স গ্যারান্টির (পিজি) টাকাও। কোম্পানির স্থানীয় এজেন্ট মজুমদার এন্টারপ্রাইজের মালিক সাবেক যুবলীগ নেতা জসিম উদ্দিন চৌধুরী ছিলেন এই জাল-জালিয়াতির মাস্টারমাইন্ড। বিডবন্ডের টাকা নিয়েও তিনি প্রতারণার আশ্রয় নেন। এ কারণে দরপত্রের সঙ্গে জমা দেওয়া সাড়ে ১২ কোটি টাকার বিডবন্ডটিও মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে যায়। অর্থাৎ এই টাকা যাতে সরকারি কোষাগারে জমা হতে না পারে সেজন্য এই কৌশল অবলম্বন করা হয়।

বাংলাদেশ গ্যাসফিল্ডের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ছিলেন তৎকালীন জ্বালানি বিভাগের সচিব আবু হেনা রহমাতুল মুনিম এবং বিজিএফসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন তৌফিকুর রহমান তপু।

বিজিএফসিএল সূত্রে জানা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এ কোম্পানিটির অস্তিত্ব নিয়ে সেই সময় পেট্রোবাংলায় পিপিসি কমিটির এক বৈঠকে প্রশ্ন ওঠায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ওই তদন্ত কমিটি সূত্রে জানা গেছে, টেকনোস্টিম এনার্জি নামে কোম্পানিটির লেটারহেড প্যাডে যুক্তরাষ্ট্রের যে ঠিকানা ব্যবহার করা হয়েছিল, সেখানে এর কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। ২০১৯ সালের প্রথমদিকে অর্থাৎ টেন্ডার আহ্বানের পরে কোম্পানিটির ওয়েবসাইট খোলা হয়েছিল। দরপত্রে অংশগ্রহণের জন্য তারা যেসব অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করেছে বাস্তবে কোম্পানিটি সেরকম কোনো কাজই করেনি।

অভিযোগ আছে-জ্বালানি বিভাগের তৎকালীন সচিব আবু হেনা রহমাতুল মুনিমের চাচাই মূলত একটি নামসর্বস্ব কোম্পানি খুলে এই দরপত্রে অংশ নিয়েছিলেন। তার সঙ্গে লোকাল এজেন্ট হিসাবে ছিল মজুমদার এন্টারপ্রাইজ। টার্গেট ছিল যেনতেন করে কার্যাদেশ নিয়ে ‘কাগজ’টি তৃতীয় পক্ষের কাছে মোটা অঙ্কের বিক্রি করে দেওয়া।

তিতাস লোকেশন ‘এ’-তে প্রতিদিন ৬০ মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতাসম্পন্ন মোট ৭টি ওয়েলহেড কম্প্রেসার স্থাপনের লক্ষ্যে ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। কারণ, এই ৭টি কূপে গ্যাসের চাপ কমে গিয়েছিল। কম্প্র্রেসার বসানো হলে কূপগুলো থেকে আগের মতো গ্যাস উৎপাদন সম্ভব হবে। প্রকল্পটি একনেক সভায় অনুমোদন হয় ২০১৬ সালে। দরপত্রে অংশগ্রহণকারী কোম্পানি তিতাসের ৭টি গ্যাসকূপের ওয়েলহেড কম্প্রেসার ডিজাইন তৈরি, ইঞ্জিনিয়ারিং, ক্রয়, সরবরাহ, স্থাপন, টেস্টিং, কমিশনিং, অপারেশন এবং মেইনটেইন্যান্সের কাজ করবে। ২০১৯ সালের ৩ মার্চ দরপত্র উন্মুক্ত করা হয়। মোট ৭টি কোম্পানি এতে অংশ নিলেও দুটি কোম্পানি কারিগরি ও আর্থিকভাবে রেসপনসিভ হয়। কোম্পানি দুটি হল-সিঙ্গাপুরভিত্তিক এন্টার ইঞ্জিনিয়ারিং প্রাইভেট লিমিটেড এবং যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টেকনোস্টিম এনার্জি লিমিটেড। ৯ সেপ্টেম্বর আর্থিক মূল্যায়ন প্রতিবেদনে বিজিএফসিএল বোর্ডে অনুমোদিত হয়। এরপরই ১২ সেপ্টেম্বর তড়িঘড়ি করে বিজিএমসিএল সর্বনিম্ন দরদাতা টেকনোস্টিম এনার্জিকে নোটিফিকেশন অব অ্যাওয়ার্ড (নোয়া) প্রদান করে। ১৭ সেপ্টেম্বর ঠিকাদার কোম্পানি নোয়ার বিপরীতে ইকসেপটেন্স লেটার পাঠায় বিজিএফসিএলকে।

নিয়ম অনুযায়ী চুক্তি সম্পাদনের নোটিশ (নোয়া) ইস্যুর ২৮ দিনের মধ্যে দরদাতা কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি সম্পাদন করতে হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়সীমা ১০ অক্টোবর শেষ হয়ে গেলেও সর্বনিম্ন দরদাতা টেকনোস্টিম এনার্জি বিজিএফসিএলের সঙ্গে কোনো ধরনের চুক্তি সম্পাদন করেনি। বারবার চিঠি ও তাগাদা দিলেও তারা চুক্তি করেনি। এমনকি কার্যসম্পাদন জামানত (পারফরম্যান্স সিকিউরিটি) পর্যন্ত দাখিল করেনি। বিজিএফসিএল সূত্র জানায়, তারা এ সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওই কোম্পানির সঙ্গে নানাভাবে চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারেনি।

একপর্যায়ে বিজিএফসিএল দরপত্রের সঙ্গে দেওয়া জামানতের (বিড সিকিউরিটি) ১২ কোটি ৫০ লাখ টাকা কর্তনের সিদ্ধান্ত নেয়। এই বিড সিকিউরিটির মেয়াদ ছিল ২৬ অক্টোবর পর্যন্ত। ২৪ অক্টোবর প্রকল্পের পিডি গুলশানের প্রিমিয়ার ব্যাংককে চিঠি দিয়ে এই টাকা বিজিএফসিএলের ফান্ডে নগদায়ন করার জন্য জানান। কিন্তু স্থানীয় এজেন্ট মজুমদার এন্টারপ্রাইজ, ব্যাংক ও বিজিএফসিএলের সঙ্গে যোগসাজশে এই চিঠি ৩০ অক্টোবর ব্যাংকে পৌঁছে। ততক্ষণে বিড সিকিউরিটির মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। ফলে মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার কারণ উল্লেখ করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিড সিকিউরিটি আদায় করা সম্ভব নয় বলে বিজিএফসিএলকে লিখিতভাবে জানিয়ে দেয়।

নিয়ম অনুযায়ী বিড সিকিউরিটি আদায় করতে না পারায় ওই কোম্পানিকে (টেকনোস্টিম এনার্জি) ব্ল্যাকলিস্ট করে তাদের নোয়া বাতিল করা। এমনকি জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা। কিন্তু রহমাতুল মুনিমের কারণে এখন পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়নি। এই ঘটনায় আবু হেনা রহমাতুল মুনিম, বিজিএফসিএলের সাবেক এমডি তৌফিকুর রহমান তপুসহ সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে টেলিফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও তারা টেলিফোন ধরেননি। মজুমদার এন্টারপ্রাইজের মালিক জসিম উদ্দিন চৌধুরীর ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button