Hot

পিআর পদ্ধতি কার স্বার্থে?

গোবিন্দ প্রামাণিক, দয়াল কুমার বড়ুায়া, নির্মল রোজারিও কার খেলোয়াড়

নির্বাচনের টাইমফ্রেম নিয়ে বিতর্ক শুরু হয় অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের কয়েক মাস পরই। সরকারের ভেতরে কিছু ব্যক্তির ‘ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার বাসনা’ এবং ‘নির্বাচন হলেই গুরুত্ব কমে যাবে এবং এ সরকারের মেয়াদকালে সুবিধা নেয়ার চেতনা’য় কিছু দল সংস্কারের পর নির্বাচনের আওয়াজ তোলে। কিন্তু ঐতিহাসিক লন্ডন বৈঠকের পর রোজার আগে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বার্তা পায় জনগণ। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের প্রাথমিক প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রায় ১২ কোটি ভোটার আছেন ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে। সবার ধারণা, প্রধান উপদেষ্টার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় কিছু সংস্কারের পর প্রচলিত পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে।

কিন্তু সরকার গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে হঠাৎ করে প্রপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) বাংলায় ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ নির্বাচন শব্দটি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে ভোট নিতে না পারা ভোটাররা যখন ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়েÑ তখন হঠাৎ অচেনা পদ্ধতির নির্বাচন ইস্যু নিয়ে এত মাতামাতি কেন? ’৯১-এর পর থেকে বিএনপির অনুকম্পায় সংসদে জামায়াতের সামান্য জনপ্রতিনিধিত্ব ছাড়া যাদের তেমন কোনো প্রতিনিধিত্ব ছিল না; তারা হঠাৎ করে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবি তুলছেন এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সে দাবি অধিক গুরুত্ব দিয়ে দিনের পর দিন বৈঠক চালিয়ে যাচ্ছে। নেপথ্যের রহস্য কি? পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের নামে তারা কি ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়নের মাধ্যমে সংসদে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে চাচ্ছেন? নাকি জনসমর্থন না থাকায় সারা দেশের প্রাপ্ত ভোটে নিজেদের সংসদে যাওয়া নিশ্চিত করতে চাচ্ছেন? ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার পদে নির্বাচন করে বিজয়ী হওয়ার মতো জনসমর্থন নেই এমন নেতারা পিআর পদ্ধতির নির্বাচনে এমপি হয়ে সংসদে গিয়ে সুবিধা পেলেও জনগণের স্বার্থ কতটুকু রক্ষা হবে?

