Bangladesh

পদ বাড়িয়ে নিল প্রশাসন

নিজেদের পদ বাড়িয়ে নিয়েছে প্রশাসন ক্যাডার। আর পদ বাড়াতে গিয়ে আইন দিয়ে সৃষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পদও নিজেদের তফসিলভুক্ত করেছে দাপুটে এ ক্যাডার। ‘বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস (প্রশাসন) গঠন ও ক্যাডার আদেশ, ২০২৪’ জারি করার মাধ্যমে পদ বাড়ানো হয়েছে। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি এ সংক্রান্ত এসআরও জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। বর্তমানে ‘বিসিএস (অ্যাডমিনিস্ট্রেশন) কম্পোজিশন অ্যান্ড ক্যাডার রুল, ১৯৮০’ দিয়ে এ ক্যাডার পরিচালিত হচ্ছে। নতুন আদেশের মাধ্যমে পুরনো আদেশ বিলুপ্ত করা হয়। বিলুপ্ত আদেশে প্রশাসন ক্যাডারের তফসিলভুক্ত পদ ছিল ৩ হাজার ৯৭টি। নতুন আদেশে তা বাড়িয়ে করা হয়েছে ৭ হাজার ৭৬টি।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ১৯৮০ সালের তুলনায় প্রশাসনের আকার বেড়েছে। সময়ের প্রয়োজনে নতুন নতুন পদ সৃষ্টি হয়েছে। প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে ইকোনমিক ক্যাডার একীভূত করা হয়েছে। এর বাইরে আরও কয়েকটি ক্যাডার একীভূত হওয়ার প্রস্তাব দিয়ে রেখেছে। এ অবস্থায় সিভিল সার্ভিস (প্রশাসন) গঠন ও ক্যাডার আদেশ সংশোধন ছাড়া কোনো উপায় ছিল না।

জনপ্রশাসনে ২৬টি ক্যাডার রয়েছে। এসব ক্যাডারের উপক্যাডারও সৃষ্টি করা হয়েছে। প্রশাসন ক্যাডার আদেশ নতুন করে জারি করা হলেও অন্যান্য ক্যাডার আদেশ সংশোধন করা হয়নি। এমনিতে দেশের জনপ্রশাসনে আন্তঃক্যাডার বৈষম্য রয়েছে। বিভিন্ন ক্যাডারের মধ্যে প্রভাব, কাজের সুযোগ এবং আর্থিক সুবিধায় ভিন্নতা আছে। এ নিয়ে নানা সময়ে নিজেদের অসন্তোষ প্রকাশ করেছে প্রশাসন ক্যাডারের বাইরে থাকা প্রায় সব ক্যাডার। নতুন আদেশ কার্যকরের পর অন্যান্য ক্যাডারের ক্ষোভ আরও বাড়তে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া বলেন, ‘পদোন্নতি হওয়ার পরই আলোচনা শুরু হয়ে যায় পদের চেয়ে বেশি পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ক্যাডার কম্পোজিশন রুল সংশোধনের ফলে এ দায় থেকে মুক্তি পাবে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ভালো কাজ করেছে। তবে এ ভালো কাজ অন্য ক্যাডারের জন্যও করা উচিত। আপগ্রেডেশন শুধু প্রশাসন ক্যাডারের নয়, প্রত্যেক ক্যাডারের জন্য জরুরি। এখানে জরুরি বললে কম বলা হয়। শব্দটি আসলে ফরজ বলা হলে এর গুরুত্বটা যথাযথভাবে উপলব্ধি করা যায়।’

সংশোধিত ক্যাডার আদেশে প্রশাসন ক্যাডারের লাইন পদের সঙ্গে আরও কিছু পদ যোগ করা হয়েছে। বাড়তি পদ যোগ করতে গিয়ে ভিন্ন আইনে সৃষ্ট পদও এ আদেশ দিয়ে প্রশাসন ক্যাডারের তফসিলভুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ লোকপ্রশাসন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (বিপিএটিসি) ভিন্ন একটি আইনি প্রতিষ্ঠান। এর রেক্টর পদটি ওই আইন দিয়ে সৃষ্ট। আইনে উল্লেখ আছে সরকার একজন রেক্টর নিয়োগ করবে এবং তিনি সরকারের সচিব হবেন। কিন্তু প্রশাসন ক্যাডারের তালিকাভুক্ত পদ হয়ে যাওয়ায় এখন এ পদে শুধু প্রশাসন ক্যাডার থেকেই নিয়োগ দিতে হবে। এসআরও দিয়ে একটি আইনি আদেশকে টক্কর দেওয়া হয়েছে। এখন এ আইন সংশোধন করতে হবে। একইভাবে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক পদটিকেও প্রশাসন ক্যাডারের তফসিলভুক্ত করা হয়েছে।

