Bangladesh

পরিবারকে সম্পদ দিয়েও রক্ষা নেই মতিউরের, দুদকের পাশাপাশি তদন্তে সিআইসি

দুই পক্ষের স্ত্রী-সন্তান ও দুই ভাইয়ের নামে বাড়ি, গাড়ি, ফ্ল্যাট, পার্ক, শিল্পকারখানা, রিসোর্ট ও পুঁজিবাজারে কয়েক হাজার কোটি টাকা

ছাগলকাণ্ডে আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদ্য সাবেক সদস্য মো. মতিউর রহমানের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকী ছিলেন কলেজ শিক্ষক। বর্তমানে তিনি নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান। দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিভলী গৃহিণী। প্রথম পক্ষের মেয়ে ফারজানা রহমান ইপ্সিতা ঢাকার নামি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষাজীবন শেষে কানাডা প্রবাসী। ছেলে আহমেদ তৌফিকুর রহমান অর্নব যুক্তরাজ্যে পড়াশোনা করেছেন। দেশে ফিরে বিয়ে করেছেন চট্টগ্রামের এক ঋণখেলাপি শিল্পপতির মেয়ে। দ্বিতীয় ঘরের মেয়ে ইফতিমা রহমান মাধবী বারডেম মেডিকেল কলেজে পড়ছেন। আর ছাগলকাণ্ডের জন্ম দেওয়া ছেলে মুশফিকুর রহমান নটর ডেম কলেজের ছাত্র। ছোট ছেলে ইরফানের বয়স সাত বছর। এছাড়া মতিউরের এক ভাই নূরুল হুদা ছিলেন বেকার, বখাটে। আরেক ভাই কাইয়ুম হাওলাদার গার্মেন্টে চাকরি করতেন। বাবা আব্দুল হাকিম ছিলেন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাদের মধ্যে আব্দুল হাকিম, লাকী ও কাইয়ুমের নামমাত্র আয় থাকলেও অন্য সবার ব্যয়ের উৎস ছিল মতিউরের বেতনের অর্থ।

অত্যন্ত সাধারণ পারিবারিক পরিচয়ের এ ব্যক্তিরাই এখন শত শত কোটি টাকার সম্পদের মালিক। তাদের নামে বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি, ফ্ল্যাট, পার্ক, রিসোর্ট, শিল্পকারখানা-কী নেই। কারও নামে পুঁজিবাজারে আছে বিপুল বিনিয়োগ। অভিযোগ আছে, অতি ধূর্ত মতিউর নিজের অবৈধ আয় আড়াল করতে কাগজে-কলমে পরিবারের সবাইকে সম্পদশালী করে দিয়েছেন। নিজের নামে রেখেছেন সামান্য কিছু। যাতে আইনের ফাঁকফোকরে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকতে পারেন।

আয়কর ফাইলের তথ্য বলছে, তিনি মাত্র ২০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক। এর মধ্যে ১৩ কোটি টাকা আছে নগদ। যদিও আয়কর ফাইলের তথ্যের সঙ্গে বাস্তবের কোনো মিল নেই। ফাইলে উল্লিখিত ও বাস্তব সম্পদে দৃশ্যমান ফারাক থাকলেও এর আগে চার দফা তার অবৈধ সম্পদ খুঁজে পায়নি দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। প্রতিবারই রহস্যজনক কারণে অভিযোগ পরিসমাপ্তি করেছে সংস্থাটি। তবে এবার দুদকের পাশাপাশি মতিউর পরিবারের সম্পদের খোঁজে নেমেছে এনবিআর-এর কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেল সিআইসি। একাধিক সূত্রে পাওয়া গেছে উল্লিখিত তথ্য।

জানা যায়, ছাগলকাণ্ডের শুরুর দিকে পরিস্থিতি ভিন্নখাতে নিতে ইফাতকে ছেলে হিসাবে অস্বীকার করে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন মতিউর। সেখানে দাবি করেন, শেয়ারবাজার থেকে মুনাফা করে তিনি বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। তবে তার সবশেষ আয়কর নথিতে পুঁজিবাজারে মাত্র ৮২ লাখ টাকা বিনিয়োগের তথ্য উল্লেখ করেছেন। হাতে নগদ আছে ১২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এছাড়া ৫০ লাখ টাকার এফডিআর, ৩ কোটি টাকার অকৃষি সম্পত্তি এবং একটি মৎস্য খামারকে ৫০ লাখ টাকা ঋণ দেওয়া আছে তার। আয়কর নথিতে তার আর কোনো সম্পত্তির কথা উল্লেখ নেই। আয়কর ফাইলের তথ্য নেওয়ার সময় এক কর্মকর্তা হাসির ছলে বলেন, ‘পরিবারের সদস্যদের তুলনায় স্যার অত্যন্ত গরিব।’

