Hot

পাইপ কাটার ৪৬ লাখ টাকা হাতুড়ি ৯১ হাজার! মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ প্রকল্পের ক্রয় মেগাপ্রকল্পের উপকরণের এমন ক্রয়মূল্য অস্বাভাবিক অবিশ্বাস্য : ড. মইনুল ইসলাম

অবিশ^াস্য হলেও সত্য একটি পাইপ কাটারের দাম ৪৬ লাখ টাকা। আর একটি সাধারণ মানের হাতুড়ির দাম পড়েছে ৯১ হাজার টাকা। অথচ বিশ্ববাজারে প্রতিটি কাটারের দাম সাত হাজার আর হাতুড়ির দাম কয়েকশ’ টাকা। দেশের অন্যতম মেগাপ্রকল্প কক্সবাজারের মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আনা হয়েছে এসব হস্তচালিত যন্ত্রপাতি (হ্যান্ড টুলস)।

চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কর্মকর্তারা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে একটি চালানে ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ১৯ ধরনের যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়। এ আমদানিতে প্রতিটি যন্ত্রের দাম পাঁচ থেকে ১৮ হাজার গুণ বেশি দেখানো হয়েছে। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল) এ চালানটি আমদানি করে। বিস্ময়কর এমন আকাশছোঁয়া মূল্য দেখে চালানটি খালাস স্থগিত করে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা জানতে চাওয়া হয় বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড-পিডিবি ও সিপিজিসিবিএলসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে। জবাবে অতিরিক্ত মূল্যকেই স্বাভাবিক বলে জানায় সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলো। তাতে চালানটি শুল্কায়ন শেষে খালাস করতে বাধ্য হয় চট্টগ্রাম কাস্টমস।
একটি মেগা প্রকল্পের জন্য হস্তচালিত কিছু সাধারণ মানের যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে এমন অস্বাভাবিক মূল্য দেখানোর ঘটনা অবিশ^াস্য উল্লেখ করে একুশে পদকপ্রাপ্ত বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম গতকাল দৈনিক ইনকিলাবকে বলেন, আমাদের দেশে এ ধরনের প্রকল্প বা মেগাপ্রকল্পে বিভিন্ন উপকরণের ক্রয়মূল্য দেখানো হয় বিশ্বের যে কোনো দেশের চাইতে অনেক অনেক বেশি। এটি খুবই অস্বাভাবিক ও অবিশ্বাস্য। এ কারণে প্রকল্পের ব্যয় বাড়ে এবং তার খেসারত দিতে হয় সাধারণ জনগণকে।
অন্যদিকে এ ঘটনাকে পুকুর চুরি নয় রীতিমত ‘মহাসাগর চুরি’ উল্লেখ করে এ মেগা প্রকল্পের জন্য আমদানিকৃত প্রতিটি চালান নিরপেক্ষ তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছেন সুজন চট্টগ্রামের সম্পাদক অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী। তিনি বলেন, এটি বালিশ ও পর্দা কেলেঙ্কারিরই ধারাবাহিকতা। এ চালানটিতে উচ্চমূল্য দেখিয়ে ডলার পাচার করা হয়েছে কিনা তাও অনুসন্ধান জরুরি বলে জানান তিনি।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের তথ্য অনুযায়ী, গত ৯ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৩৪৪.৫ কেজি ওজনের একটি চালান আমদানি করে সিপিজিসিবিএল। চালানটির আমদানি মূল্য দেখানো হয় দুই লাখ ৫০ হাজার ৮৬৩ মার্কিন ডলার বা দুই দশমিক ৭৫ কোটি টাকা। গত ১১ জানুয়ারি চালানটির কায়িক পরীক্ষায় দেখা যায় জার্মানির তৈরি দুইটি পাইপ কাটারের দাম ৯২ লাখ ৯৯ হাজার টাকা এবং একই কোম্পানির দুটি হাতুড়ির দাম দেখানো হয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার টাকা। এভাবে ১৯টি আইটেমের সবকটির দামই অস্বাভাবিক উল্লেখ করা হয়েছে।
এই ধরনের বিস্ময়কর মূল্য দেখে হতবাক হয়ে যান কাস্টমস হাউসের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তারা চালানটি খুলে শতভাগ কায়িক পরিক্ষা করেন। চালানটি আটকে দিয়ে সিপিজিসিবিএল ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের কাছে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়।

চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কমিশনার মোহাম্মদ ফাইজুর রহমান তার চিঠিতে উল্লেখ করেন, কায়িক পরীক্ষায় প্রাপ্ত পণ্যের ছবি দেখে স্পষ্ট বোঝা যায় পণ্যগুলো সাধারণ মানের হ্যান্ড টুলস। যা স্বল্পমানের পণ্য হওয়াই যুক্তিযুক্ত। অর্থাৎ আমদানি পণ্যের চেয়ে ঘোষিত মূল্যের পণ্য রেফারেন্স অপেক্ষা অস্বাভাবিক বেশি। সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টকে অবহিত করা হলেও তারা অস্বাভাবিক মূল্য দেখানোর বিষয়ে লিখিত বা মৌখিকভাবে কোনো বক্তব্য প্রদান করেনি।

এ অবস্থায় আমদানি পণ্য চালানটি অস্বাভাবিক উচ্চ ঘোষিত মূল্যে শুল্কায়ন করা ঝুঁকিপূর্ণ হবে। মূল্যের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দফতর ও মন্ত্রণালয় থেকে নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন বলে এ দফতর মনে করেন। কাস্টম কমিশনার তার চিঠিতে এ সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও পণ্যমূল্যের বিষয়ে যৌক্তিক ব্যাখ্যা প্রদানেরও আহ্বান জানান।
কাস্টমস সূত্র জানায়, পিডিবি ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান সিপিজিসিবিএল আটক চালান সম্পর্কে লিখিত একটি জবাব দেয়। তাতে উল্লেখ করা হয়, আমদানিকৃত পণ্যের দাম বিক্রেতার সঙ্গে চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া বাল্ক আমদানির কারণে কিছু পণ্যের দামের তারতম্য থাকা সাধারণ ব্যাপার। যে দাম উল্লেখ করা হয়েছে তাকে স্বাভাবিক বলেও সাফাই গাওয়া হয়। জবাবে বলা হয়েছে, আমদানিকৃত টুলস বিশেষভাবে তৈরি হওয়ায় প্রচলিত বাজারের চেয়ে এর মূল্য কিছুটা বেশি। তবে বিশেষভাবে তৈরি এসব পণ্যের সমর্থনে কোন দলিলপত্র দিতে পারেনি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান। এমন বক্তব্য পাওয়ার পর কাস্টমস কর্তৃপক্ষ চালানটি খালাস করে দেয়।
কাস্টমসের একজন কর্মকর্তা জানান, প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা অতিরিক্ত ব্যয়কে স্বাভাবিক ধরে নিলে এতে কাস্টমসের করার কিছু নেই।

কাস্টম হাউসের কর্মকর্তারা জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে ওই দামের একটি পাইপ কাটারের দাম ৬০ দশমিক ২৭ ইউরো বা সাত হাজার ২৩২ টাকা। অথচ আমদানি চালানে ঘোষণা দেয়া হয়েছে ৯২ হাজার ৯৯ হাজার টাকা। একইভাবে একটি হাতুড়ির দাম ১৩ দশমিক ৯ ইউরো বা এক হাজার ৬৬৮ টাকা। আমদানি চালানো দুটি হাতুড়ির মূল্য দেখানো হয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার টাকা। চালানটির মধ্যে থাকা সব আইটেমের দাম অস্বাভাবিক আকাশচুম্বী দেখানো হয়েছে। চালানটির মধ্যে রয়েছে মেকানিক্যাল ফায়ার, মাংকি টায়ার, টুলবক্স, স্ক্রু ডাইভার, রেঞ্জ, স্প্যানার, কার ফিটার সেটসহ নানা যন্ত্রসামগ্রী। এটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের সাথে সরাসরি জড়িত কোনো পণ্য নয়। তবে পরবর্তীতে নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ কাজে এসব হস্তচালিত যন্ত্র ব্যবহার করা হবে।

কাস্টম সূত্র জানায়, বাণিজ্যিকভাবে এসব যন্ত্রপাতি নিয়মিতই আমদানি হয়। আর এ কারণে বাজারে এসব পণ্য সহজলভ্য এবং দামে সস্তা। বাজারমূল্যের চেয়ে কয়েকশ থেকে কয়েক হাজার গুণ বেশি দামে এসব পণ্য আমদানির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগতভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে। তবে পাওয়ার প্ল্যান্ট কর্তৃপক্ষ বলছে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাদের চুক্তি রয়েছে। এখানে এমন কিছু আইটেম রয়েছে যা বিশেষ ধাতু এবং উপকরণ দিয়ে তৈরি। আর এজন্য বাজারের স্বাভাবিক পণ্যের সাথে এসব পণ্যের দাম মেলানো যাবে না। মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রকল্প পরিচালক আবুল কালাম আজাদের সাথে গতকাল যোগাযোগ করা হলে তিনি এ বিষয়ে কোনো কথা বলতে রাজি হননি।

জানা গেছে, এরআগেও এরকম চালান খালাস করে নিয়ে গেছে রাষ্ট্রীয় এ প্রতিষ্ঠানটি। এরআগে ইথারনেট সুইচ বা নেটওয়ার্ক সুইচ নামে পরিচিত একটি পণ্য আমদানি করা হয়। কোম্পানির ওয়েবসাইটে এ ধরনের সুইচের দাম চার হাজার ৮৮১ দশমিক ৮৩ ডলার। অথচ আমদানিকালে পণ্যটির দাম উল্লেখ করা হয়েছিল দুই লাখ পাঁচ হাজার ২১৮ ডলার বা দুই কোটি তিন লাখ টাকা। যা আমদানি মূল্যের তুলনায় ৪২ গুণ বেশি। কাস্টমের কায়িক পরীক্ষায় আমদানিকৃত ওই সুইচগুলোকেও স্বাভাবিক মনে হয়েছিল বলে জানান কর্মকর্তারা।

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি প্রফেসর ড. মইনুল ইসলাম মেগাপ্রকল্পে বিভিন্ন উপকরণের ক্রয়মূল্য কেন অস্বাভাবিক ও অবিশ্বাস্য অধিক মূল্য হবে তার কারণ সত্যিকার অর্থে অনুসন্ধান করে খুঁজে বের করে জবাবদিহি করার জন্য কোনো ব্যবস্থা এদেশে নেই। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক যে, বাংলাদেশে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে অস্বাভাবিক উচ্চ ব্যয় হচ্ছে বা দেখানো হয়। তাতে ব্যাপক দুর্নীতি, অনিয়মগ্রস্ত হচ্ছে এসব প্রকল্প। প্রকল্প বা মেগা প্রকল্পসমূহের ব্যয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর, এই অস্বাভাবিক, অবিশ্বাস্য ও অধিক ব্যয়ের খেসারত দিতে হয় দেশের জনগণকে।

এ প্রসঙ্গে সুজন চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী বলেন, সাধারণ যন্ত্রপাতিকে বিশেষ যন্ত্রপাতি উল্লেখ করে অবিশ^াস্য মূল্যে আমদানির ঘটনা বড় ধরনের দুর্নীতির ইঙ্গিত দেয়। তিনি এ পর্যন্ত মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমদানিকৃত প্রত্যেকটি চালান নিরপেক্ষ তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত চিত্র বের করে আনার আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, দেশে তীব্র ডলার সঙ্কট চলছে। এ কারণে আমদানি কমে গেছে। ভয়াবহ মূল্যস্ফীতি গ্রাস করেছে। প্রবাসী শ্রমিকেরা তাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়ে আমাদের রিজার্ভ ধরে রাখছেন। গার্মেন্টসের নারী শ্রমিকেরা কঠোর পরিশ্রম করছেন। রফতানির মাধ্যমে দেশে কিছু ডলার আসছে। মেগা প্রকল্পের যন্ত্রপাতি আমদানির নামে এ ডলার বিদেশে পাচার হচ্ছে কিনা তার অনুসন্ধান করা জরুরি। অতীতে এ ধরনের অনেক ঘটনা মিডিয়ায় প্রকাশ হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এসব অপকর্মে জড়িত কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। আর এ কারণেই দেশে প্রায় প্রতিটি প্রকল্পের ব্যয় দ্বিগুণ থেকে তিনগুণ হয়ে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা এবং সরকারি দলের ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগে বিশেষ গোষ্ঠী একের পর এক এমন অপকর্ম করে যাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
কক্সবাজার জেলার মহেশখালীর মাতারবাড়িতে এক হাজার ৪১৪ একর জমিতে নির্মাণ করা হচ্ছে কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র। ৬০০ মেগাওয়াটের মোট দুটি ইউনিট তৈরি হচ্ছে। চলতি বছরের শুরু থেকে প্রথম ইউনিট অর্থাৎ ৬০০ মেগাওয়াট এবং একই বছরের জুলাইতে দ্বিতীয় ইউনিট আরও ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদনে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে।

২০১৪ সালে অনুমোদন পাওয়া প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকা। সংশোধন করে প্রকল্পের ব্যয় ১৫ হাজার ৮৭০ কোটি টাকা বাড়ানো হয়। ফলে মোট ব্যয় দাঁড়াল প্রায় ৫১ হাজার ৮৫৪.৮৮ কোটি টাকা। প্রকল্পটিতে আগে জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগী সংস্থা (জাইকা) দেওয়ার কথা ছিল ২৮ হাজার ৯৩৯ কোটি টাকা। এবার সেই ঋণ বাড়িয়ে জাইকা মোট দিচ্ছে প্রায় ৪৩ হাজার ৯২১ কোটি টাকা। আর প্রকল্পটিতে সরকারি তহবিল থেকে যোগান দেওয়া হবে ছয় হাজার ৪০৬ কোটি টাকা।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d