Bangladesh

পাহাড়ি ঢল ও বর্ষণে নতুন করে বন্যা: সিলেট সুনামগঞ্জ সিরাজগঞ্জ ভূঞাপুরে সীমাহীন দুর্ভোগ

পানিবন্দি লাখো মানুষ ছড়াচ্ছে ডায়রিয়াসহ নানা রোগ * দফায় দফায় বন্যায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছে অনেক পরিবার

উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুর, সিরাজগঞ্জ, সুনামগঞ্জে আবার নতুন করে বন্যা দেখা দিয়েছে। সিলেটে বন্যা আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। সুনামগঞ্জে এ নিয়ে চলতি মৌসুমে তৃতীয় দফা বন্যার শিকার হলেন জেলার বাসিন্দারা। চলমান বন্যার পানি পুরোপুরি না কমতেই পাহাড়ি ঢল ও হঠাৎ করে ব্যাপক বৃষ্টিপাতে নদীগুলোর চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের কয়েক লাখ মানুষ নতুন করে বন্যার ভোগান্তিতে পড়েছেন। ফলে দীর্ঘায়িত হচ্ছে পানিবন্দি মানুষদের দুর্ভোগ। দেখা দিয়েছে নিরাপদ খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, গো-খাদ্য ও নিরাপদ স্যানিটেশনের সংকট। শিশুদের ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত নানা রোগও দেখা দিয়েছে। ঘরবাড়িতে পানি ওঠায় বানভাসিরা কেউ উঁচু জায়গা, কেউ বা আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। সরকারি ত্রাণসামগ্রী দেওয়া হলেও তা অপ্রতুল বলছেন বন্যার্তরা। ব্যুরো ও প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর :

সিলেট : সিলেটে কুশিয়ারা নদীর তীরবর্তী এলাকায় বন্যা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। বাড়ছে জনদুর্ভোগ। গত ১৭ জুন ঈদের দিন থেকে ডুবে আছে দক্ষিণ সুরমা, জকিগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, গোলাপগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, বালাগঞ্জ ও ওসমানীনগর উপজেলাসহ সিলেট সিটি করপোরেশনের অধিকাংশ এলাকা। এসব এলাকার বাসিন্দারা দীর্ঘমেয়াদি বন্যার কবলে পড়েছেন। কুশিয়ারা নদী তীরবর্তী এলাকায় ঈদের দিন অনেকের ঘরে কোমরসমান পানি ছিল। ঈদের কোনো আনন্দ ছিল না। এই অঞ্চলের নিু আয়ের মানুষ রয়েছেন মহাবিপদে। দফায় দফায় বন্যায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন সিলেটের অনেকেই। সরকারের কাছ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো সহযোগিতা পাওয়া যাচ্ছে না, যা দেওয়া হচ্ছে তা চাহিদার তুলনায় খুবই অপ্রতুল। সিলেট নগরীর নছিবা খাতুন উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন ভার্থখলার বাসিন্দা হাবিবুর রহমান পাপ্পু শুক্রবার জানান, এখনো তার বাসায় পানি। দিনে শুকনো থাকলেও রাতে বৃষ্টি হলেই হাঁটুসমান পানিতে জলমগ্ন হয়ে পড়ে পুরো এলাকা। সিটি করপোরেশনের ২৫, ২৬, ২৭, ৩২, ৪০ ও ৪২নং ওয়ার্ডসহ গোটা দক্ষিণ সুরমা এখনো পানির নিচে। এই উপজেলার অবস্থান কুশিয়ারা নদী অববাহিকায়। এবারের বন্যায় কুশিয়ারা তীরের বাসিন্দারাই বেশি দুর্ভোগে পড়েছেন। সিলেটের প্রধান নদী সুরমার পানি কমে সুরমা তীরবর্তী অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হলেও কুশিয়ারার পানি কিছুতেই কমছে না। এদিকে সিলেটে দফায় দফায় বন্যার কারণে শাকসবজিসহ নিত্যপণ্যের বাজারে আগুন। হুহু করে বাড়ছে পণ্যের দাম। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়ায় সাধারণ ক্রেতারা পড়েছেন মহাসংকটে।