সরকারের চাকুরেরা কর্মচারী হিসেবে পরিচিত। অন্যান্য নিয়োগবিধিতেও কর্মচারী শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। নতুন আদেশে কর্মকর্তা শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে। ডেপুটি কমিশনার পদটি প্রশাসন ক্যাডারের শিডিউলভুক্ত পদ ছিল। জেলা প্রশাসকের কোনো অস্তিত্ব ছিল না। এবার ডেপুটি কমিশনার বাদ দিয়ে জেলা প্রশাসক নামে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট পদে প্রশাসন ক্যাডারের সদস্য সরকারের উপসচিবদের নিয়োগ করা হয়। উপসচিব পদটিও প্রশাসন ক্যাডারের শিডিউলভুক্ত করা হয়েছে। অথচ এ পদটি সরকারের উপসচিব, যুগ্ম সচিব, অতিরিক্ত সচিব ও সচিব পদে পদোন্নতি বিধিমালা ২০০২-এর নির্ধারিত পদ। নতুন আদেশে উপসচিব পদ (বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার হতে পদোন্নতিপ্রাপ্ত উপসচিব) ৭৬৭টি।

নতুন ক্যাডার আদেশের শুরুতে বলা হয়েছে, সংবিধানের ১৪০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সঙ্গে পরামর্শ করে এ আদেশ জারি করা হয়েছে। তবে খোদ প্রশাসন ক্যাডারের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘পিএসসি কীভাবে অন্য আইন বা বিধিভুক্ত পদকে এর অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দিয়েছে? আইন মন্ত্রণালয়ের ভেটিং ছাড়া এসআরও জারি করা যায় না। তারাইবা এমন করে প্রশাসন ক্যাডারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে কোন যুক্তিতে?’

১৯ ফেব্রুয়ারি এ আদেশ জারির পর প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের ভেতরও এ নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে। বিভিন্ন ব্যাচভিত্তিক কর্মকর্তাদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে কর্মকর্তারা পক্ষে-বিপক্ষে নানা আলোচনা করছেন। সেখানে প্রশাসন ক্যাডারের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘যে পদগুলোর ভিত্তি আইন বা বিধি, সেই পদ অন্য একটি ক্যাডারের করা যায় না। এতে মনে হয় আমার বাড়ির সব কাজের লোক আমার বাড়ির মালিক। এমন কোনো আদেশ আইন বিধি করা উচিত নয় যা বিদ্যমান আদেশ, আইন, বিধিকে ক্ষুন্ন করে বা সংঘর্ষ তৈরি করে। যেগুলো আইনি সংস্থার পদ সেগুলো সেভাবেই সংরক্ষণ করা দরকার। অন্য কোনো বিধি বা আদেশে ভুক্ত না করাই শ্রেয়। তাই প্রেষণে যাওয়া যায় এমন পদ নিজেদের করা সমীচীন নয়।’

খাদ্য অধিদপ্তরে কর্মরত ফুড ক্যাডারের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বিভিন্ন সংস্থার কাছে প্রশাসন ক্যাডার হচ্ছে তারা আসেন, হানিমুন করে চলে যান, আবার একজন আসেন। তাদের মনের মধ্যে থাকে চলে যাবেন কখন। ফলে আসল কাজ হয় না, যা হয় টাইম পাস। দুয়েকজন পাওয়া যায় যারা কিছু করে দেখাতে চান। অনেকেই যাওয়ার সময় দপ্তরের লোকদের দোষ দিয়ে যান। এ পদ্ধতিগত ত্রুটির কারণে প্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষ ও অভিজ্ঞ হতে পারছে না। এতে সংস্থাগুলো দুর্বল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে। নিজস্ব মানবসম্পদ উন্নয়ন হয়নি বরং দলাদলি, অব্যবস্থাপনার মতো বাজে অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। তাই আদেশটা নির্মোহভাবে করা দরকার ছিল।’

