পঞ্চদশ সংশোধনী অবৈধ অক্ষত হাসিনার ‘জাতির পিতা’, ‘৭ মার্চ’, ‘বাঙালি জাতীয়তা’
তত্তাবধায়ক সরকারকে সংবিধানের ‘মূল কাঠামো’ ঘোষণা
তত্তাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল সংক্রান্ত সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করেছেন হাইকোর্ট। ২৩ কার্যদিবস শুনানি শেষে জারিকৃত রুল অংশত চ‚ড়ান্ত ঘোষণার মধ্য দিয়ে গতকাল মঙ্গলবার বিচারপতি ফারাহ মাহবুব এবং বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর ডিভিশন বেঞ্চ এ রায় দেন। রায়ে ‘তত্ত¡াবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থাকে সংবিধানের ‘মূল কাঠামো’র অন্তর্ভুক্ত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ বলে উল্লেখ করেছেন রিটকারী পক্ষের আইনজীবী। সরকারপক্ষীয় আইনজীবী (অ্যাটর্নি জেনারেল) রায়টি আপিল বিভাগেও বহাল থাকবে- মর্মে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেছেন, ‘তত্তাবধায়ক সরকার’কে সংবিধানের মূল কাঠামোর অংশ গণ্যকৃত বিষয়টি আপিলে বহাল থাকলে তত্তাবধায়ক সরকার কেউ বাদ দিতে পারবে না। তবে শুধু এই রায়ের মধ্য দিয়ে ‘তত্তাবধায়ক সরকার’ পুনর্বহাল হয়েছে- এমন দাবি করা যাচ্ছে না এখনই। পরবর্তী জাতীয় সংসদের মাধ্যমে এটি পুনর্বহাল করতে হবে- মর্মে অভিমত দিয়েছেন রিটকারীর কৌঁসুলি।
রায়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করা হলেও অক্ষত রাখা হয়েছে বহুল বিতর্কিত ‘জাতির পিতা’, ‘বাঙালি জাতীয়তা’ সংক্রান্ত অনুচ্ছেদ। ‘৭ মার্চ’-এর ভাষণ ও ‘মুজিবনগর সরকার’ প্রসঙ্গও অক্ষত রাখা হয়েছে। ফলে এ রায়ের পরও ভারতে পালিয়ে যাওয়া শেখ হাসিনার মরহুম পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘জাতির পিতা’ মানতে হবে দেশের নাগরিকদের। জাতীয় সংসদে বহাল থাকছে সংরক্ষিত ৫০ নারী আসন।
‘জাতির পিতা’, ‘৭ মার্চ’সহ বহুল বিতর্কিত বেশ কয়েকটি বিষয় অমীমাংসিত থাকলেও রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ বলে উল্লেখ করছেন রিটকারীরা সংশ্লিষ্টরা। কারণ ২০১১ সালের ৩০ জুন আ’লীগ সরকার সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে সংবিধানে পঞ্চদশ সংশোধনী আনে। এ সংশোধনীর মাধ্যমে ‘তত্ত¡াবধায়ক সরকার’ ব্যবস্থা বাতিল হয়। আ’লীগ নিজেদের অধীনে তিনটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন করে। কথিত এসব নির্বাচনের মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা তার স্বৈরশাসনকে সুসংহত করেন। কার্যকর কোনো প্রতিদ্ব›িদ্বতা ছাড়াই আ’লীগ পরপর তিনবার সরকার গঠন করে। প্রতিদ্ব›দ্বী বিরোধী দলকে মাঠছাড়া করেন হাসিনা। সংবিধানে নিজের ইচ্ছেমাফিক সংশোধনী এনে এটিকে ব্যবহার করেন ক্ষমতা চিরস্থায়ী করার দলিল হিসেবে। অভুত গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট উৎখাত হয়ে ভারতে আশ্রয় নেন হাসিনা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দীর্ঘ চ‚ড়ান্ত শুনানির পর উপরোক্ত রায় দেন হাইকোর্ট।
ড. বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট নাগরিকের পক্ষের কৌঁসুলি শরীফ ভ‚ঁইয়া সাংবাদিকদের বলেন, আমরা পঞ্চদশ সংশোধনী সম্পূর্ণ বাতিল চেয়েছিলাম। আদালত বেশ কয়েকটি ধারা বাতিল করলেও অন্যগুলো বাতিল করেননি। আদালত বলেছেন, বাকিগুলোর বৈধতাও তিনি দিচ্ছেন না। সেগুলো ভবিষ্যৎ সংসদের জন্য রেখে দেয়া হয়েছে। ভবিষ্যৎ সংসদ জাতির প্রয়োজন অনুযায়ী সেগুলো রাখতে পারে অথবা বাতিল করতে পারে।
আইনজীবী শরীফ ভ‚ঁইয়া বলেন, আদালত বলেছেন, তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাংলাদেশের সংবিধানের মূল কাঠামোর একটি অংশ। যেহেতু নির্বাচন, গণতন্ত্র বাংলাদেশের সংবিধানের মূল কাঠামো, যেহেতু তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নির্বাচন ও গণতন্ত্রকে সুসংহত করেছে, সেহেতু এটি সংবিধানের একটি মূল কাঠামো। এটি একটি ঐতিহাসিক রায়।
তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরে আসার ক্ষেত্রে বড় বাধা দূর হলো। তবে সেটি এখনই ফিরে এসেছে বলা যাবে না। কারণ, সেটি বাতিল করা হয়েছিল দুইভাবে। আদালতের রায় ও সংসদ কর্তৃক সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে। তিনি বলেন, বদিউল আলম মজুমদার ও আরো চারজন এ বিষয়ে আপিল বিভাগে রিভিউ আবেদন করেছেন। জানুয়ারিতে শুনানি হবে। সেটি আবেদনকারীদের পক্ষে নিষ্পত্তি হলে তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরবে।
সংবিধানে ‘জাতির জনক’, ‘৭ মার্চের ভাষণ’সহ কয়েকটি ধারা যে সংসদের জন্য আদালত ‘রেখে দিয়েছেন’ বলে জানিয়েছেন রিটকারী ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, আদালত বিষয়টি রাজনীতিবিদদের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন। সার্বিকভাবে তিনি রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ উল্লেখ করে বলেন, আদালত তত্ত¡াবধায়ক সরকারকে সংবিধানের মূল কাঠামো হিসেবে উল্লেখ করেছেন। হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগে বহাল থাকবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। বহাল থাকলে তত্ত¡াবধায়ক সরকার কেউ বাদ দিতে পারবে না।
যদিও রুলের চ‚ড়ান্ত শুনানিতে সংবিধান থেকে ‘জাতির পিতা’ বাতিলের পক্ষে শক্ত যুক্তি তুলে ধরেছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। গত ১৩ নভেম্বর শুনানিতে তিনি বলেন, সংবিধানে থাকা ‘সমাজতন্ত্র’, ‘জাতির পিতা’, ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’ নিয়ে প্রবল বিতর্ক রয়েছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতারণা এবং এ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের মানুষ ও সংবিধানের বুকে কুঠারাঘাত করা হয়েছে। তত্ত¡াবধায়ক সরকার বাতিলে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। এ মাধ্যমে মৌলিক অধিকার ধ্বংস করা হয়েছে। এ সংশোধনী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান ও ’২৪-এর গণঅভ্যুত্থানের সাথে সাংঘর্ষিক।
তিনি বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধে শেখ মুজিবের অবদান অনস্বীকার্য। কিন্তু সংবিধানে জাতির পিতা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রণীত সংবিধানে কিন্তু ‘জাতির পিতা’র বিষয়টি ছিল না। এটি পঞ্চদশ সংশোধনীতে যুক্ত করা হয়েছে। এটি জোর করে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। শেখ মুজিবকে ‘জাতির পিতা’ বলা মূল সংবিধানের চেতনার পরিপন্থী। একজন ব্যক্তি সব করেছেন এটি আমাদের সংবিধানের সাথে যায় না। কেননা, সংবিধানের বলা আছেÑ আমরা সবাই স্বাধীন করেছি। ওনারা (আওয়ামী লীগ) রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার জন্য করেছে।
সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদে থাকা ‘জাতি হিসেবে বাঙালি’ ও ‘নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশি’ও বাতিলের পক্ষেও যুক্তি তুলে ধরেন অ্যাটর্নি জেনারেল। তিনি বলেন, পৃথিবীর কোনো দেশে ভাষা দিয়ে জাতিসত্তা নির্ধারণ করা হয় না। এর মাধ্যমে মানুষের মধ্যে বিভেদ তৈরি করা হয়েছে।
মো. আসাদুজ্জামান শুনানিতে বলেন, সংবিধানের ৭খ অনুচ্ছেদের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে হত্যা করা হয়েছে। সংবিধানের মূলনীতি গণতন্ত্রÑ কোনোক্রমেই সমাজতন্ত্র নয়। আমরা সমাজতন্ত্র বিলোপ চাই। পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে আনা ৭ মার্চের ভাষণ ও মুজিবনগর সরকার-সংক্রান্ত বিষয়গুলো সংবিধানে থাকার যোগ্য নয়।