সরেজমিন অনুসন্ধানে মতিউরের সম্পদের ভিন্নচিত্র পাওয়া গেছে। তার পারিবারিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, মতিউর, দুই স্ত্রী ও দুই পক্ষের দুই সন্তান মিলে অন্তত এক ডজন বিলাসবহুল গাড়ি ব্যবহার করেন। এর মধ্যে ৩/৪ কোটি টাকা দামের গাড়িও আছে। অথচ মতিউর ও তার স্ত্রী-সন্তানের আয়কর ফাইলে কোনো গাড়ির তথ্য নেই। জানা যায়, এ গাড়িগুলো ব্যক্তি নামে না করে স্ত্রী, ভাই ও মেয়ের মালিকানায় যেসব কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, সেসব কোম্পানির নামে রেজিস্ট্রেশন হয়েছে। এমনকি রিফাতের ব্যবহার করা প্রাডো ও প্রিমিও মডেলের যে ৪টি গাড়ি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, সেগুলোও তাদের নামে নেই। বিআরটিএ-এর নথি দেখে জানা যায়, ইফাতের ব্যবহার করা প্রাডো মডেলের গাড়িটির রেজিস্ট্রেশন এসকে ট্রিম ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডের নামে। প্রিমিও মডেলের একটি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ব্যাংকের নামে। অর্থাৎ হাতে ১৩ কোটি টাকা নগদ থাকার পরও চতুর মতিউর স্ত্রী-ছেলের ব্যবহারের জন্য গাড়ি কিনেছেন ব্যাংক ঋণে। আরেকটি গাড়ির রেজিস্ট্রেশন ৯০, মহাখালীর একটি কার শোরুমের নামে।

আরও জানা যায়, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকার ডি ব্লকের ৮ নম্বর রোডে ৫ কাঠা জায়গার ওপর অত্যাধুনিক বাড়ি বানিয়েছেন মতিউর রহমান। এ বাড়ির একটি ফ্লোরে প্রথম স্ত্রীকে নিয়ে বসবাসও করেন। বাকি অ্যাপার্টমেন্টগুলো ভাড়া দেওয়া। পরিবারের সবাই জানেন, এই বাড়ি মতিউরের টাকায় তৈরি করা। অথচ বাড়িটি কাগজে-কলমে মতিউরকন্যা ফারজানা রহমান ইপ্সিতার নামে নিবন্ধন করা হয়েছে। বেকার বখাটে ভাইয়ের নামে ফার্মগেট এলাকায় আছে গার্মেন্ট ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এগুলোও কিনেছেন মতিউরের টাকায়। ছোট স্ত্রীর নামে ধানমন্ডিতে একটি, লালমাটিয়ায় একটি, কাকরাইলে দুটিসহ আরও বেশ কয়েকটি ফ্ল্যাট কিনেছেন মতিউর। তার নামে পুঁজিবাজারে প্লেসমেন্ট শেয়ার কিনে বিপুল বিনিয়োগ করেছেন। অথচ গৃহিণী স্ত্রী শাম্মী আখতারের আয়ের কোনো উৎস নেই। পুরান ঢাকার কামরাঙ্গীরচরে এসকে থ্রেড নামে সুতা তৈরির কারখানা আর টঙ্গীতে এসকে ট্রিম ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেড নামের গার্মেন্ট সরঞ্জাম তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছেন মতিউর। এ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তার ছোট ভাই কাইয়ুম হাওলাদার। অথচ একসময় তিনি নিজেই গার্মেন্টে চাকরি করতেন। সেই কাইয়ুম বড় ভাইয়ের অর্থ ছাড়া নিজের আয় দিয়ে কয়েক শ কোটি টাকা খরচে এই শিল্পপ্রতিষ্ঠান তৈরি করা সম্ভব নয় বলে মনে করেন তার ঘনিষ্ঠরা। এছাড়াও প্রথম পক্ষের স্ত্রী, কন্যা ও ছেলের নামে ওয়ান্ডার পার্ক, পূবাইল শুটিং স্পট ও রিসোর্ট, খামারসহ বিপুল সম্পদ করেছেন। অথচ এসব প্রতিষ্ঠানের নামে যখন বিনিয়োগ করা হয়েছে, তখন স্ত্রীর সামান্য কিছু আয়ের উৎস থাকলেও ছেলে-মেয়ের কোনো আয় ছিল না। অবৈধপথে মতিউরের আয়ের টাকাই মূলত স্ত্রী-সন্তানদের নামে তৈরি করা এসব প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, এনবিআর-এর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হওয়ার সুবাদে তিনি আইনের ফাঁকফোকর সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। ফলে যে কোনো পরিস্থিতিতে আইনের জাল কেটে বের হওয়ার দুরভিসন্ধি থেকেই নিজের নামে বেশি সম্পদ করেননি। এরপরও দুদক আইনে তাকে আটকানোর অনেক পথ খোলা আছে। এক্ষেত্রে সংস্থাটির সদিচ্ছা দরকার। তদবির ও চাপের ঊর্ধ্বে থেকে কাজ করলে মতিউরের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ বের করা কোনো কঠিন কাজ নয়।

দুদকের এক কর্মকর্তা জানান, মতিউর, স্ত্রী-সন্তান, ভাই-বোনের নামে সম্পদবিবরণী নোটিশ জারি করার পর তারা নিশ্চয়ই হিসাব দাখিল করবেন। সম্পদবিবরণীর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বৈধ আয়ের উৎস মেলালেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। এছাড়া এসব প্রতিষ্ঠানের নামে মতিউর কীভাবে মানি লন্ডারিং করেছেন, তাও বেরিয়ে আসবে। কারণ, মতিউর ছাড়া পরিবারের অন্য কারও উল্লেখ করার মতো আয়ের উৎস নেই। কাজেই এসব শিল্পকারখানার বিনিয়োগ যে মতিউরের, সেটা প্রমাণ করার সুযোগ রয়েছে।

জানতে চাইলে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) জ্যেষ্ঠ গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান বলেন, ‘এটা অনেকগুলো বড় ঘটনার একটি। সুতরাং এটির একটা দৃষ্টান্তমূলক পরিণতি যদি আমরা দেখি, তদন্ত যদি স্বচ্ছভাবে হয়, তাহলে এটা একটা বড় নজির সৃষ্টি করবে।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এক্ষেত্রে সবার কাম্য হবে আলোচিত এ ঘটনার তদন্ত পর্যায়ে কোনো দীর্ঘসূত্রতার সৃষ্টি হবে না। দ্রুত তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ করা না গেলে এটি আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।’

এদিকে ছাগলকাণ্ডের ঘটনার পর মতিউর পরিবারের বিপুল সম্পদের তথ্য সামনে এলে দেশজুড়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এরপর তার সম্পদের অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। এ সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত চেয়ে বিএফআইইউ, এনবিআরসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থায় চিঠি দেওয়া হয়েছে। যদিও এর আগে আরও চারবার তার বিরুদ্ধে সম্পদের অনুসন্ধানে টিম গঠন করেছিল সংস্থাটি। প্রতিবারই অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়নি মর্মে তা পরিসমাপ্তি করা হয়েছে। তবে এবার দুদকের পাশাপাশি মতিউর পরিবারের সম্পদের তথ্য যাচাই-বাছাই করছে এনবিআর-এর কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সেলের (সিআইসি) একটি টিম। এ অবস্থায় ২৩ জুন মতিউরকে এনবিআর-এর সদস্যপদ থেকে সরিয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগে সংযুক্ত করা হয়। এরপর তাকে সোনালী ব্যাংকের পরিচালকের পদ থেকেও অপসারণ করা হয়েছে। আত্মগোপনে থাকা মতিউর ঈদের ছুটি শেষে এখনো তার কর্মস্থলে যোগ দেননি বলে জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ৬০ দিনের মধ্যে কর্মস্থলে যোগ না দিলে তাকে বরখাস্ত করার প্রক্রিয়া শুরু হবে।

প্রসঙ্গত, ঈদুল আজহার আগে মোহাম্মদপুরের বিতর্কিত সাদিক অ্যাগ্রো থেকে ১৫ লাখ টাকায় একটি ছাগল কেনেন ধানমন্ডির এক তরুণ বাসিন্দা। এই ছাগল কেনার স্থির ও ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হলে ওই তরুণের অর্থের উৎস নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। এরপর এনবিআর সদস্য মতিউর রহমান ওই তরুণের বাবা বলে খবর বের হলে দৃশ্যপটে আসেন তিনি। গণমাধ্যমে দেওয়া বক্তব্যে ছেলে তার নয় বলে দাবি করেন। কিন্তু মতিউর যে ওই ছেলের বাবা, এর প্রমাণপত্র দিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। এরপর মতিউর পরিবারের বিপুল সম্পদের তথ্য সামনে আসে। আত্মগোপনে যান মতিউর ও পরিবারের সদস্যরা। যদিও ঘটনার ১৪ দিন পর প্রথমবার বৃহস্পতিবার জনসম্মুখে আসেন তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকী। উপজেলা পরিষদের সভায় যোগ দিয়ে তাদের আর কিছু হবে না বলে দম্ভোক্তিও করেন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor