Trending

পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার মধ্যেও বিলাসবহুল গাড়ির অফুরান চালান যেভাবে পাচ্ছে রাশিয়া

জার্মানির প্রভাবশালী পররাষ্ট্রনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান – জার্মান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স এর বিশেষজ্ঞ বেঞ্জামিন হিলগেনস্টক বলেন, ‘ককেশাস ও মধ্য এশিয়া হয়ে এসব পণ্য রাশিয়ায় যাচ্ছে এর পরিস্থিতিগত প্রমাণ রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন-সহ অন্যান্য দেশের বাণিজ্যিক তথ্যে যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।’

যুদ্ধাস্ত্র তৈরির উন্নত উপকরণ হোক, বা বহুমূল্য ঘড়ি, অলঙ্কার ও বিলাসবহুল গাড়ির মতো –  রুশ ধনীদের পছন্দের বিলাসপণ্য; এগুলো রাশিয়ায় আসার কথাই নয়। তবু অবাধেই ঢুকছে কিছু দেশের সঙ্গে রুশ সীমান্ত দিয়ে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পরে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন – রাশিয়ায় এধরনের পণ্য রপ্তানিতে যে নিষেধাজ্ঞা দেয়– এখন যেন তা অকার্যকর হয়ে পড়ছে। ফলে যুদ্ধের প্রায় তিন বছর পরেও নাগালের মধ্যে বিলাসপণ্য পেতে কোনো সমস্যা  হচ্ছে না রুশ ধনীদের।

ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর আগে পশ্চিমা অনেক বিলাসপণ্যের নিজস্ব শোরুম ছিল রাশিয়ায়। যুদ্ধ শুরু হলে ব্যবসা গুটিয়ে চলে যায় তারা। প্রথমেই যারা যায় তাদের মধ্যে ছিল হার্মিস ও ল্যুই ভিঁতোর মতো দামি ব্রান্ড। এরপরে বিলাসবহুল গাড়ি উৎপাদক মেবাখ ও রোলস-রয়েসএর ডিলাররাও ব্যবসায় তালা ঝোলায়। ফলে বেকার হয়ে পড়ে তাঁদের রুশ কর্মীরা। তবে এই অচলাবস্থা অল্প সময়ই স্থায়ী হয়। 

কিছুদিন পর থেকেই গোপনে উচ্চ মানের এসব পণ্য রাশিয়ায় লাগাতারভাবে আসা শুরু করে। আন্তর্জাতিক কাস্টমসের সুত্রগুলো বলছে, দুটি উৎসে এসব পণ্য ব্যাপকভাবে যাচ্ছে; এগুলো হলো – রাশিয়ার দুই প্রতিবেশী দেশ কাজাখস্তান ও জর্জিয়ায়। অথচ এ দুটি দেশে এত বিলাসপণ্যের চাহিদা কখনোই ছিল না, এবং তাদের অর্থনীতির বিচারে তেমনটা হওয়ার প্রশ্নই আসে না। তাহলে যাচ্ছে কোথায়? উত্তর হচ্ছে, এসব দেশ হয়ে পণ্যগুলির চূড়ান্ত গন্তব্য হচ্ছে রাশিয়া। 

জার্মানির প্রভাবশালী পররাষ্ট্রনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান – জার্মান কাউন্সিল অন ফরেন রিলেশন্স এর বিশেষজ্ঞ বেঞ্জামিন হিলগেনস্টক বলেন, ‘ককেশাস ও মধ্য এশিয়া হয়ে এসব পণ্য রাশিয়ায় যাচ্ছে এর পরিস্থিতিগত প্রমাণ রয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন-সহ অন্যান্য দেশের বাণিজ্যিক তথ্যে যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘পণ্যগুলোর উৎপাদকরা তাদের বিতরণ ব্যবস্থা সঠিকভাবে মনিটর করছে না। এটা করার তেমন তাগিদও তাদের নেই।’

