Bangladesh

পর্দার আড়ালে জাতীয় সরকারের নীলনকশা?

বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখন প্রধান প্রশ্ন হলো জাতীয় সংসদ নির্বাচন কবে? এ ইস্যুতে এখন পর্যন্ত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বর্তী সরকারের কোনো সুস্পষ্ট অবস্থান নেই। নির্বাচনের বদলে দেশে চলছে সংস্কার সংস্কার খেলা। 

জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এক মাস ধরে বৈঠক করে বলল, ‘এখন দ্বিতীয় রাউন্ড বৈঠক হবে’। বৈঠকের নামে এ তামাশার মানে যে কালক্ষেপণ তা বুঝতে কারও অসুবিধা নেই। ২ জুন শুরু হলো দ্বিতীয় দফা সংলাপ। এ সংলাপ নাটকের শেষ কোথায়? 

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ নির্বাচন আদৌ হবে কি না তা নিয়ে এখন সন্দেহ ক্রমে ঘনীভূত হচ্ছে। 

বিএনপির পক্ষ থেকে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে, না হলে বাংলাদেশে নির্বাচন হবে না।’

বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হতে হবে। তার আগেও প্রয়োজনে নির্বাচন করা সম্ভব।’ কিন্তু বিএনপি যাই বলুক না কেন, এখন পর্যন্ত নির্বাচনের পথে যাওয়ার জন্য যে প্রস্তুতি এবং পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার তার কোনো কিছুই শুরু হয়নি সরকারের পক্ষ থেকে। 

যখন দেশের ভবিষ্যৎ নির্বাচন, রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে নানা রকম অনিশ্চয়তা ঠিক সেই সময় পর্দার আড়ালে চলছে একটি জাতীয় সরকার গঠনের নানা রকম আয়োজনের কথা। বিভিন্ন মহলে জাতীয় সরকার নিয়ে নানা রকম তৎপরতার কথা কান পাতলেই শোনা যায়।

সাম্প্রতিক সময়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবে জাতীয় সরকারের প্রস্তাব দিয়েছেন সুশীল সমাজের একটি অংশ। এ নিয়ে রাজনীতিতে নানামুখী চাপা আলোচনা চলছে। প্রকাশ্যে কেউই এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে আগ্রহী নয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর প্রথম জাতীয় সরকার প্রসঙ্গটি এসেছিল। সেই সময় বিভিন্ন মহল থেকে জাতীয় সরকার গঠনের জন্য একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বিএনপি সেই সময়ে সরাসরি জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। বর্তমান উপদেষ্টা পরিষদের অন্তত দুজন সদস্য এ নিয়ে তাদের নতুন প্রকাশিত বইয়েও জাতীয় সরকারের উদ্যোগের কথা লিখেছেন। 

বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, এ রকম জাতীয় সরকারে তারা যেতে ইচ্ছুক নয়, বরং একটি নিরপেক্ষ অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠিত হওয়া উচিত, যে সরকারের তত্ত্বাবধানে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। বিএনপির এই অবস্থান ছিল দূরদর্শী এবং রাজনৈতিকভাবে একটি পরিপক্ব সিদ্ধান্ত। বিএনপির এই অবস্থানের কারণে শেষ পর্যন্ত জাতীয় সরকার গঠিত হয়নি। বিভিন্ন মহল বলছে যে সে সময় জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাবে রাজি ছিল জামায়াত এবং হেফাজতের মতো রাজনৈতিক দলগুলো।

জাতীয় সরকারের দ্বিতীয় উদ্যোগটি গ্রহণ করা হয়েছিল অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার ঠিক তিন মাস পর। যখন বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে অব্যাহতি দেওয়ার দাবি তুলেছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ আরও কিছু সংগঠন। তারা এ নিয়ে বঙ্গভবন ঘেরাওয়ের কর্মসূচিও পালন করেছিল। কিন্তু এই সময় অন্তর্র্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল যে, খুব শিগগিরই রাষ্ট্রপতির অপসারণের বিষয়টি তারা বিবেচনা করে দেখছে। 

এ সময় আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল এবং তৎকালীন তথ্য ও প্রযুক্তি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম প্রধান বিচারপতির সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাংবিধানিক শূন্যতা হবে এ রকম আশঙ্কা থেকে রাষ্ট্রপতি অপসারণ সম্ভব হয়নি। রাষ্ট্রপতি অপসারণ নিয়ে বিএনপিও আপত্তি জানায়। 

