পরিবেশ বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে ঢাকা

অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবন ও নিরাপত্তা হুমকির মুখে
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা, অপরিকল্পিত নগরায়ন এবং পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে রাজধানী ঢাকা। অপর্যাপ্ত অবকাঠামো এবং সেবার ওপর অতিরিক্ত জনসংখ্যার চাপের কারণে জীবনযাপনের মান কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ, রাস্তা সম্প্রসারণ এবং জলাধার ভরাট করার কারণে নগরীর পরিবেশে ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ফলে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, বায়ু দূষণ, জলাধার কমে যাওয়ার মতো পরিবেশগত সমস্যাগুলো রাজধানী ঢাকাকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলেছে। এছাড়া অনুমোদনবিহীন ও দুর্বল কাঠামোর ভবন ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরি করছে। সেই সঙ্গে দুর্নীতি ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব পরিস্থিতি আরও খারাপ করছে। এই সমস্যাগুলোর সমাধানে সমন্বিত পরিকল্পনা ও কার্যকর পদক্ষেপ এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা প্রয়োজন বলে জানান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
সম্প্রতি চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের এক গবেষণার দেখা গেছে, গত ৪৪ বছরে নানা অব্যবস্থাপনার কারণে বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়েছে রাজধানী ঢাকা। গত ৪৪ বছরের স্যাটেলাইট চিত্র ও নগর তাপমাত্রা বিশ্লেষণের ভিত্তিতে এই গবেষণায় ঢাকার পরিবেশগত অবক্ষয়ের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৮০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা বেড়েছে সাত গুণ। ভূমির তাপমাত্রা বেড়েছে ৩ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। হারিয়ে গেছে ঢাকার ৬০ শতাংশ জলাধার। অবশিষ্ট আছে মাত্র ৪.৮ শতাংশ এলাকায় জলাধার। আর ঢাকার সবুজ আচ্ছাদন ২১.৬ শতাংশ থেকে কমে পৌঁছেছে মাত্র ১১.৬ শতাংশে।
রাজধানী ঢাকার পরিবেশগত এমন ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে ‘প্রকৃতিবিহীন ঢাকা? প্রাকৃতিক অধিকারভিত্তিক টেকসই নগর ভাবনার পুনর্বিচার’ শীর্ষক প্রতিবেদনে। গবেষণায় দেখা গেছে, এটি শুধু নগর পরিকল্পনার ব্যর্থতা নয়, এটি এক ধরনের পরিবেশগত অবিচার এবং মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন। যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবন ও নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে। রাজধানীর আদাবর, রামপুরা, কাফরুল, বংশাল ও ওয়ারী এলাকায় গাছ নেই বললেই চলে। আর জলশূন্য ঢাকার সূত্রাপুর, মিরপুর, গেণ্ডারিয়া, কাফরুল এলাকা। ঢাকার গরমের হটস্পট শ্যামপুর, হাজারীবাগ, তেজগাঁও, রামপুরা ও দারুসসালাম।
গবেষণাটির পরিচালক ও চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসাইন খান বলেন, ‘২০৩৫ সালের মধ্যে ঢাকায় ২ দশমিক ৫ কোটি মানুষের বসবাস হবে। উন্নয়নের নামে ঢাকার প্রকৃতি প্রায় ধ্বংস। বায়ুদূষণের কারণে ঢাকায় ইনহেলার বিক্রির পরিমাণ আশঙ্কাজনক বেড়েছে। দিল্লি ও জাকার্তা শহরের চেয়ে ঢাকার বায়ুদূষণ বেশি। শুধু করাচি ঢাকার নিচে।’ ঢাকাকে রক্ষা করতে হলে সিংগাপুরের মতো প্রকৃতিভিত্তিক মডেল গ্রহণ করার পরামর্শ দিয়েছেন এই গবেষক। প্রকৃতির অধিকার আইনগতভাবে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং প্রাকৃতিক অধিকারভিত্তিক শাসনব্যবস্থা অবিলম্বে কার্যকর করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন তিনি।
গবেষণায় বলা হয়েছে, যদি রাজধানীর প্রতি বাসিন্দার জন্য অন্তত ৯ বর্গমিটার গাছপালা ও ৪.৫ বর্গমিটার জলাধার সংরক্ষণ করা যায়, তবে শহরের গড় ভূমির তাপমাত্রা প্রায় ১.০১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা কমানো সম্ভব।
ঢাকার ৫০টি থানার মধ্যে ৩৭টি ইতিমধ্যেই নিরাপদ নির্মাণসীমা অতিক্রম করেছে। প্রাকৃতিক সম্পদের বৈষম্যমূলক বণ্টনে উত্তরখান ও তুরাগ শহরের প্রান্তিক অঞ্চল হওয়ায় এখনো কিছুটা সবুজ অঞ্চল ও জলাধার ধরে রেখেছে। তবে ওয়ারী, বংশাল, কোতোয়ালিসহ ঘনবসতিপূর্ণ কেন্দ্রীয় এলাকাগুলো প্রায় সম্পূর্ণ প্রকৃতিবিচ্ছিন্ন।
গবেষণায় সহায়তাকারী সাবরিন সুলতানা বলেন, ‘ঢাকা সংকটকে শুধু পরিবেশগত অবক্ষয় নয়, বরং প্রকৃতির মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের একটি রূপ হিসেবে উপস্থাপন করেছে। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য প্রকৃতির বেঁচে থাকা অপরিহার্য। এটি শুধু নগর পরিকল্পনার ব্যর্থতা নয়, এক ধরনের পরিবেশগত অবিচার এবং মৌলিক অধিকারের লঙ্ঘন, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবন ও নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলছে। নগর নয়, এবার প্রকৃতির অধিকার নিশ্চিত করাই হোক ঢাকার টেকসই ভবিষ্যতের মূল ভিত্তি।’