পর্দার অন্তরালে কী ঘটছে ?
সমঝোতা নাকি সঙ্ঘাত
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বিশ্বের বেশ কয়েকটি প্রভাবশালী দেশ ও সংস্থার তৎপরতা দৃশ্যমান হচ্ছে। বিশেষ করে প্রভাবশালী রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা চোখে পরার মতো। ইতোমধ্যে এই দেশটির রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সরকার, সরকারি দল আওয়ামী লীগ, সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ও মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করছেন। এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর রাষ্ট্রদূতরাও। তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং নিজেদের মধ্যে বৈঠক করে যাচ্ছেন। এসব বৈঠকে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে আগামী নির্বাচন।
এ মাসেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইইউভুক্ত দেশ থেকে একাধিক প্রতিনিধিদল আসছেন। তাদের মূল বিষয় আগামী নির্বাচন নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করা। সাথে থাকবে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করে নির্বাচন নিয়ে একটি সমঝোতার পথ বাতলে দেয়া।
ইতোমধ্যে নির্বাচন সামনে রেখে বিদেশীদের এই তৎপরতা দেশের মানুষের মধ্যে আগ্রহ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। রাজনৈতিক অঙ্গনসহ সর্বমহলে কৌতূহল এখন, আসলে হচ্ছেটা কী। পর্দার অন্তরালে কী ঘটছে? আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে, সংশোধিত সংবিধানের আলোকে দলীয় সরকারের অধীনে হবে নাকি অন্যকোনো ফর্মুলায় হবে? বিএনপির সাথে আওয়ামী লীগের সমঝোতা হবে, নাকি আবারো সঙ্ঘাতের দিকে যাবে দেশ? এসব নানা প্রশ্নও দেশের মানুষের মধ্যে প্রতিনিয়ত ঘুরপাক খাচ্ছে।
নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালের ১০ মে সুপ্রিম কোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিলের রায় দেয়। এ রায়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী করা হয়। যার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হয়ে যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বাতিল হওয়ার পর থেকেই তা পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে বিএনপি ও তার মিত্ররা। ইতোমধ্যে ২০১৪ সালের ৫ জুন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন এবং ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও তার মিত্ররা অংশগ্রহণ করেনি। আর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি ও তার মিত্ররা অংশগ্রহণ করলেও ভোটগ্রহণের দিন কারচুপির অভিযোগ এনে বর্জন করেছিল। বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে অভিযোগ রয়েছে রাতেই ব্যালট বাক্স ভর্তি করার ফলে দুটো নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় এলেও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা রয়ে যায়।
এ দিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল না করার জন্য অনড় অবস্থানে রয়েছে সরকার। অপর দিকে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহালের দাবি না মানায় একদফার সরকার পতন আন্দোলনের ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি ও তার মিত্ররা। দুদলের এই অনড় অবস্থানের কারণে দেশ আবারো সঙ্ঘাতের দিকে যাচ্ছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞমহল। তবে দুই দলের দীর্ঘদিনের টানাপোড়েন সম্পর্কের বরফ গলাতে বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নয়ন সহযোগী কয়েকটি রাষ্ট্র ও সংস্থা। ঈদুল ফিতরের ছুটি কাটিয়ে ঢাকায় আসার পর বুধবার ব্যস্ত সময় পার করেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস। এ দিন তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দুই দফায় প্রায় দেড় ঘণ্টা বৈঠক করেন। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ড. মসিউর রহমান ও মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার সাথে তিনি এ বৈঠক করেন। তবে তাদের মধ্যে কী বিষয়ে আলোচনা হয়েছে তা জানা যায়নি। এর আগে সকালে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস রাজধানী ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলির গুলশানের বাসায় পশ্চিমা কূটনীতিকদের সাথে চা-চক্রে যোগ দেন। এতে পিটার হাসসহ ১২ দেশের রাষ্ট্রদূত ও হাইকমিশনাররা অংশ নেন।
এর আগে গত বুধবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস। সেখানে নিজের চলাচলের নিরাপত্তা এসকর্ট কেন আচমকা প্রত্যাহার হলো- সে বিষয়ে জানতে চান তিনি। সেই সাথে বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে যুক্তরাষ্ট্র ঘোষিত স্বতন্ত্র ভিসানীতি নিয়ে আলোচনা করেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়াও মার্কিন ভিসানীতি ঘোষণার পর সম্প্রতি একাধিকবার পিটার ডি হাসের আমন্ত্রণে বৈঠক করে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি। সেখানেও আগামী নির্বাচন কিভাবে হবে সে বিষয়ে আলোচনা হয় বলে জানা গেছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার আগামী ১১ থেকে ১৪ জুলাই ঢাকা সফর করার কথা রয়েছে। মার্কিন প্রতিনিধিদলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে থাকবেন মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু। চলতি জুলাই মাসে একাধিক বিদেশী প্রতিনিধিদল ঢাকা সফর করার কথাও রয়েছে। এর মধ্যে ঢাকায় রয়েছেন ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) সৌরভ কুমার। আগামী সপ্তাহে মার্কিন প্রতিনিধিদল আসবে। এ ছাড়া ইইউর নির্বাচন সংক্রান্ত অনুসন্ধানী অগ্রগামী দল এবং মানবাধিকার বিষয়ক ইইউর বিশেষ প্রতিনিধি ইমন গিলমোর ঢাকায় আসবেন বলে সূত্র জানিয়েছে। এ প্রসঙ্গে গতকাল বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হতে পারে এবং আমি এটি বাদ দিচ্ছি না। কিন্তু এটি নির্বাচনকেন্দ্রিক সফর, এটি ভাবাও ঠিক হবে না। তিনি বলেন, অনেক সময় তিনটি বা চারটি প্রতিনিধিদল আসে। এর মানে এই নয় যে আগে থেকে সমন্বয় করে তারা সময়টি ঠিক করে আসে। সুতরাং এখানে বেশি চিন্তা করার কিছু নেই। এগুলোর তারিখ আগে থেকে ঠিক করা থাকে।
জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিদেশী কূটনীতিক ও সংস্থার তৎপরতা প্রসঙ্গে সাবেক জজ, সংবিধান ও রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ ইকতেদার আহমেদ মনে করেন, এ দেশে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হয় না, তা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ও ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে। ওই দু’টি নির্বাচনই বর্তমান সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং দু’টি নির্বাচনই বিতর্কিত হওয়ায় দেশে ও বিদেশে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে বিদেশীদের কাছে গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় আগামী নির্বাচন সামনে রেখে তারা বেশ তৎপর হয়ে উঠেছে। বিদেশীরা চায়, এ দেশের আগামী নির্বাচন আন্তর্জাতিক মানের হোক। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাক। তিনি আরো বলেন, গত দু’টি নির্বাচন নিয়ে বিদেশীদের অনেক অভিযোগ আছে। এ জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিরা সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের লোকজনের সাথে বৈঠক করে ওই অভিযোগগুলো তুলে ধরছে। তারা চায়, আগামী নির্বাচনে যেন ওই অভিযোগের পুনরাবৃত্তি না ঘটে। পাশাপাশি আগামী নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক হয় সেজন্য সরকারের ওপর তারা চাপপ্রয়োগ করছে। এ জন্য নির্বাচনকে সামনে রেখে তারা বেশি তৎপর হয়ে উঠেছে এবং এ দেশে ঘন ঘন সফর করছে বলে আমি মনে করি।