ভূঞাপুর (টাঙ্গাইল) : উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও টানা বর্ষণে টাঙ্গাইলের ভূঞাপুরে যমুনার চরাঞ্চলে বানভাসি মানুষদের দুর্ভোগ কমছেই না। দীর্ঘমেয়াদি হচ্ছে বন্যা। ফলে চরম বিপাকে পড়েছেন বানভাসি মানুষগুলো। দেখা দিয়েছে নিরাপদ খাদ্য, বিশুদ্ধ পানি, গো-খাদ্য ও নিরাপদ স্যানিটেশনের সংকট। দেখা দিয়েছে শিশুদের ডায়রিয়াসহ পানিবাহিত নানা রোগ। টাঙ্গাইল জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, কয়েক দিন ধরে যমুনা নদীর পানি কমলেও বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা থেকে শুক্রবার সকাল ৯টা পর্যন্ত পোড়াবাড়ি পয়েন্টে ১০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিদৎসীমার ২৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া ধলেশ্বরী ও ঝিনাই নদীর পানি বিপৎসীমার ওপরে থাকলেও জেলার অন্যান্য নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এসব নদীতেও পানি বাড়ছে। শুক্রবার দুপুরে সরেজমিন ভূঞাপুর উপজেলার গাবসারা ইউনিয়নের দুর্গম চরাঞ্চল কালিপুর, জয়পুর, পুংলীপাড়া, রেহাইগাবসারা, চন্ডিপুর, মেঘারপটল, রাজাপুর, অর্জুনা ইউনিয়নের শুশুয়া, বাসুদেবকোল, ভদ্রশিমুলসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শুক্রবার ফের নতুন করে কিছুটা পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। এখনো চরের শত শত ঘরবাড়ি পানিতে ভাসছে ও তলিয়ে রয়েছে। কিছু কিছু এলাকায় ত্রাণ পেলেও এখনো অসংখ্য পরিবার ত্রাণসামগ্রী না পাওয়ার অভিযোগও করছেন। ইউএনও মামুনুর রশীদ জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে ও জেলা প্রশাসকের দিক-নির্দেশনায় দেড় হাজারের অধিক দরিদ্র মানুষের মাঝে মানবিক সহায়তা হিসাবে শুকনো খাবার, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও পানি মজুত রাখার পাত্র বিতরণ করা হয়েছে। ত্রাণ সহায়তা ও স্বাস্থ্যসেবা প্রদানসহ সব ধরনের কার্যক্রম চলমান থাকবে।

সিরাজগঞ্জ : তিন দিন ধীরগতিতে কমতে থাকার পর সিরাজগঞ্জে যমুনা নদীর পানি আবারও বাড়তে শুরু করেছে। ফলে যমুনাসহ অভ্যন্তরীণ নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। জেলার নদী পারের চরাঞ্চল ও নিচু এলাকার মানুষগুলোর পাশাপাশি গবাদিপশুর চারণভূমি তলিয়ে যাওয়ায় গো-খাদ্য ও গবাদিপশু নিয়ে মহাসংকটে পড়েছেন তারা। বিশেষ করে বন্যাদুর্গতরা নিজেদের চেয়ে গবাদিপশুর খাদ্য সংকটে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, জেলার দুটি পয়েন্টে আবারও পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে দুটি পয়েন্টে যমুনার পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে এ মৌসুমে বড় ধরনের বন্যার আশঙ্কা নেই বলেও জানান তিনি। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বাবুল কুমার সূত্রধর বলেন, ইতোমধ্যে বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে জেলার ৪ হাজার ৬৩০ হেক্টর ফসলি জমি। এসব জমির পাট, তিল, কলা ও মরিচ নিমজ্জিত হয়েছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, জেলার ৫টি উপজেলার ৩৪টি ইউনিয়নের ৫ হাজার ৩৬২টি পরিবারের ২৩ হাজার ৮৩৬ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। তাদের মাঝে ইতোমধ্যে ৬০ টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। আরও নতুন করে ৪৪০ টন চাল, নগদ ১০ লাখ টাকা ও ৫শ প্যাকেট শুকনা খাবার মজুত রয়েছে।

সুনামগঞ্জে ফের বন্যার শঙ্কা : সুনামগঞ্জে গত দুদিন ধরে ভারি বৃষ্টিপাত ও উজান থেকে আসা ঢলের পানিতে জেলার সবকটি নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে ফের বন্যার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় জেলার প্রধান নদী সুরমার পানি প্রায় ৩০ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়েছে। বিকালে ৩টায় সুরমার পানি শহরের ষোলঘর পয়েন্টে ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এর আগে সকাল ৬টায় সুরমার পানি ২৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। সুরমায় পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় নদীর তীরবর্তী সুনামগঞ্জ শহরের নবীনগর, ষোলঘর, লঞ্চঘাট, আরপিননগর, সাহেববাড়িঘাট, বড়পাড়া, বাগানবাড়ি, মল্লিকপুর এলাকার রাস্তাঘাটে পানি উঠেছে। পাহাড়ি ঢলের পানিতে সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর সড়ক প্লাবিত হয়ে সরাসরি যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। সুনামগঞ্জ সদর, ছাতক, দোয়ারাবাজার, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্যানুযায়ী গত দুদিনে সুনামগঞ্জে ৪১৫ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। পানি বাড়ায় তাহিরপুর-সুনামগঞ্জ সড়কের শক্তিয়ারখলা অংশ এ মৌসুমে তৃতীয়বারের মতো তলিয়েছে। এতে সরাসরি যান চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার শফিকুল ইসলাম বলেন, পানি কমার আগেই আবার পানি বাড়ছে। রাস্তাঘাট সবকিছু থেকে পানি মাত্র নেমেছিল কিন্তু আজ আবার দুহাত পানি বেড়ে গেছে।

