Bangladesh

পতনের তাণ্ডবে রক্তাক্ত শেয়ারবাজার

দেশের সম্ভাবনাময় শেয়ারবাজার আজ রূপকথার গল্পের মতো, নানা সংকটে বিধ্বস্ত। পতনের তাণ্ডব চলছে দীর্ঘদিন। পুরো বাজার কাঠামোই দুর্বল অস্তিত্বে টিকে আছে। মূল্যস্তর তলানিতে। একটা সিগারেটের দামে মিলছে ৬ থেকে ৮টি শেয়ার। ক্রমেই রক্তাক্ত হচ্ছে। দেখার যেন কেউ নেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে দেশে ২০টি সমস্যা থাকলে শেয়ারবাজার ২০ নম্বরেও থাকার কথা নয়। ফলে সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছেও বাজার গুরুত্ব হারিয়েছে। তাদের মতে, শেয়ারবাজারের পরিস্থিতির জন্য মোট দাগে দুটি বিষয় দায়ী।

প্রথমত, মুদ্রাবাজারসহ সামষ্টিক অর্থনীতির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। দ্বিতীয়ত, সুশাসনের অভাব। এ দুই কারণেই আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, পরিস্থিতি উত্তরণে ব্যাপক সংস্কার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি। এ চ্যালেঞ্জ সামনে নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) নতুনভাবে ৪ বছরের জন্য যাত্রা শুরু করেছে।

জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, শেয়ারবাজারে দীর্ঘদিন ধরে বিনিয়োগকারীদের আস্থার সংকট চলছে। এর সঙ্গে অর্থনৈতিক বিভিন্ন সংকট, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিসহ সবকিছু যোগ হয়েছে। ফলে সবার আগে আস্থার সংকট দূর করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আস্থা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ বিনিয়োগকারীদের এই নিশ্চয়তা দিতে হবে, কারসাজির মাধ্যমে কেউ তার টাকা হাতিয়ে নিলে বিচার হবে। পাশাপাশি ভালো শেয়ারের সরবরাহ বাড়াতে হবে। এ দুই পদক্ষেপের মাধ্যমে বাজারের সমস্যা দূর করা সম্ভব। তবে একেবারে তা সহজ নয়। বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, মাত্র ৫ কার্যদিবসে ডিএসইর সূচক কমেছে ২৭৫ পয়েন্ট। এ সময়ে বাজার মূলধন কমেছে ২০ হাজার কোটি টাকা। ১২ মে ডিএসইর প্রধান সূচক ছিল ৫ হাজার ৬৬৬ পয়েন্ট। সোমবার ডিএসইর সূচক ৫ হাজার ৩৯৩ পয়েন্টে নেমেছে। আলোচ্য সময়ে অর্থাৎ ৫ কার্যদিবসে বাজার মূলধন ৭ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকা থেকে ৬ লাখ ১১ হাজার কোটি টাকায় নেমে এসেছে। ডিএসইর সূচকের এ অবস্থান গত সাড়ে তিন বছরের মধ্যে সর্বনিু। এছাড়াও সাড়ে তিন বছরে ডিএসইতে ৪০টির মতো কোম্পানি যোগ হয়েছে। এসব কোম্পানি বাদ দিয়ে হিসাব করলে বাজারের এ পতন ইতিহাসে রেকর্ড অবস্থানে থাকবে।

কারণ, দুই শতাধিক কোম্পানির ক্রেতা নেই। কোনো কোনো শেয়ারের দাম ২ থেকে ৩ টাকার মধ্যে। এর মানে হলো, ১৮ টাকায় একটি বেনসন সিগারেট না কিনে অন্তত ৬ থেকে ৮টি শেয়ার কেনা সম্ভব। বাজারের এ পতন এবং উত্তরণের উপায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছে। সেখানে পতনের সুনির্দিষ্ট কিছু কারণ উঠে এসেছে। সবার আগে উঠে এসেছে সামষ্টিক অর্থনীতির খারাপ অবস্থার প্রভাব। বর্তমানে অর্থনীতির যে অবস্থা, তা ভবিষ্যতে ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য ভালো সংকেত নয়। ডলার সংকটের কারণে বিদেশি কোম্পানিগুলো মুনাফা নিতে পারছে না। তারা ভালো লভ্যাংশও দিচ্ছে না। দ্বিতীয়ত, বর্তমানে ব্যাংক আমানতের সুদের হার বিনিয়োগকারীদের জন্য আর্কষণীয়।

তারল্য সংকটের কারণে আমানতের জন্য ব্যাংকগুলো হাহাকার করছে। বাংলাদেশ ব্যাংকও সুদের হারের সীমা তুলে বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। এতে ইচ্ছামতো সুদের হার নির্ধারণ করছে ব্যাংক। অঘোষিতভাবে বেশকিছু ব্যাংক আমানতের বিপরীতে ১৪ থেকে ১৫ শতাংশ সুদ দিচ্ছে। ফলে বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ স্বল্প মেয়াদে হলেও ব্যাংকে টাকা রাখছে। কোনো কোনো কোম্পানি বন্ডেও ১৫ শতাংশ সুদ অফার করছে। যদিও এসব টাকা ফিরে পাওয়ার নিশ্চয়তা নেই। এরপরও বাজারে তা প্রভাব ফেলছে। বিষয়টি আলোচনায় আছে। তৃতীয় বিষয় হলো, হঠাৎ করেই মার্কিন ডলারের দাম ৮ টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমানে এক ডলার কিনতে ১১৮ টাকা লাগে। ডলারের এই দাম কোথায় গিয়ে থামবে, তা কেউ বলতে পারছে না। ফলে বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ ঝুঁকিমুক্ত বিনিয়োগ হিসাবে ডলার কিনছে। এছাড়াও সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে আবারও ডলার চুরি হয়েছে বলে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে। এটি পুরো অর্থবাজারে আতঙ্ক তৈরি করেছে। অর্থাৎ শেয়ারবাজারে আজকের সংকটের পেছনে বাংলাদেশ ব্যাংকের