শেখ হাসিনা পালানো এবং ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে হিন্দুত্ববাদী ভারত একের পর এক বাংলাদেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ষড়যন্ত্র করছে। প্রতিটি চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর এখন আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব আগামী সংসদে রাখার নীলনকশা করছে। সেটি তারা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে বাস্তবায়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলো কি সে ফাঁদে পা দিচ্ছে? যেহেতু আওয়ামী লীগ পালালেও তাদের প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ ভোটার সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। আগামী নির্বাচনে ওই ভোটাররা আওয়ামী লীগ এবং কৌশলগতভাবে তাদের মনোনীত প্রার্থীদের ভোট দেবেন। এতে করে ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ পদ্ধতির নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা কমপক্ষে শতাধিক আসনে বিজয়ী হয়ে সংসদে যাবে। অন্যদিকে, বিএনপি ব্যাপক জনপ্রিয় হলের ভোটের হিসাবেও দলটির কার্যত ভোটারের সংখ্যা ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশের মধ্যে। জোটগতভাবে ভোট করলে এই সংখ্যা কিছুটা বাড়তে পারে। ফলে আওয়ামী লীগকে আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে সংসদে নেয়ার ভারতীয় নীলনকশা বাস্তবায়নে কি ‘সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব’ দাবি জোরালো করে তোলার চেষ্টায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে আলোচনা হচ্ছে? আর অতীতে সংসদে যাদের জনপ্রিতিনিধিত্ব তেমন ছিল না এবং যাদের ছিল সেটিও যৎসামান্য তাদের দাবি অধিক গুরুত্ব দিয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন দিনের পর দিন আলোচনা চালিয়ে যাবে কেন? সোশ্যাল মিডিয়ায় এ নিয়ে তীব্র বিতর্ক চলছে। নেটিজেনদের কেউ কেউ বলছেন, ‘যারা ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করতে চায় তারা পিআর ইস্যুকে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। কারণ এই ঐকমত্য কমিশনের যে অবস্থা তাতে মাসের পর মাস ধরে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করলেও এ সব ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছানো যাবে না। নেটিজেনদের কেউ কেউ লিখেছেন, ‘জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন দিল্লির এজেন্ডা বাস্তবায়নে হঠাৎ করে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবি সামনে নিয়ে এসেছেন।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের মহাসচিব মুফতি ফখরুল ইসলাম বলেন, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন বাংলাদেশের জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার ধরনের নতুন ষড়যন্ত্র। এই পদ্ধতিতে নির্বাচন দেশের জনগণ কখনো দেখেনি এবং অভ্যস্তও নয়। এটি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ ও ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের পাতানো ফাঁদ। আওয়ামী ফ্যাসিস্টদেরকে নতুন করে এদেশে পুনর্বাসনের আরেকটি গভীর ষড়যন্ত্র চক্রান্ত যা জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের চেতনাকে একেবারে নিঃশেষ করে দেবে। গত ১৬ বছর দেশের জনগণ তাদের ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়েছে। এখন আবার পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন করে জনগণকে তাদের প্রত্যক্ষ ভোটাধিকার হরণের নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে যা দেশের সাধারণ জনগণ কোনো দিন মেনে নেবে না। যদি এ নতুন পদ্ধতিতে নির্বাচনের কোনো ষড়যন্ত্র করা হয় তাহলে এদেশের সাধারণ জনগণ মাঠে নেমে আসবে, যেকোনো মূল্যে তাদের ভোটাধিকার রক্ষায় আন্দোলন সংগ্রাম করতে বাধ্য হবে।

এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্লেষক জাহেদ উর রহমান বলেন, কার এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে হঠাৎ করে কিছু দল পিআর পদ্ধতির নির্বাচন দাবি জোরদার করতে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ২৮ জুন ইসলামী আন্দোলনের সমাবেশে অংশ নেয়া জামায়াত, এনসিপি, এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদসহ কয়েকটি দল ও হিন্দু নেতারা পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবি জানিয়ে সোচ্চার বক্তব্য দেন। অথচ ইসলামী আন্দোলন ও জামায়াতের মধ্যে দা-কুড়াল সম্পর্ক। হাসিনা রেজিমের ১৫ বছর বিএনপিসহ কোনো দল সভা-সমাবেশ করতে না পারলেও ইসলামী আন্দোলন পুলিশ প্রহরায় সমাবেশ করেছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থীদের প্রচারণায় নামতে দেয়া হয়নি অথচ ইসলামী আন্দোলনকে ব্যাপক প্রচারণা চালাতে দেয়া হয়। বছর দেড়েক আগে বরিশাল সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পা-ারা ঘুষি মেরে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থীর মুখম-ল রক্তাক্ত করে। ওই ঘটনার প্রতিবাদে দলটি ২০১৪ সালের পাতানো নির্বাচনে অংশ নেয়া থেকে বিরত থাকে। দলটি দীর্ঘ ১৫ বছর যে আওয়ামী লীগ তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করেছে আগামী সংসদে তাদের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি তোলা হচ্ছে। জামায়াতের স্বার্থ অন্য খানে এবং ছোট ছোট দলগুলো বিএনপির সঙ্গে বার্গেনিং শক্তি বাড়াতে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবিতে সুর মেলাচ্ছে। এরা বুঝে গেছে নির্বাচন হয়ে গেলে এদের গুরুত্ব কমে যাবে। সে জন্য একদিকে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব সংসদে রাখতে চাচ্ছে; অন্যদিকে নির্বাচন বিলম্বিত করতে এই পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবির খেলা খেলছে।

দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছেন এবং ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে অংশগ্রহণ করছেন এমন একাধিক দলের নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েক দিন আগেও ঐকমত্য কমিশনের আলোচনায় পিআর পদ্ধতি তেমন গুরুত্ব পায়নি। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ইসলামী আন্দোলনের মহাসমাবেশের দু’দিন আগ থেকে এ দাবি হঠাৎ করে জোরালো হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে দেখা যায় জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, এবি পার্টি, গণ অধিকার পরিষদের নেতার একই দাবি জানান। বোধিজ্ঞান ভাবনাকেন্দ্রের সভাপতি দয়াল কুমার বড়ুয়া, বাংলাদেশ খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও এবং হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক ভয়াবহ বক্তব্য দেন। গোবিন্দ প্রমাণিক হুমকি দিয়ে বলেন, পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচন না হলে বাংলাদেশের হিন্দু ভোটাররা ভোট দিতে ভোটকেন্দ্রে যাবে না। গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক, দয়াল কুমার বড়ুয়া ও নির্মল রোজারিওর বক্তব্যে প্রকাশ পায় তারা দিল্লির এজেন্ডা নিয়েই ইসলামী আন্দোলনের সমাবেশে হাজির হয়েছেন। এর আগে দিল্লিকে খুশি করতে জামায়াত দলের হিন্দু শাখা গঠন করেছে। দলটির আমির নিজের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সিলেট মহিলা মেডিকেল কলেজে ২০ শতাংশ হিন্দু ধর্মাবলম্বী ডাক্তার-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ভিডিও করে দিল্লিতে পাঠিয়েছেন। তিনি ‘ফ্যাসিস্ট বলতে ভালো লাগে না’, ‘আমরা ভারতের বিরুদ্ধে নই’ ‘আমরা সব মাফ করে দিয়েছি’ এবং ‘জামায়াত ক্ষমতায় গেলে মেয়েরা যেমন খুশি তেমন পোশাক পরে রাস্তায় চলাফেরা করতে পারবে’ এমন বক্তব্য দিয়ে দিল্লির আস্থা অর্জনের চেষ্টা করে। সমাবেশে ইসলামী আন্দোলনের আমির ও চরমোনাই পীর সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম বলেন, ‘আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে হওয়া ছাড়া বিকল্প নেই। সংসদের প্রস্তাবিত উভয় কক্ষেই এ পদ্ধতিতে নির্বাচন হতে হবে। এটি হলে কোনো দল জালেম হওয়ার সুযোগ পাবে না। আমরা ৫৪ বছরে অনেক দলকে দেশ শাসন করতে দেখেছি; কিন্তু ইসলামকে ক্ষমতায় নিতেই পারিনি। এবার ইসলামপন্থিদের ঐক্যের ব্যাপারে গণপ্রত্যাশা তৈরি হয়েছে।’ তার এ বক্তব্য নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিতর্ক চলছে। নেটিজেনদের অনেকেই লিখেছেন, ‘পরের সমালোচনা করার আগে আয়নায় নিজের চেহারা দেখা উচিত। ৫৪ বছরে অনেক দলকে দেশ শাসন করতে দেখেছেন; এ সময় কতবার সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন? ১৫ বছর ফ্যাসিস্ট হাসিনার ছায়ার নিচে থেকেছেন। এখন বড় বড় কথা বলছেন। সারা জীবন জামায়াতের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়েছেন। এখন জামায়াত বন্ধ হয়ে গেল? ইসলামী ধারার দল হয়ে বোধিজ্ঞান ভাবনাকেন্দ্রের সভাপতি দয়াল কুমার বড়ুয়া, বাংলাদেশ খ্রিষ্টান অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্মল রোজারিও এবং হিন্দু মহাজোটের মহাসচিব গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিককে আমন্ত্রণের রহস্য কি?’

পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইসলামী ঐক্য আন্দোলনের আমির ড. ঈশা সাহেদী ইনকিলাবকে বলেন, পিআর পদ্ধতির নির্বাচন আমি নিজেও বুঝি না; জনগণও বুঝেন না। কারো কারো নতুন আবিষ্কার পিআরা পদ্ধতির নির্বাচনের দাবি বাইরের কোনো রাষ্ট্রের এজেন্ডা বাস্তবায়নের স্লোগান কি-না সন্দেহের সৃষ্টি হচ্ছে। সচেতন দেশবাসীকে এ ব্যাপারে ক্ষতিয়ে দেখতে হবে। পিআর পদ্ধতি বাস্তবায়িত হলে সত্যিকার জনপ্রিয় স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সামনে আসতে পারবে না। দলের মধ্যে শুধু তেলবাজদের প্রভাব বাড়বে। যোগ্য ব্যক্তিরা সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় সেবা প্রদানের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হবেন। স্থানীয় নির্বাচনও হলে হ-য-ব-র-ল সৃষ্টি হবে। দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থায় নৈরাজ্য সৃষ্টি হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পদ্ধতিকে কোনো দলকে দিয়ে স্লেøাগান তুলে ফ্যাসিবাদী সরকার দীর্ঘ ১৫ বছর দেশকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। এখন নতুন একটি পিআর পদ্ধতি (অপরিচিত নাম) জাতির ওপর চাপিয়ে দিয়ে কোনো গোষ্ঠীকে ক্ষমতায় আনার স্বপ্ন দেখা হচ্ছে কি-না তা খতিয়ে দেখতে হবে। এখন ‘আল্লাহর আইন চাই সৎ লোকের শাসন চাই’ স্লোগান, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্লেøাগান আসছে না। আসছে নতুন শব্দ কল্যাণরাষ্ট্র চাই। এরা কল্যাণরাষ্ট্রের স্লেøাগান কোত্থেকে আমদানি করছেন?

