পাকিস্তানের মন্ত্রী বললেন আগেই সমাধান হয়েছে, ভিন্নমত উপদেষ্টার: একাত্তরের অমীমাংসিত বিষয়

একাত্তরের অমীমাংসিত বিষয় বা ইস্যু ‘দুবার সমাধানের’ দাবি করেছেন পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার। তবে তাঁর সঙ্গে একমত নন বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন। তিনি বলেছেন, দুই দেশের অমীমাংসিত ইস্যু নিয়ে আগামী দিনে উভয় পক্ষই আলোচনা চালিয়ে যাবে।
রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে গতকাল রোববার সকালে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টার মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। এরপর দুপুরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ওই বৈঠকের আলোচনা নিয়ে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
এর আগে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে সোনারগাঁও হোটেলে সাংবাদিকদের পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা অনেক বিস্তৃত বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। যার মধ্যে বাণিজ্য, অর্থনীতি, বিনিয়োগ, নিরাপত্তা, প্রতিরক্ষা বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতার মতো বিষয়গুলো ছিল। বৈঠকে বিষয়গুলোতে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে ঐক্য ছিল এবং আমাদের মধ্যে কোনো মতভেদ ছিল না।’
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়া, সম্পদের বণ্টনের মতো অমীমাংসিত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার বিষয়ে জানতে চাইলে ইসহাক দার বলেন, ১৯৭৪ সালে প্রথমবার সমস্যাটি লিখিতভাবে সমাধান করা হয়েছিল। নথিটি ঐতিহাসিক এবং উভয় দেশের কাছেই রয়েছে। ২০০০ সালে জেনারেল পারভেজ মোশারফ বাংলাদেশ সফরে খুব খোলাখুলিভাবে এবং অকপটে সমস্যাটি নিয়ে আলোচনা করে গেছেন।
ইসহাক দার বলেন, ‘আমি মনে করি ধর্ম যা বলে, ইসলামি শিক্ষা যা বলে, পবিত্র কোরআন যা বলে, হজরত মুহাম্মদের (সা.) সুন্নাহ যা বলে, তা হলো আমাদের পরিষ্কার মন থাকা উচিত এবং একসঙ্গে এগিয়ে যাওয়া উচিত। আমরা একটি পরিবার এবং আমাদের একসঙ্গে কাজ করা উচিত। আমাদের মধ্যে দুর্দান্ত সম্ভাবনা রয়েছে।’
বৈঠকে বাংলাদেশ ও পাকিস্তান একটি চুক্তি ও পাঁচটি সমঝোতা স্মারকসহ মোট ছয়টি নথি সই করেছে বলে জানান ইসহাক দার। সেগুলো হলো, কূটনৈতিক ও অফিশিয়াল (সরকারি) পাসপোর্টধারীদের জন্য ভিসা না লাগার চুক্তি, সাংস্কৃতিক বিনিময়, দুই দেশের সংবাদ সংস্থা, ফরেন সার্ভিস একাডেমি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমঝোতা এবং বাণিজ্য সহযোগিতা নিয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।
ইসহাক দার বলেন, চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের কূটনৈতিক এবং সরকারি পাসপোর্টধারীদের ভিসা মওকুফ করা হয়েছে। আর উভয় দেশের সাধারণ নাগরিকদের জন্য ভিসাব্যবস্থা ইতিমধ্যে সহজ করা হয়েছে। পাকিস্তান ইতিমধ্যে ভিসা অন অ্যারাইভাল বা ২৪ ঘণ্টার ভিসাপ্রক্রিয়া খুব দ্রুত করেছে।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, অমীমাংসিত বিষয় নিয়ে আপনারা বৈঠকে আলোচনা করেছেন বলে উল্লেখ করলেন। আবার দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর ইসহাক দার বলেছেন, বিষয়গুলোর নিষ্পত্তি দুবার হয়েছে। আপনি বলছেন, আলোচনা করেছেন। এ নিয়ে যে অস্পষ্টতা, তা আপনি দূর করবেন কি না। কিংবা আপনি ইসহাক দারের দাবি গ্রহণ করছেন কি না।
জবাবে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা (বৈঠকে) পরস্পরের অবস্থানটা তুলে ধরেছি। আমি আপনাদের এটুকু নিশ্চয়তা দিতে পারি, আমরা তিনটি বিষয়ে নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেছি। দুই পক্ষই বলেছি, এ বিষয়গুলোকে আমাদের সমাধান করতে হবে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যাতে মসৃণভাবে এগোতে পারে, সে জন্য বিষয়গুলোকে পেছনে ফেলতে হবে। দুই পক্ষ একমত হয়েছে যে আমরা এ বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলব।’
তিন অমীমাংসিত ইস্যুতে বাংলাদেশের অবস্থান কী, সে প্রশ্নে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা চাই, হিসাবপত্র হোক, যেটা টাকাপয়সার ব্যাপার, সমাধান হোক। আমরা চাই, এখানে যে গণহত্যা হয়েছে, সেটার ব্যাপারে দুঃখ প্রকাশ করুক, মাফ চাইবে। আমরা চাই, আটকে পড়া মানুষগুলোকে তারা ফেরত নেবে। আমি বাংলাদেশের অবস্থান শক্তভাবে তুলে ধরেছি।’
ইসহাক দার তিনটি বিষয়ের দুবার সমাধানের যে দাবি করেছেন, সে বিষয়ে একমত কি না, জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘আমি অবশ্যই একমত না। একমত হলে তো সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। আমরা আমাদের অবস্থান বলেছি। ওনারা ওনাদের অবস্থান তুলে ধরেছেন। তিনটি বিষয়েই তুলে ধরেছি।’
পাকিস্তান নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে একমত, এটা বলা যাবে কি না, এমন প্রশ্নে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, ‘না। আপনি এটা বলতে পারেন না।’
চীনের ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের কারণে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে ধারাবাহিক বৈঠকগুলো হচ্ছে কি না, এ বিষয়ে এক প্রশ্নে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘এক কথায় এর উত্তর হচ্ছে “না”।’
চীনের ওই উদ্যোগে তিন দেশের মধ্যে না রেখে পরিসর বাড়ানোর প্রস্তাব বাংলাদেশের দিক থেকে দেওয়ার কথা তুলে ধরে তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘এটা খুব সহজভাবে আমি আপনাদের আগেও বলেছি। সেটা হলো, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক গত সরকারের আমলে ইচ্ছাকৃতভাবে পিছিয়ে রাখা হয়েছে। আমি আপনাদের আগেও বলেছি, এখন আবার বলছি, আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে একটি স্বাভাবিক সম্পর্ক চাই, যেমন আমরা অন্যান্য বন্ধুদেশের সঙ্গে চাই। ঠিক সে রকমই, এর চেয়ে বেশি কিছু না।’
বৈঠকে ‘গণহত্যা’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে কি না, জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, এত সুনির্দিষ্টভাবে জানতে চাওয়া উচিত নয়।
সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা চাওয়া, সম্পদের বণ্টন, ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য বৈদেশিক সাহায্য হস্তান্তর, আটকে পড়া পাকিস্তানিদের প্রত্যাবাসনসহ দীর্ঘকাল ধরে অমীমাংসিত ঐতিহাসিক বিষয়গুলোর সমাধানের আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে একটি দৃঢ় ভিত্তি স্থাপনের জন্য এটা দরকার।
বৈঠকে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ‘বাংলাদেশ-পাকিস্তান জ্ঞান করিডোর’ চালু করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন, যার আওতায় আগামী পাঁচ বছরে পাকিস্তানে উচ্চশিক্ষার জন্য ৫০০ বাংলাদেশি শিক্ষার্থীকে বৃত্তি দেওয়া হবে। এই বৃত্তির এক-চতুর্থাংশ চিকিৎসা ক্ষেত্রে দেওয়া হবে। তিনি বাংলাদেশে জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে আহত ৪০ শিক্ষার্থীর অঙ্গ প্রতিস্থাপনসহ উন্নত চিকিৎসার জন্য পাকিস্তানের প্রস্তুতির কথাও জানিয়েছেন। পাকিস্তান বাংলাদেশের হকি দলের প্রশিক্ষণেরও প্রস্তাব দিয়েছে।
দুই দিনের সফরে গত শনিবার দুপুরে ঢাকা এসেছিলেন ইসহাক দার। তিনি গতকাল সকালে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীনের সঙ্গে প্রাতরাশ বৈঠক করেন। দুপুরে তিনি জামায়াতে ইসলামীর আমির শফিকুর রহমানকে দেখতে তাঁর বাসায় যান। সন্ধ্যায় তিনি যান বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে।
পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী জাম কামাল খান ২১ আগস্ট থেকে বাংলাদেশ সফরে রয়েছেন। ইসহাক দার ও জাম কামাল খানের গতকাল দিবাগত গভীর রাতে পাকিস্তানের উদ্দেশে রওনা হওয়ার কথা।