অব্যবস্থাপনা বড় অংশে দায়ী। এছাড়া জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং বিএসইসি কিছু তৎপরতা আগুনে পেট্রোল ঢেলে দেওয়ার মতো অবস্থা হয়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর বেড়িয়েছে, শেয়ারবাজারে মূলধনি মুনাফার ওপর কর বসানো হবে। এক্ষেত্রে যেসব বিনিয়োগকারী বছরে শেয়ারবাজার থেকে ৪০ লাখ টাকার বেশি মুনাফা করে, তাদেরকে অতিরিক্ত মুনাফার জন্য ১৫ শতাংশ কর দিতে হবে। অর্থাৎ কোনো বিনিয়োগকারী সেকেন্ডারি মার্কেটে শেয়ার বেচাকেনা করে ৪১ লাখ টাকা আয় করলে তাকে ১৫ হাজার কর দিতে হবে। বাজারে পতনের এটা বড় কারণ। কেননা অনেক বড় বিনিয়োগকারী বাজার থেকে বেশি মুনাফা করে। এর মধ্যে অনেকে নিজের নামে নয়, বেনামে শেয়ার কেনাবেচা করে। তাই তাদের কর দিতে হয় না। কিন্তু নতুন করে কর আরোপ করা হলে পর্দার আড়ালে থাকা রাঘববোয়ালরা চিহ্নিত হয়ে যাবে। এছাড়াও পতন ঠেকাতে ২৪ এপ্রিল নতুন সিদ্ধান্ত নেয় বিএসইসি।

একদিনে কোনো শেয়ারের দর ৩ শতাংশের বেশি কমতে পারবে না। কিন্তু বাড়তে পারবে ১০ শতাংশ। এটি বাজারে নেতিবাচক বার্তা দেয়। কারণ, শেয়ারের দরপতন শুরুর পর ৩ শতাংশ কমার আগেই বিক্রির চাপ বেড়ে যায়। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, সাম্প্রতিক পতনের নেপথ্যে ব্রোকারদেরও হাত রয়েছে। কারণ, বাজারে সিইও ফোরাম নামে নতুন একটি সংগঠন হয়েছে। সোমবার এ ফোরাম ডিএসইর সঙ্গে বৈঠক করেছে। এটিকে ডিএসইর ব্রোকারেজ হাউজগুলো একেবারেই ভালোভাবে নেয়নি। তারা মনে করে, ডিএসই ব্রোকারেজ অ্যাসোসিয়েশনকে (ডিবিএ) দুর্বল করতে এই সংগঠন করা হয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ সামনে রেখেই আগামী চার বছরের জন্য দায়িত্ব নিয়েছে নতুন কমিশন। বাজারের পক্ষগুলো মনে করছে, কমিশনের আগামী দিনগুলো খুব সুখকর হবে না।

অর্থনীতিবিদ আবু আহমেদ বলেন, সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির অবস্থা খারাপ। রিজার্ভে সমস্যা, ডলারের দাম বেশি, সুদের হার বেড়েছে। এতে কোম্পানিগুলো ভালো লভ্যাংশ দিচ্ছে না। তিনি বলেন, শেয়ারবাজার আলাদা কোনো খাত নয়। এটি অর্থনীতির অংশ। অর্থনীতি খারাপ থাকলে শেয়ারবাজার ভালো হওয়ার কথা নয়। তার মতে, সাম্প্রতিক সময়ে সার্কিট ব্রেকারের এ নতুন নিয়ম পতনের জন্য বড় কারণ। কেননা শেয়ারের দরপতন শুরুর পর ৩ শতাংশ কমার আগেই বিক্রির চাপ বেড়ে যায়। শেয়ারবাজার অত্যন্ত স্পর্শকাতর। এখানে আইনকানুন সংস্কার জরুরি। না হলে বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারিয়ে ফেলে। তিনি বলেন, অবস্থার উত্তরণে বাজারকে তার নিজস্ব গতিতে চলতে দেওয়া উচিত।

জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, বাজারের বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক নয়। দরপতনকে অস্বাভাবিক মনে হচ্ছে। তবে সূচক যেভাবে কমছে, তার পেছনে কারও সংশ্লিষ্টরা রয়েছে কি না, তা অনুসন্ধানে কাজ করছে কমিশন। এক্ষেত্রে কেউ আইন লঙ্ঘন করলে পারবে না। তারল্য সংকট কাটাতে মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে সক্রিয় হতে হবে।

এভাবে সাইট লাইনে থাকা বড় বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। মূলধনি মুনাফায় কর আরোপের ব্যাপারে তিনি বলেন, বিষয়টি এখনো আমরা জানি না। বাজেট ঘোষণার পর জানা যাবে। তবে কমিশন আশা করে, শেয়ারবাজারে খারাপ পরিস্থিতি তৈরি করে এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না এনবিআর।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor