Hot

পথে নামলেই আতঙ্ক, নিরাপদ নয় ঘরও

  • পরিবর্তিত পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে অপরাধীরা
  • চুরি কমলেও বেড়েছে ডাকাতি ও ছিনতাই
  • পুলিশের কাছে গিয়ে মিলছে না আশানুরূপ ফল

ঢাকায় গত ৯ মাসে চুরি কমলেও বেড়েছে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা। রাজধানীতে গড়ে প্রতিদিনই ডাকাতি ও চুরির ঘটনা ঘটছে। সবচেয়ে নাজুক অবস্থা মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি, উত্তরা ও ডেমরা এলাকার। এসব এলাকায় প্রকাশ্যে অস্ত্র ঠেকিয়ে ছিনতাই এবং ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। তবে এসব ঘটনায় ভুক্তভোগীরা পুলিশের কাছে যাচ্ছেন কম। আবার যারা যাচ্ছেন, তারা আশানুরূপ প্রতিকার পাচ্ছেন না। যদিও নানা ঘটনাপ্রবাহের পর আলোচনা-সমালোচনার মুখে মোহাম্মদপুর থানা-পুলিশ নড়েচড়ে বসেছে। যৌথ বাহিনীর সঙ্গে এলাকা জুড়ে চালাচ্ছে সাঁড়াশি অভিযান।

রাজধানীর পুরনো অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত ধানমন্ডি। সকাল-দুপুর কিংবা সন্ধ্যা-রাত যখনই হোক, এই এলাকার সড়কগুলো থাকে ব্যস্ত। অন্য আর দিনগুলোর মতো খুবই সাধারণ দিন ছিল ধানমন্ডির সাত মসজিদ সড়কের পুরনো ১৫ নম্বর বাসস্ট্যান্ড এলাকা। বর্তমানে যেটি ৮/এ সড়ক হিসেবে পরিচিত। ব্যক্তিগত কাজ সেরে আলমাস ও ইউনিমার্ট সুপার শপের মাঝামাঝি স্থান দিয়ে নিজের গন্তব্যে যাচ্ছিলেন রাসেল আলী। হঠাৎ কেউ এসে তাকে লাথি মেরে ফেলে দেয়। তারপর নিজের আশপাশে হেলমেট পরিহিত চার যুবককে দেখতে পান। তাদের একজন সে তাকে জাপটে ধরে। আর একজন হাতে থাকা বিদেশি রিভলবার দিয়ে এক রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে আকাশের দিকে। খুব অল্প সময়ের মধ্যে চরম ভীতিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। তবুও নিজের শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে অচেনা ওই চারজনের বলয় থেকে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেন রাসেল। আশপাশে অনেক লোকজন তাকিয়ে দেখছিল। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছিল প্রাণভয়ে। জাপটে ধরা ও ঘিরে রাখা হেলমেট পরিহিত অস্ত্রধারী চারজনের মূল লক্ষ ছিল রাসেলের হাতে থাকা একটি ব্যাগ। অন্যদিকে সেটি নিজের কবজায় রেখে ছুটে যাওয়ার প্রাণপণ চেষ্টা করেন রাসেল। এমন পরিস্থিতিতে আরেকটি গুলি ছোড়ে দুর্বৃত্তরা, যা তার কানের পাশ দিয়ে যায়। এরপর ব্যাগটি কেড়ে নিয়ে চারজন চারটি মোটরসাইকেলের পেছনে উঠে চলে যায় জিগাতলার দিকে।

গত ১৯ অক্টোবর নিজের সঙ্গে ঘটে যাওয়া রুদ্ধশ্বাস এক ছিনতাইয়ের ঘটনা এভাবেই বর্ণনা করছিলেন রাসেল। ঘটনাস্থলের বিপরীত পাশেই কেয়ারি প্লাজার দোতলায় বিদেশি মুদ্রা কেনাবেচার প্রতিষ্ঠান ডেল্টা ব্যুরো ডি চেঞ্জের ব্যবস্থাপক এই ভুক্তভোগী। তার কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়া ওই ব্যাগে ছিল প্রতিষ্ঠানের ৫০ লাখ টাকা।

ঘটনার পর থেকেই নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন রাসেল। পথে বের হলেই আতঙ্কে থাকেন এই যুবক। প্রায় ১০ দিন পেরিয়ে গেলেও সেদিনের ঘটনা মনে হলে ভয়ে হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে যায় তার। তিনি বলেন, ‘সেদিন একজন আমাদের আগে থেকেই অনুসরণ করছিল। আর বাকি চারজনের মধ্যে দুজন ছিল অস্ত্রধারী। তারা ব্যাগ ছিনিয়ে নেওয়ার সময় আমিসহ আমার আরেক সহকর্মীকে মারধরও করে। ব্যাগের সঙ্গে সেদিন আমার মানিব্যাগও নিয়ে যায় ওই সন্ত্রাসীরা। শুধু ফোনটা সঙ্গে আছে। এখন রাস্তায় বের হলেই মনে হয় কখন যেন এই ফোনটাও কেউ টান দিয়ে নিয়ে যাবে। সড়কে চলাফেরা করতে খুব আতঙ্ক ও ভয় কাজ করে মনে।’

ছিনতাইয়ের এই ঘটনায় পরদিন ধানমন্ডি মডেল থানায় মামলা করেন বিদেশি মুদ্রা কেনাবেচার প্রতিষ্ঠানটির মালিক কাইয়ুম রেজা। তবে পুলিশের কার্যক্রম তার মনে কোনো আশা জাগাতে পারেনি। আক্ষেপ আর হতাশা নিয়ে কাইয়ুম রেজা গতকাল সোমবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘ঘটনার সময়কার সিসিটিভি ফুটেজ আমাদের কাছে আছে। সেখানে ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িতদের অনেককেই চিহ্নিত করা সম্ভব। তারপরও পুলিশ আশানুরূপ কোনো অগ্রগতি করতে পারছে না। আমরা ডিবি, র‌্যাবের দপ্তরে দপ্তরে দৌড়াচ্ছি। জানি না কীভাবে কী হবে।’

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা রায়হান সিদ্দিকী শামীম বলেন, ‘আমরা সিসিটিভি ফুটেজ ধরে কাজ করছি। বেশ কিছু মোটিভ নিয়ে সামনে আগাচ্ছি। আশা করি ইতিবাচক ফলাফল আসবে।’

ধানমন্ডিতে শুধু এ ঘটনাই নয়। কাছাকাছি সময়ে, কাছাকাছি এলাকায় আরও বেশ কয়েকটি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। গত ৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় ৮/১ নম্বর সড়কে কাকলী স্কুলের সামনে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন শিক্ষার্থী রাইয়ান ভূঁইয়া। ওই দিনই ধানমন্ডি থানায় লিখিত অভিযোগ দেন তার মা তাজনুর জাহান; কিন্তু সেটি মামলা হিসেবে নথিভুক্ত হয়নি। থানা এলাকা আলাদা হলেও গত শনিবার সন্ধ্যার পরপরই মিরপুর রোডের ধানমন্ডি ৩২ নম্বর এলাকায় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন তাসরীন শামীমা। এই দুই ভুক্তভোগীও জানিয়েছেন আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠার কথা।

রাজধানীর বুকে এক টুকরো ‘সোমালিয়া’ মোহাম্মদপুর

গত ২৫ অক্টোবর রাতে মোহাম্মদপুরের একতা হাউজিং ও ঢাকা উদ্যানে দল বেঁধে গণছিনতাই করে একদল কিশোর। তাদের প্রত্যেকের হাতে ছিল চাপাতি ও আগ্নেয়াস্ত্র। পথে যাকে পেয়েছে তাকেই অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ছিনতাই করে। এতে ঢাকা উদ্যানে আতঙ্ক ছড়িয়ে পরে। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে রুবেল হোসেন নামে এক যুবক বলেন, ‘বি-ব্লকের বাসায় ফিরছিলাম। একদল কিশোর এসে চাপাতি দিয়ে কাঁধে আঘাত করে মোবাইল ও মানিব্যাগ নিয়ে চলে যায়। এ সময় যাকেই সামনে পেয়েছে, তার কাছ থেকেই সব নিয়ে গেছে তারা।’

একই এলাকায় আলোচিত আরেকটি ঘটনা ঘটে গত ২১ অক্টোবর ভোরে। নবোদয় হাউজিংয়ের ডি-ব্লকের ৪/এ সড়কের রোজ গার্ডেন নামে একটি ভবনের সামনে থেকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে ধাওয়া করে তার ব্যাগ ও মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেয়। এই তরুণী বোনের বাসা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে যাচ্ছিলেন। তবে এ ঘটনায় তারা কোনো অভিযোগ করেননি থানায়। ভুক্তভোগীর বোন সুরভী বলেন, ‘মামলা করে কোনো লাভ নেই, পুলিশ বিষয়টি জানে, তারা নিজেরাও অপরাধীদের গ্রেপ্তার করতে পারেন।’

এ ছাড়া মোহাম্মদপুরের তিন রাস্তায় বাড়িতে র‌্যাব ও সেনাসদস্য পরিচয়ে ডাকাতি এবং নেসলের গাড়ি থামিয়ে ছিনতাইয়ের আরও দুটি আলোচিত ঘটনা ঘটেছে গত দুই সপ্তাহের মধ্যে।

গত কয়েক সপ্তাহে মোহাম্মদপুরে ছিনতাই, ডাকাতি ও গোলাগুলিসহ প্রায়ই বিভিন্ন অপরাধমূলক কার্যকলাপকে অনেকেই গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত সোমালিয়ার সঙ্গে তুলনা করছেন। যেখানে বিশৃঙ্খলা ও অনিরাপত্তাই যেন অমোঘ নিয়তি। যদিও সেনাক্যাম্প বসিয়ে গত রবিবার থেকে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা চলছে। সাঁড়াশি অভিযানে গ্রেপ্তার ও দেশীয় অস্ত্র উদ্ধার হচ্ছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত ৫ আগস্টের পর থেকে মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় ১০টি হত্যাকাণ্ড হয়েছে। প্রত্যেকটি ঘটনাতেই মামলা হয়েছে থানায়। এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ২৭ জন গ্রেপ্তারও হয়েছে। একই সময়ে দুটি ডাকাতির মামলা হয়েছে। দুই মামলায় ১৪ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। এ ছাড়া গত তিন দিনে ছিনতাইয়ে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছে ১০১ জন। এ ছাড়া ছিনতাইয়ে ব্যবহৃত ৪০টি চাপাতি উদ্ধার করা হয়েছে। মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্প ঘিরে সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর সংঘাত ও মাদক কারবার নিয়ন্ত্রণে দুটি অস্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করা হয়েছে। এ ছাড়া মাদক কারবার ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২০ রাউন্ড গুলিসহ উদ্ধার হয়েছে তিনটি অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র। সেই সঙ্গে বিপুলসংখ্যক ধারালো অস্ত্রও উদ্ধার করেছে যৌথ বাহিনী।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার রুহুল কবির খান বলেন, ‘মোহাম্মদপুর থানা এলাকায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে জনমনে যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তা নিরসন করে স্বাভাবিক পরিস্থিতি বজায় রাখতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বদ্ধপরিকর। সংশ্লিষ্ট সবাইকে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আশা করি, দ্রুততম সময়ে মোহাম্মদপুরসহ রাজধানীর আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির দৃশ্যমান অগ্রগতি দেখা যাবে, স্বস্তি ফিরে আসবে জনমনে।’

ডিএমপির অপরাধবিষয়ক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রাজধানীতে ৪৮২টি চুরি এবং ২৪টি ডাকাতির ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে পুলিশ সদস্যের বাসাতেও ডাকাতি ও চুরির ঘটনা রয়েছে। জানুয়ারিতে চুরির ঘটনা ৬৮টি, ফেব্রুয়ারিতে ৫২, মার্চে ৫২, এপ্রিলে ৭০, মে মাসে ৬৪, জুনে ৮৬, জুলাইয়ে ৩৯, আগস্টে ১৬ এবং সেপ্টেম্বরে ৩৫টি চুরির ঘটনায় মামলা হয়েছে। গত তিন মাসে চুরির ঘটনা আগের ছয় মাসের চেয়ে কমেছে। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে দীর্ঘদিন থানার স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় অনেক নিয়মিত মামলা হয়নি।

গত ১৯ অক্টোবর রাজধানীর শাহজাহানপুরে জুবায়ের হোসেন অলক নামে ডিএমপির এক কনস্টেবলের বাসায় চুরি হয়। এ ঘটনায় জড়িত তিনজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তাদের কাছ থেকে চুরি হওয়া স্বর্ণের একটি চেইন ও এক জোড়া কানের দুলও উদ্ধার হয়।

জুলাইয়ে রাজধানীতে ডাকাতির ঘটনায় তিনটি, আগস্টে চার এবং সেপ্টেম্বরে পাঁচটি মামলা হয়। তবে বাস্তবে ডাকাতির ঘটনা এর চেয়ে অনেক বেশি বলে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন। ডিএমপির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির ঘটনা ঘটে মোহাম্মদপুরে। এরপরই রয়েছে উত্তরা, ডেমরা ও তেজগাঁও এলাকা। ডাকাতির ঘটনায় মামলা নিতে অনীহা রয়েছে থানা-পুলিশের। গত ১৮ অক্টোবর রাতে কমলাপুর স্টেশন থেকে বাসায় ফেরার পথে মগবাজার রেলক্রসিংয়ের আগে ডাকাতির শিকার হন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শিবলুল হক শোভন। গলায় চাপাতি ধরে অনেকটা ফিল্মি স্টাইলে তিনটি মোটরসাইকেলে করে আসা সাতজন তার কাছে থাকা আইফোন ১৫ প্লাসসহ টাকা, দরকারি কাগজপত্র ও ইলেকট্রনিকস ডিভাইস ছিনিয়ে নেয়। এ ঘটনায় শিবলু মামলা করতে চাইলেও ডাকাতির মামলা নিতে চায়নি হাতিরঝিল থানা-পুলিশ। শিবলু অভিযোগ করে বলেন, হাতিরঝিল থানায় তিন দফায় যেতে হয়েছে। মামলা করতে চাইলে, কর্তব্যরত পুলিশ কর্মকর্তা তাদের মতো করে লিখতে নির্দেশ দেন। পরে মামলা নিলেও ডাকাতির বর্ণনা দিতে রাজি হয়নি পুলিশ।

এ বিষয়ে হাতিরঝিল থানার ওসি মোহাম্মদ রাজু বলেন, ‘মামলা হয়েছে, তদন্ত চলছে। জড়িতদের শনাক্তে সিসি ক্যামেরার ফুটেজ বিশ্লেষণ করা হচ্ছে।’ ডাকাতির মামলা না নেওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘ঘটনার সময় আমি ছিলাম না।’ 

ডিএমপির জনসংযোগ ও গণমাধ্যম শাখার উপ-কমিশনার মো. তালেবুর রহমান বলেন, ডিএমপি এলাকায় ১৫০টি স্থায়ী ও ভ্রাম্যমাণ চেকপোস্ট কার্যকর রয়েছে। ৩০০টি মোটরসাইকেল টিম এবং ২৫০টি টহল টিম কার্যকর রয়েছে। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button