ব্রুকলিন ইনস্টিটিউটের গবেষক রবিন ব্রুকস বলেন, ‘কী ঘটছে তা তলিয়ে দেখুন, (পুনঃ রপ্তানি) দমন করা কেবল রাজনৈতিক সদিচ্ছার বিষয় মাত্র।’

প্রায় দুই বছর আগে রাশিয়ায় দামি অলঙ্কার ও ৫০ হাজার ডলারের বেশি দামের গাড়ি বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দেয় ইইউ। তবে সঙ্গেসঙ্গেই বিকল্প উপায়ে এসব পণ্য রাশিয়ায় রপ্তানির উপায়ও তৈরি হয়। শুরুতে এগুলো রপ্তানির জন্য তুরস্ককে ট্রানজিট দেশ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। পরে দ্বিতীয় রুট হয়ে ওঠে বেলারুশ – যে দেশটির সরকার মস্কোর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। নিষেধাজ্ঞার নতুন প্যাকেজের মাধ্যমে এসব ফাঁকফোকর বন্ধ করতে গত গ্রীষ্মে উদ্যোগ নেয় ইইউ। কিন্তু, তাতে বেলারুশের মাধ্যমে রপ্তানি কতোটা কমেছে, বা আদৌ কমেছে কিনা – তা এখনও অজানা। 

তবে বর্তমানে রাশিয়ায় পুনঃরপ্তানির সবচেয়ে বড় ফাঁকটা হচ্ছে আরো দক্ষিণে – জর্জিয়া, আজারবাইজান ও কাজাখস্তান হয়ে। জর্জিয়ার একটি সচিত্র সাংবাদিকতামূলক পোর্টাল আইফ্যাক্ট এর সাম্প্রতিক অনুসন্ধানে রাশিয়ার সাথে দেশটির সীমান্তকে ‘যানবাহন সমাগমের বেহেশত’ বলে টিপ্পনি কাটা হয়। ককেশাস পর্বতমালার এসব সীমান্তপথে রাজকীয় চালে ছুটতে দেখা যায় পোরশে ও ল্যাম্বারগিনির মতো ব্যাপক দামি গাড়ি, সীমান্ত অতিক্রম করে চলে যায় রাশিয়ায়– প্রকৃত মালিকদের হাতে।   

এই বাণিজ্য ব্যবস্থা খুবই সুনিয়ন্ত্রিত। এখানে মূল ক্রীড়ানক হলেন গাড়ির চালক, বা যিনি সেটি চালিয়ে পৌঁছে দেন। তার ওপর সম্পূর্ণ আস্থা রেখে অর্ডার দেন রুশ ক্রেতা। এরপর সেই চালক তার নিজের নামে গাড়িটি জর্জিয়ার বাইরে কোথাও রেজিস্ট্রেশন করান এবং একটি বিমা পলিসিও নেন। জর্জিয়া ও রাশিয়ার প্রাকৃতিক সীমানা নির্দেশ করেছে ককেশাস পর্বতমালা, যেখানে মূল চলাচলের পথ হচ্ছে লার্স পাস। এই গিরিপথ পাড়ি দেওয়ার পরে গাড়িটি প্রকৃত মালিকের কাছে অথবা তার প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তর করে জর্জিয়ায় ফিরে আসেন। আবার নতুন অর্ডার পেলে একইভাবে পৌঁছে দেওয়া হয়।   

জর্জিয়া থেকে আসার পর গাড়িগুলো নিয়ে যাওয়া হয় – মস্কো বা সেন্ট পিটাসবার্গের মতো বড় শহরগুলিতে – যেখানে বেশিরভাগ রুশ ধনীর বসবাস। মস্কো যেতে পাড়ি দিতে হয় ১৮শ’ কিলোমিটার ও সেন্ট পিটাসবার্গে যেতে ২৫শ’ কিলোমিটার। এই পুরো পথে গাড়ির অন্যান্য চালক, মধ্যস্বত্বভোগী ও সরকারি কর্মকর্তাদের আকর্ষণীয় এই বাণিজ্যের থেকে ডলার, ইউরো, রুবল ইত্যাদিতে অর্থ প্রদান করা হয়। অসাধু এই বাণিজ্যে লাভবান হছে সবাই, কেবল ইউক্রেন বাদে। 