বিএনপির নেতা সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সেই সময় রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের ব্যাপারে আমরা বিরোধিতা করেছিলাম। কারণ এতে দেশে একটি সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি হতো। রাষ্ট্রপতি অপসারণের দাবিতে যখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নতুন করে কর্মসূচি দিয়েছে, সেই সময়ে বিএনপির পক্ষ থেকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে তাদের অবস্থান জানিয়ে দেন। কোন পরিপ্রেক্ষিতে তারা এ অবস্থান গ্রহণ করেছেন সেটিও স্পষ্ট করেন। শেষ পর্যন্ত বিএনপির অবস্থানের কারণেই সেই সময় রাষ্ট্রপতির অপসারণ হয়নি। রাষ্ট্রপতি অপসারণের বিষয়ে মূল পরিকল্পনা ছিল ড. ইউনূসের নেতৃত্বে একটি সর্বদলীয় জাতীয় সরকার। রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন এবং একটি জাতীয় সরকারের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে। ড. ইউনূসের এ ব্যাপারে আগ্রহ ছিল বলে জানা যায়।

ইদানীং এখন আবার নির্বাচন পিছিয়ে একটি জাতীয় সরকারের মাধ্যমে আরও কয়েক বছর সেই জাতীয় সরকারকে ক্ষমতায় রাখার একটি প্রস্তাব নিয়ে নানা মহলে আলাপ-আলোচনা চলছে। সরকারের একটি অংশের এ নিয়ে প্রবল আগ্রহ বলেও একাধিক সূত্র জানিয়েছে। বিভিন্ন দূতাবাসেও এ আলোচনা চলছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলকে শতাংশ হিসেবে সরকারের হিস্সা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে একাধিক সূত্র জানিয়েছে। 

জাতীয় সরকারের প্রধান হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে, যিনি রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করবেন। বিএনপি থেকে ২৫ শতাংশ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন বা এখন জাতীয় নাগরিক কমিটি থেকে ২৫ শতাংশ এবং জামায়াত এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দল থেকে আনুপাতিক হারে মন্ত্রিসভায় সদস্য নিয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব এখন নানা মহলে আলোচনার বিষয়। কিন্তু বিএনপি এবারও এ ধরনের প্রস্তাবে রাজি নয়। 

বিএনপির একজন স্থায়ী কমিটির সদস্য বলেছেন, ‘এই সরকার গত ১০ মাসে জনগণকে হতাশ করেছে। সঠিক সমাধান করতে পারেনি। এখন যদি আবার একটি জাতীয় সরকার গঠিত হয়, তাহলে সমস্যা আরও জটিল হবে এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।’ 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির ওই সদস্য মনে করেন যে, বিএনপি এখন এসব ব্যর্থতার দায় নিতে চায় না। বিএনপি নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সুস্পষ্টভাবে বলেছেন যে, ‘এখন দরকার একটি নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। কারণ এ সময়ের মধ্যে এটি প্রমাণিত হয়েছে যে একটি অনির্বাচিত সরকার দেশের যে চলমান সমস্যা সংকট সেই সংকট নিরসন করতে অক্ষম। আর এ কারণেই অন্তর্র্বর্তী সরকারের উচিত দ্রুত জাতীয় নির্বাচন দেওয়া।’

অনেকেই মনে করছেন যে, ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে রেখে সব দলের অংশগ্রহণে একটি সরকার গঠনের ব্যাপারে কোনো কোনো আন্তর্জাতিক মহল আগ্রহী। তাদের আগ্রহের কারণেই জাতীয় সরকার নিয়ে বিভিন্ন মহলের তৎপরতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কিন্তু এই আগ্রহের ব্যাপারে সম্মতি নেই বিএনপির। এখানেই বিএনপির সঙ্গে অন্তর্র্বর্তী সরকারের দূরত্ব বলে অনেকে মনে করছেন। বিএনপি দ্রুত একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় সংসদ নির্বাচন চায়। নির্বাচনে যারা জয়ী হবে তাদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর চায়। কিন্তু ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার উপদেষ্টামণ্ডলীর অনেকেই এই মতের সঙ্গে একমত নন। 