বড়লেখা (মৌলভীবাজার) : বড়লেখায় মধ্য জুন থেকে শুরু হওয়া বন্যায় এলজিইডির প্রায় ৮০ কিলোমিটার সড়ক পানিতে তলিয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গত দুদিনে বন্যার পানি কিছুটা নামায় রাস্তার ক্ষতচিহ্ন বেরিয়ে আসছে। রাস্তার পিচ ও পাথর উঠে এবং ছোটবড় অসংখ্য গর্ত সৃষ্টি হয়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে।

কুড়িগ্রাম : পানি কমার সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিয়েছে তীব্র নদী ভাঙন। চলতি বন্যায় জেলায় নদী ভাঙনের শিকার হয়েছে ৪৫৮টি পরিবার। তিনটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে। শুক্রবার উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের গুজিমারী আবাসনে গিয়ে দেখা যায় ৯০টি পরিবারের চরম দুর্ভোগের চিত্র। প্রায় ২০ দিন ধরে পানিবন্দি জীবনযাপন করছেন তারা। কাজ নেই, নেই হাতে টাকা। ফলে চলছে মানবেতর জীবনযাপন।

চিলমারীতে বানভাসিদের দুর্ভোগ : নৌকার মাঝি সফিকুল ইসলাম, দিনমজুর সাইফুল ইসলাম ও দুখু মিয়ার বাড়িতে বন্যার পানি ওঠায় তারা গরু-ছাগল নিয়ে পড়েছেন বিপাকে। তাদের দুজনেরই বাড়ি চিলমারী উপজেলার রমনা ভরটত্মপাড়া গ্রামে। বেসরকারি সংস্থা থেকে ঋণে গরু নিয়েছিলেন সফিকুলের স্ত্রী সবুরা বেগম ও সাইফুল ইসলামের স্ত্রী আঙ্গুর বেগম। অতি কষ্টে গরু দুটি লালনপালন করছেন দুই গৃহিণী। বন্যার পানিতে বাড়িঘর তলিয়ে যাওয়ায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে রাস্তায় পলিথিনের ঝুপড়ি ঘরে আশ্রয় নেন তারা। নিজেদের একমাত্র সম্বল গরুটিকে নিয়ে বাঁধের ওপর সেই পলিথিনের ঝুপড়ির একই ঘরে বাস করছেন তারা। সেই সঙ্গে দুখু মিয়ার স্ত্রী আদুরী বেগমও তার পোষা একটি ছাগল নিয়ে সেখানেই আশ্রয় নেন। ৭ দিন ধরে খেয়ে না খেয়ে সেখানেই দিন কাটাচ্ছেন তারা।

সরেজমিন দেখা যায়, জোড়গাছ পুরাতন বাজার ভরটত্মপাড়া এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় নিয়েছে অসহায় ৩টি পরিবার। এ সময় ছোট পলিথিনের একটি ঝুপড়ি ঘরে গৃহপালিত পশুর (গরু) সঙ্গে গাদাগাদি করে বসে থাকতে দেখা যায় সফিকুল ইসলাম ও তার স্ত্রী-সন্তানকে। সফিকুল ইসলাম কোলে শিশুসন্তান নিয়ে গরুর পাশে চৌকির ওপরে বসে আর পাশেই তার স্ত্রী সবুরা বেগম রান্নার জন্য টিনের চুলায় আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করছেন।

ঝুপড়িতে আশ্রয় নেওয়া আঙ্গুর বেগম বলেন, ‘কাম না কইরলে পেটত ভাত যায় না, বান বন্যার দিনোত এলাকায় কাম-কাজ নাই। এক মাস আগে হামার স্বামী ফেনীত গেইছে কোষ্টা কাটা কাম কইরবের জন্য। এদিকে বাড়িত পানি উঠছে, ছাওয়া দুকনা আর গরুকোনা নিয়ে বান্দের রাস্তাত খায়া না খায়া পড়ি আছি। তার ওপর বৃষ্টি আসলে আরও কষ্ট। নিজে কি খাই, আবার গরুক কি খাওয়াই ভাই? বান আইসলে হামারগুলের কষ্ট শেষ হয় না।’ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মিনহাজুল ইসলাম জানান, বন্যার্ত মানুষের মাঝে পর্যায়ক্রমে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button