গতকাল রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক নয়। কারণ আজকের রায়ের মধ্যে বলেছে, তত্ত¡াবধায়ক সরকার সাংবিধানিকভাবেই বৈধ সরকার। ১০৬ অনুচ্ছেদের প্রেক্ষাপটে মতামত নিয়ে করা হয়েছে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ মতামত দিয়েছেন, এটি সাংবিধানিক ওপিনিয়ন। আপিল বিভাগ সাংবিধানিক মতামতে বলেছেন, প্রেসিডেন্ট ওনাদের কাছে বলেছেন, সংসদ ভেঙে দেয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলে গেছেন, অন্য কাউকে ডেকে সরকার গঠন করা সম্ভব নয়। এ পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করতে আইনি কোনো বাধা আছে কিনা। সুপ্রিম কোর্ট গোটা প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিয়ে বলেছেÑ এটি বৈধ ও সাংবিধানিক সরকার হবে। এর সাথে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের কোনো সাংঘর্ষিক প্রভিশন নেই। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রাসঙ্গিক প্রশ্নে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই নির্বাচনকালীন তত্ত¡াবধায়ক সরকারের নামকরণ হবে। এ সরকারই তত্ত¡াবধায়ক সরকারে রিনেমড হবে। যেমনÑ আমি বলি, জেলা ও দায়রা জজের নাম শুনেছেন? একই ব্যক্তি যখন সিভিল মামলা করেন, তখন তাকে বলা হয় জেলা জজ। ওই একই ব্যক্তি যখন ক্রিমিনাল মামলা পরিচালনা করেন, তখন তাকে জেলা জজ বলা যায় না, তখন তিনি দায়রা জজ। এই ব্যক্তিরাই যখন তত্ত¡াবধায়ক সরকার সিস্টেমে চলে যাবেন ওনারাই তত্ত¡াবধায়ক সরকারের হবেন। এটিতে সাংবিধানিক সাংঘর্ষিকের কোনো জায়গা নেই।
এ ছাড়া তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিলকারী সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হককে ‘জ্ঞানপাপী’ বলেও মন্তব্য করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, জ্ঞানপাপী একজন জাস্টিজ ছিলেন খায়রুল হক নাম। উনি মূল রায় থেকে ডিভিয়েন করে (পথভ্রষ্ট) ১৭ মাস পর রায় রিলিজের সময় সেখানে বলেছেন, পরবর্তী দুটি নির্বাচন কোন ফর্মে হবে তা সংসদে ঠিক হবে। ওনাদের থেকে দলছুট হয়ে সিনহা বাবু বলেছেন, (পরবর্তী সময়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা) আগামী দুটি নির্বাচনই হবে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের অধীনে। খাইরুল হকের সঙ্গে তাল মেলালেন মানিক ও সৈয়দ মাহমুদ হোসেন। এদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়া উচিত।
প্রসঙ্গত, শেখ হাসিনার সরকার উৎখাত হওয়ার পর গত ১৮ আগস্ট পঞ্চদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেন ‘সুজন’ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদারসহ পাঁচ বিশিষ্ট নাগরিক। রিটের প্রাথমিক শুনানি শেষে গত ১৯ আগস্ট বিচারপতি নাইমা হায়দার ও বিচারপতি শশাঙ্ক শেখরের তৎকালীন ডিভিশন বেঞ্চ পঞ্চদশ সংশোধনী বাতিল প্রশ্নে রুল জারি করেন। পরে দুর্নীতি ও দলীয়করণের অভিযোগ ওঠায় বিচারপতি নাইমা হায়দারসহ বিতর্কিত ১২ বিচারপতিকে বেঞ্চ থেকে সরিয়ে নেয়া হয়। জারিকৃত রুলকে সমর্থন করে গত ২৯ অক্টোবর আদালতকে সহায়তা করতে (ইন্টারভেনার) বিএনপির পক্ষে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের আবেদন মঞ্জুর করেন হাইকোর্ট। তার পক্ষে শুনানি করেন সিনিয়র অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন। একই দিন রুল সমর্থন করে রিটে পক্ষভুক্ত হন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার। তা পক্ষে শুনানি করেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। পরবর্তীতে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব এবং বিচারপতি দেবাশীষ রায় চৌধুরীর ডিভিশন বেঞ্চে রুলের শুনানি শুরু হয় গত ৩০ অক্টোবর।