বর্তমানে জর্জিয়ায় এক লাখের বেশি রুশ নাগরিক বসবাস করেন। যাদের বেশিরভাগই সেনাবাহিনীতে ভর্তি এড়াতে পালিয়ে এসেছেন জর্জিয়ায়, তবে এরা সবাই যে পুতিন-বিরোধী তেমন কিন্তু নয়। তারা ইউক্রেনে যুদ্ধে যেতে ভয় পান, কিন্তু রাশিয়ার প্রতি আনুগত্য ষোলআনাই রয়েছে অনেকের।

জর্জিয়ার বিরোধী দলের এক নেতা সম্প্রতি অভিযোগ করেন, ‘গত ৩০ বছরে জর্জিয়ায় রাশিয়ানরা যত ব্যবসা খুলেছে, তার চেয়ে বেশি খুলেছে গত দুই বছরে।’ আইফ্যাক্টের অনুসন্ধানে জানানো হয়, এসব প্রতিষ্ঠানের অনেকেই রাশিয়ার সাথে গাড়ির বাণিজ্যে জড়িত।

জর্জিয়া ও রাশিয়ার মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো গাড়ির ব্যবসা নেই। তিবলিসির সরকার যদিও মস্কোর বিরুদ্ধে কোনো নিষেধাজ্ঞা দেয়নি। তবে গত বছর দেশটি থেকে প্রতিবেশী রাশিয়ায় গাড়ি পুনঃরপ্তানি নিষিদ্ধ করে।

দেশটির পার্লামেন্টের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক কমিটির প্রধান নিকোলাজ সামখার্জে স্পেনের গণমাধ্যম এল পাইসকে এবিষয়ে বলেন, “রাশিয়ার বিরুদ্ধে কোনো আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাকে পাশ কাটাতে জর্জিয়ার ভূখণ্ড ব্যবহার করা হোক– আমরা তা চাই না।” তবে ২০১২ সাল থেকে জর্জিয়ান সরকারে রয়েছে তাঁর দল এবং এই দলটির বিরুদ্ধে রাশিয়ার সাথে সখ্যতা বাড়ানোর অভিযোগ রয়েছে।

এমতাবস্থায় লার্স পাসে দামি দামি সব যানবাহনের চলাচল সম্পর্কে জানতে চাইলে এই রাজনীতিবিদ বলেন, এগুলো আর্মেনিয়ান (সেদেশে নিবন্ধন করা) গাড়ি। তখন এল পাইস পাল্টা প্রশ্ন করে, কিন্তু সবাই জানে প্রকৃতপক্ষে এগুলো আর্মেনিয়ান নয়। তখন সামখার্জে বলেন, আসলে গাড়িগুলো যখন আমাদের কাস্টমসে আসে, তখন দেখা যায় সেগুলোর কাগজপত্র সব করানো হয়েছে আর্মেনিয়ায়। ফলে আর্মেনিয়ার গাড়িকে রাশিয়ায় যেতে আমরা বাধা দিতে পারি না।   

এই বাণিজ্য জর্জিয়ার সরকারি বাণিজ্য পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত হয় না। তবে দেশটির জাতীয় পরিসংখ্যান দপ্তরের তথ্যে, জর্জিয়া থেকে গাড়ি রপ্তানি ব্যাপকভাবে বাড়তে দেখা গেছে, অথচ এই দেশটিতে দামি কার উৎপাদনকারী নয়। 

তথ্য বলছে, ২০১২ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ককেশাস অঞ্চলের এই দেশটি বছরে গড়ে ৫০ হাজার গাড়ি রপ্তানি করেছে, ২০২২ সালে (ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পরে) যা উন্নীত হয় ৮০ হাজারে, এবং গত বছরে রপ্তানি করেছে ১ লাখ ৮ হাজার কার। পুনঃরপ্তানির এই বাণিজ্য থেকে আগে প্রতি বছরে মাত্র ৪৩ কোটি ডলার আয় করতো জর্জিয়া, যা এখন ২১৬ কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এই তথ্য ইঙ্গিত দেয় যে, পুনঃরপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতিটি গাড়ির দাম উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি রাখা হচ্ছে। 

এই পুনঃরপ্তানি করা গাড়ির বড় অংশ আবার যাচ্ছে আর্মেনিয়া, আজারবাইজান ও কিরগিজস্তান হয়েও। এই দেশগুলো রাশিয়াকে নিষেধাজ্ঞার আওতায় থাকা পশ্চিমা পণ্য সরবরাহ করছে। আর সেটা জর্জিয়ার সরকারও জানে। 
 
নিকোলাজ সামখার্জে বলেন, ‘এসব গাড়ি এখন জর্জিয়ায় আমদানি করে আনার পর পুনঃরপ্তানি হচ্ছে মধ্য এশিয়া ও প্রতিবেশী ককেশাস দেশগুলোতে। এরপর এসব দেশ থেকে সেগুলো রাশিয়ায় পাঠানো হচ্ছে। এখানে আমাদের কোনো দায় নেই।”

চোরাচালান 

রাশিয়ার ওতক্রিতিয়ে ব্যাংক ও অ্যাভতোমার্কেটলগ চ্যানেলের এক গবেষণা অনুযায়ী, রাশিয়ায় আমদানি করা গাড়ির ৮ শতাংশ চোরাইপথে আসে। তবে এসব গাড়ির বেশিরভাগই হচ্ছে অত্যন্ত দামি। যেকারণে দেশটির অনলাইন বিক্রিবাট্টার পোর্টালে চোখ বুলালেই দেখা যায়, কম বা মাঝারি দামের গাড়ি কেনার দিকে ধনীদের তেমন ঝোঁক নেই। তাঁদের যত ঝোঁক বিলাসবহুল ইউরোপীয় ও উচ্চ মানের চীনা গাড়ির দিকে। চীনা ব্র্যান্ডের মধ্যে চাহিদার শীর্ষে আছে লিশিয়াং ও জিকর।   

চোরাইপথে আসা গাড়ি কেনার দুটি পথ রয়েছে, এরমধ্যে সবচেয়ে সহজ হচ্ছে কোনো ডিলারের সাথে যোগাযোগ করা, যে গাড়ির বড় চালান আমদানি করার মতো আর্থিক সামর্থ্য রাখে। তবে রুশ ক্রেতা যদি নির্দিষ্ট কোনো মডেলের গাড়ি পেতে চান, তাহলে এমন মধ্যস্ততাকারীর শরণাপন্ন হওয়াই তাঁর জন্য সবচেয়ে কার্যকর, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যার যোগাযোগ রয়েছে। 

“এখানে পদ্ধতিটি খুবই সরল: প্রথমত কেউ একজন ক্রেতাকে গাড়িটি কিনতে এবং তা রুশ সীমান্ত পর্যন্ত আনতে সাহায্য করে, এরপর কেউ গাড়িটির কাস্টমসে রেজিস্ট্রেশন করায়। এবার অন্য কেউ সেটি চালিয়ে নির্দিষ্ট ঠিকানা পর্যন্ত নিয়ে আসে এবং আবার আরেকজন সেটি রেজিস্ট্রেশন করায়।” – এমনটাই বলা হয়েছে আমদানি করা গাড়ি কেনাবেচার ওয়েবসাইট অ্যাভটো ডট আরইউতে। 

তবে আরেকটি অটো-ব্রোকার অ্যাভটোরেভিজোররো জানায়, চলতি বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে ইউরোপ থেকে গাড়ি আমদানি অনেক জটিল হয়ে পড়েছে। কারণ, পোল্যান্ড ও লিথুনিয়ার কর্তৃপক্ষ এখন অনেক ধরনের নথিপত্র চায়, অনেক সময় তারা দীর্ঘদিন ধরে গাড়িগুলোকে আটকে রাখে।  

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button