বর্তমানে একটি সংস্থার প্রধান এবং প্রশাসন ক্যাডারের বাইরের ভিন্ন একটি ক্যাডারের কর্মকর্তা বলেন, ‘সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদ ভূমি মন্ত্রণালয়ের কোনো দপ্তর বা সংস্থার সাংগঠনিক কাঠামোর পদ নয়। উপজেলা ভূমি অফিস নামে একটি বিধি আশির দশকে করা হয়েছে। সে অনুযায়ী উপজেলা ভূমি অফিস চলে। সেখানে ভূমি অফিসার, কানুনগো, নাজির, সার্ভেয়ার এসব পদ আছে। সহকারী কমিশনার (ভূমি) নামে কোনো পদ নেই। ভূমি অফিস চালানোর জন্য জেলা প্রশাসক একজন সহকারী কমিশনারকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন, যেটা এখনো চলছে। এখন ভূমি মন্ত্রণালয়ের চাহিদা অনুযায়ী সহকারী কমিশনারদের দায়িত্ব পালনের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত করা হয়।’

লক্ষ করা গেছে, নতুন আদেশে নিজস্ব আইনভুক্ত বিপিএটিসির রেক্টরকে প্রশাসন ক্যাডারের পদ করলেও পিএসসির সচিব, নির্বাচন কমিশনের সচিব, দুদকের সচিব বা অন্যান্য সংস্থার সচিব পদকে তফসিলভুক্ত করা হয়নি।

রেল ক্যাডারের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সিভিল সার্ভিসের ক্যাডার আদেশ সংশোধন করা বেশ জটিল কাজ। কারণ রেলে দুটি ক্যাডার রয়েছে। একটি ইঞ্জিনিয়ারদের, অন্যটি সাধারণদের বাণিজ্যিক জায়গা থেকে। এ দুই ক্যাডারের সঙ্গে পরে আরও একটি সাব-ক্যাডার যোগ করা হয়েছে। এখন একটা বড় জটিলতা হচ্ছে, রেলের ডিজি বা এডিজি হবেন কোনো ক্যাডার থেকে। দুই ক্যাডারই সমান দাবিদার। এ নিয়ে আবেগতাড়িত হয়ে কাজ করলে মামলা হবে। বিষয়গুলো ঝুলে যাবে। প্রশাসন ক্যাডার যেভাবে তাদের নিজের ক্যাডার রুল সংশোধন করেছে বা নতুন করে করেছে, একইভাবে অন্য ক্যাডারদের রুলটাও সংশোধন করতে হবে। কারণ জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সব ক্যাডারের মন্ত্রণালয়। তারা শুধু প্রশাসন ক্যাডারের মন্ত্রণালয় না।’

এ প্রসঙ্গে বিপিএটিসির সাবেক এক রেক্টর বলেন, ‘জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ এমন কথা প্রচলিত আছে প্রশাসন ক্যাডার সম্পর্কে। সব কাজের জন্য সর্বত্র প্রশাসন ক্যাডার। কিন্তু কালক্রমে ভিন্ন ভিন্ন সুনির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়েছে। সেগুলোতে ক্যাডার এবং নন-ক্যাডার জনবল রয়েছে। যারা সুনির্দিষ্ট কাজ ও নিয়মকানুনের মধ্যে চলে। ফলে আর সেসব কাজের কাজি দাবি করার সুযোগ নেই। বরং যে উদ্দেশ্য নিয়ে সংস্থাগুলো সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে তাদের সেই কাজে দক্ষ ও অভিজ্ঞ হতে দিতে হবে। এর সঙ্গে সুন্দর সক্ষমতা অর্জন করলে সরকার জনসেবা নিশ্চিত করতে পারবে। আর স্মার্ট বাংলাদেশে সবকিছু পরিষ্কার ও সুনির্দিষ্ট হবে এটাই স্বাভাবিক।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor