পারস্পরিক শুল্ক থেকে মুক্তি পেতে মার্কিন পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিতে পারে বাংলাদেশ

যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে শূন্য শুল্ক দিয়ে ভিয়েতনাম এক ধাক্কায় পারস্পরিক শুল্ক (রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ) ৪৬ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনার পর বাংলাদেশের ওয়াশিংটনের চাহিদা অনুযায়ী মার্কিন পণ্য আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেওয়ার কথা ভাবছে। ওয়াশিংটনের প্রত্যাশা পূরণে মার্কিন পণ্যে শূন্য-শুল্ক সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি এখন সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করছে ঢাকা।
কর্মকর্তারা বলছেন, প্রস্তাবিত পারস্পরিক শুল্ক চুক্তির এনেক্সার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে যে ডকুমেন্ট বা ট্যারিফ শিডিউল পাঠাবে, তা ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করবে ঢাকা।
তবে চুক্তির খসড়ায় উল্লেখিত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব আইন অনুসরণ করা সম্ভব নয় জানিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডাব্লিউটিও) বিধিবিধানের আওতায় চুক্তি স্বাক্ষরের আগ্রহের কথা ইউনাইটেড স্টেটস ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভকে (ইউএসটিআর) জানিয়েছে ঢাকা।
বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান শনিবার (৫ জুলাই) টিবিএসকে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে ট্যারিফ ছাড় দেওয়ার বিষয়ে আমাদের তেমন কোনো আপত্তি নেই।’
সরকারিভাবে ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্র থেকে উড়োজাহাজ, এলএনজি, গমসহ বিভিন্ন পণ্য আমদানি বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
‘যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যে শুল্ক প্রত্যাহার হলে বেসরকারি খাতও দেশটি থেকে আমদানি বাড়াতে উৎসাহিত হবে। এতে অভ্যন্তরীণ শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই,’ বাণিজ্য সচিব বলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের পাঠানো খসড়া চুক্তির কঠিন শর্তগুলোর বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নে সচিব বলেন, ‘আমরা ওইগুলোর ব্যাপারে নেগোসিয়েশন চালিয়ে যাচ্ছি। তারাও অন বোর্ড আছে, আমরাও অন বোর্ড আছি। আমরা তাদের জানিয়েছি যে, ওই শর্তগুলো আমরা ক্যারি করতে পারব না। ডব্লিউটিওর রেগুলেশনের মধ্যে থেকেই আমরা পারস্পরিক শুল্ক চুক্তি করতে চাই।’
শুল্কহার ভিয়েতনামের চেয়ে কম হওয়ার আশা
বাংলাদেশের এমন অবস্থান সত্ত্বেও, যুক্তরাষ্ট্র চুক্তির এনেক্সার ডকুমেন্ট পাঠাতে এবং পরবর্তী বৈঠক করতে আগ্রহ দেখিয়েছে। যদিও গতকাল পর্যন্ত ইউএসটিআরের পক্ষ থেকে সেই নথি পাঠানো হয়নি।
বাণিজ্য সচিব বলেন, ‘ইউএসটিআর আমাদের বলেছে যে, এলডিসিগুলোর জন্য পৃথক ট্যারিফ রেট করবে। এ কারণে আমরা মনে করি, আমাদের ওপর শুল্কহার ভিয়েতনামের চেয়ে কম হবে।’
মাহবুবুর আরও বলেন, ‘ডব্লিউটিওর রেগুলেশনের মধ্যে থেকে জাতীয় স্বার্থ, রপ্তানির স্বার্থ এবং বিশেষ করে তৈরি পোশাক শিল্পের স্বার্থকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারে রেখে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তির বিষয়ে নেগোসিয়েশন করছি।’
পারস্পরিক শুল্ক ও চলমান আলোচনা
গত ২ এপ্রিল বাংলাদেশের উপর ৩৭ শতাংশ পারস্পরিক শুল্কসহ বিভিন্ন দেশের ওপর বাড়তি শুল্ক আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ন্যূনতম ৯ শতাংশ বাড়তি শুল্ক বাস্তবায়ন করে অবশিষ্ট শুল্ক তিন মাসের জন্য স্থগিত করেন, যার মেয়াদ ৯ জুলাই শেষ হবে। এই সময়ের মধ্যেই বিভিন্ন দেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চুক্তি করে নিজেদের ওপর আরোপিত শুল্ক কমানোর উদ্যোগ নিয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের ওপর আরোপিত পারস্পরিক শুল্ক ৪৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের ওপর আরোপিত শুল্ক তুলে নেওয়ার পর ভিয়েতনামের শুল্ক কমাচ্ছে ওয়াশিংটন।
পারস্পরিক শুল্ক কার্যকর করার স্থগিতাদেশ ৯ জুলাই শেষ হলেও বাংলাদেশের ওপর প্রস্তাবিত ৩৭ শতাংশ শুল্কহার কার্যকর হবে না বলে জানান সচিব।
তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে আমরা ইউএসটিআর কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম। তারা আমাদের বলেছেন যে, এটা হওয়ার কথা নয়। কারণ, তোমরা আমাদের সঙ্গে নেগোসিয়েশন চালিয়ে যাচ্ছ।’
বাংলাদেশও চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য দরকষাকষি সম্পন্ন করতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমান ওয়াশিংটনে রয়েছেন।
৩ জুলাই রাতে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান।
আগামী ৯ বা ১০ জুলাই ওয়াশিংটনে পরবর্তী বৈঠক হবে। তার আগে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে চুক্তির এনেক্সার ডকুমেন্ট বাংলাদেশকে পাঠাবে বলে ৩ জুলাই সমঝোতা হয়েছে।
বাণিজ্য উপদেষ্টা যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করে এই চুক্তির বিষয়ে ইউএসটিআরসহ যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন বলে জানা গেছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেন, ইউএসটিআরের সঙ্গে পরবর্তী বৈঠকে সশরীরে অংশ নিতে রোববার বাণিজ্য সচিবের ওয়াশিংটন যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু শনিবার পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে চুক্তির এনেক্সার ডকুমেন্ট না পাওয়ায় তিনি যাচ্ছেন না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে সচিব বলেন, ‘এখন পর্যন্ত চুক্তির ডেসক্রিপটিভ বিষয় নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। চুক্তির এনেক্সার পাঠানোর বিষয়ে ৩ জুলাইয়ের মিটিংয়ে সমঝোতা হয়েছে। এনেক্সার পাওয়ার পর টেকনিক্যাল কমিটির সঙ্গে মিটিং করে বাংলাদেশের অবস্থান চূড়ান্ত করার পর আমি যুক্তরাষ্ট্রে যাব।’
কর্মকর্তারা আরও বলেন, যুক্তরাষ্ট্র পারস্পরিক শুল্ক চুক্তির জন্য যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের চলমান এফটিএ বা পিটিএ চুক্তির দরকষাকষির মতো নয়।
সাধারণত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তির আলোচনায় শুরুতে এনেক্সার নিয়ে দুই পক্ষ দরকষাকষি শুরু করে একমত হওয়ার পর চুক্তির বাউন্ডারি ও অফারস ডকুমেন্ট নিয়ে আলোচনা হয়। এরপর চুক্তির ডেসক্রিপটিভ পার্ট নিয়ে দরকষাকষি করে দুই পক্ষ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র উল্টোভাবে চুক্তির দরকষাকষি শুরু করেছে।