সদ্য গঠিত জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এখন কোনো অবস্থাতেই নির্বাচনের পক্ষে নয়। এনসিপির একাধিক নেতার সঙ্গে কথা বলে দেখা গেছে বিচার ও সংস্কারের কথা বললেও আসলে সংগঠন গোছানোর জন্য তারা জাতীয় নির্বাচন অন্তত তিন বছর পরে চায়। এ জন্যই সংস্কারও বিচার প্রসঙ্গ তারা সামনে এনেছে। এনসিপির এখনকার দাবি আগে সংস্কারগুলো চূড়ান্ত করতে হবে। চূড়ান্ত সংস্কারের পর নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। যে সংস্কারগুলো হয়েছে সে সংস্কার প্রশ্নে একটি গণভোট করতে হবে। গণভোটের পরিপ্রেক্ষিতে জুলাই সনদ চূড়ান্ত হবে। এই জুলাই সনদের ভিত্তিতে একটি নতুন সংবিধান প্রণীত হবে এবং সেই সংবিধান চূড়ান্ত করার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। গণপরিষদ নির্বাচনের পরই কেবল জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে পারে। এই ভাবনায় সরকারের সমর্থন আছে বলেও জানা যায়। 

এ জন্য সরকার নির্বাচনের রোড়ম্যাপে আগ্রহী নয়। ফলে রাজনীতিতে একটি জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এই জটিল পরিস্থিতি যেন না হয় সেজন্য কোনো কোনো মহল জাতীয় সরকার গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে বলে সূত্র দাবি করছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে রাষ্ট্রপতি করে এরকম একটি জাতীয় সরকার গঠন করে রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ সহজ বলেও এনসিপির নেতারা মনে করেন।

জাতীয় নাগরিক পার্টির এখন পর্যন্ত রাষ্ট্রপতিকে মেনে নেননি। ড. মুহাম্মদ ইউনূসও রাষ্ট্রপতির ব্যাপারে নেতিবাচক। তিনি দায়িত্ব গ্রহণের পর দুটি শপথ অনুষ্ঠান ছাড়া কখনোই বঙ্গভবনে যাননি এবং রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেননি। এমনকি বিদেশ থেকে ফিরে প্রধান উপদেষ্টা রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করার যে রীতি রেওয়াজ, সেটিও তিনি উপেক্ষা করেছেন। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ২৬ মার্চ এবং ১৬ ডিসেম্বরে জাতীয় স্মৃতিসৌধে পুষ্পস্তবক অর্পণ করলেও তাদের স্বাভাবিক সৌজন্য বিনিময় বন্ধ ছিল। 

এমনকি গত ঈদে প্রধান উপদেষ্টার আপত্তির কারণে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি জাতীয় ঈদগাহ ময়দানে নামাজ আদায় করতে চাননি। অর্থাৎ বর্তমানে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান থেকেও নেই। তিনি অকার্যকর অবস্থায় আছেন। আর এই সুযোগটি নিতে চায় কোনো কোনো মহল। তারা মনে করেন যে একটি জাতীয় সরকার গঠন করলে রাষ্ট্রপতিকে হটানো খুবই সহজ। 

যদি ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাষ্ট্রপতি হন, তাহলে তিনি সহজেই জুলাই সনদসহ জুলাই বিপ্লবের আকাঙ্ক্ষাগুলো পালন করতে পারবেন। তবে বিএনপিসহ বেশ কিছু রাজনৈতিক দল মনে করছে যে এটি আসলে অন্তর্র্বর্তী সরকারের ক্ষমতায় টিকে থাকার একটি অপকৌশল। এর মাধ্যমে তারা দীর্ঘদিন ক্ষমতা আঁকড়ে থাকতে চায়। কিন্তু জনগণ সেটি পছন্দ করবে না। 

বিএনপির নেতারা মনে করছেন, এরকম উদ্যোগ নেওয়া হলে জনগণ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠবে। আবার নতুন করে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন শুরু করতে হবে। শেষ পর্যন্ত কি বাংলাদেশে জাতীয় সরকার গঠিত হবে নাকি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে? এ প্রশ্নের সমাধান চলছে। মাঠে না এখন রাজনীতি হচ্ছে কূটনৈতিক পাড়ায় আর ড্রইং রুমে। এদেশের জনগণের ভাগ্য নির্ধারণে আর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। পর্দার আড়ালে ওপর নির্ভর করছে আসলে বাংলাদেশে কী হবে। যদি বিএনপি নির্বাচনের দাবিতে বড় ধরনের জনমত তৈরি করে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে না পারে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
bacan4d