হঠাৎ করে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবি করছেন তাদের রাজনৈতিক ভিত্তি ও জনসমর্থন আন্দাজ করা যায় বিগত নির্বাচনগুলোর ফলাফলের দিতে তাকালে। দেশে অনেকগুলো নির্বাচন বিতর্কিত হিসেবে চিহ্নিত। তবে এরশাদ পতনের পর থেকে চারটি নির্বাচনকে নির্বাচনের মানদ-ে নিরপেক্ষ হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৯৯১ সালের পঞ্চম, ১৯৯৬ সালের সপ্তম, ২০০১ সালের অষ্টম, ২০০৮ সালের নবম চার জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে বলা হয় নিরপেক্ষ। জনসমর্থনের হিসেবে দেখা যায়, এই চার নির্বাচনে আওয়ামী লীগ (বর্তমানে সাংগঠনিক কর্মকা- নিষিদ্ধ) গড়ে ৩৮.৯ শতাংশ ভোট পেয়েছে। আসন পেয়েছে গড়ে ১৩১টি করে (মোট ৫২৪ আসন)। বিএনপি গড়ে ভোট পেয়েছে ৩৪.৪৭ শতাংশ, আসন পেয়েছে গড়ে ১২০টি করে (মোট ৪৮০ আসন)। জামায়াত গড়ে ভোট পেয়েছে ৭.৪৩ শতাংশ। আসন পেয়েছে গড়ে ১০টি করে (মোট ৪০)। নির্বাচন কমিশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ১৯৯১ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে কাস্ট হওয়া ভোটের ৩০.০৮ শতাংশ (৮৮ আসন) পায় আওয়ামী লীগ। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে দলটির ভোট ৭ শতাংশ বেড়ে ৩৭.৪৪ শতাংশে (১৪৬ আসন) দাঁড়ায়। ২০০১ সালের নির্বাচনে ৪০.১৩ শতাংশ (৬২ আসন) পায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ভোট আরো প্রায় ৮ শতাংশ বেড়ে ৪৮.০৪ শতাংশে (২৩০ আসন) পায়। অন্যদিকে বিএনপি ১৯৯১ সালের নির্বাচনে ৩০.৮১ শতাংশ ভোট (১৪০ আসন) পায়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে দলটির ভোট ৩ শতাংশ বেড়ে ৩৩.৬০ শতাংশ (১১৬ আসন) পায়। ২০০১ সালের নির্বাচনে ৭ শতাংশ বেড়ে ৪০. ৯৭ শতাংশে (১৯৩ আসন) পায়। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির প্রাপ্ত ভোট ৮ শতাংশ কমে ৩২.৫০ শতাংশ (৩০ আসন) পায়। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন দলের ছত্রছায়ায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করা স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত গত আড়াই দশকের ভোটের রাজনীতিতে ধারাবাহিকভাবে পিছিয়েছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে কাস্ট হওয়া মোট ভোটের ১২.১৩ শতাংশ (১৮ আসন) পায়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ৮.৬১ শতাংশ (তিন আসন) পায়। ২০০১ সালের নির্বাচনে ৪ শতাংশ কমে তাদের ভোট দাঁড়ায় ৪.২৮ (১৭ আসন) শতাংশে। ২০০৮ সালের নির্বাচনে কাস্ট হওয়া মোট ভোটের ৪.৭০ শতাংশ (দুই আসন) পায়। পরজীবী এবং সব সময় জনগণের বিপক্ষে অবস্থান নেয়া জাতীয় পার্টিকে হিসাব থেকে বাদ দিলে অন্যান্য দলের আসন সংখ্যা হিসাব করার মতো অবস্থানে ছিল না। ১৯৯১ সাল থেকে যেগুলো প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নির্বাচন হয়েছে আসন যাই হোক, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের ভোটের হারে খুব বেশি ফারাক নেই। ১৯৯১ সালে ৩০ দশমিক ৮ শতাংশ, ১৯৯৬ সালে ৩৩ দশমিক ৬ শতাংশ, ২০০১ সালে ৪১ শতাংশ ও ২০০৮ সালে ২২ শতাংশ ভোট পায় বিএনপি। অন্যদিকে ওই চার নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত ভোট ছিল যথাক্রমে ৩০ দশমিক ২ শতাংশ, ৩৭ দশমিক ৪ শতাংশ, ৪০ দশমিক ১ শতাংশ ও ৪৯ শতাংশ। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বিএনপি-জামায়াত জোট ২০০১ সালে ৪৭ ও ২০০৮ সালে ৩৭ দশমিক ৬১ শতাংশ ভোট পেয়েছিল।

নির্বাচন কমিশনের চার নির্বাচনের প্রাপ্ত ভোট ও আসনের হিসাব কররে দেখা যায় জামায়াত নিরপেক্ষ হিসেবে বিবেচিত চারটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সমর্থন নিয়ে প্রতিটি নির্বাচনে গড়ে ১০টি আসন পেয়েছেন। এতে গতে আসন দাঁড়ায় ৩ শতাংশের একটু বেশি। অন্যান্য দলগুলোর আসনের হিসাব করলে তা ক্যালকুলেটরে ধরবে না। অথচ জাতীয় ঐকমত্য কমিশন এসব দলের পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের দাবির অধিক গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচনকে অনিশ্চিত এবং রাজনীতিকে ঘোলাতে করার চেষ্টা করছে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট এবং রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে পিআর পদ্ধতি উপযুক্ত নয় জানিয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, বাংলাদেশের বাস্তবতায় এবং ইতোপূর্বে আমাদের সঙ্গে সংস্কার কমিশনের যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে, সেই পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের মধ্যে আমরা কোনো ঐকমত্য পাইনি। তা ছাড়া, বাংলাদেশে আনুপাতিক হারে নির্বাচনের ইতিহাস নাই এবং সংসদীয় রাজনীতি এবং সংসদীয় নির্বাচনের ইতিহাস নেই। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এটি একটি নতুন ধারণা। যার জন্য অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা পৃথিবীর বহু দেশে হয়েছে। আমরা দেখেছি, এই দেশের জন্য এটি প্রযোজ্য নয়। আনুপাতিক হারে নির্বাচনের ক্ষেত্রে কোনো সংসদীয় এলাকার ভোটাররা জানবেন না যে, কে তাদের এমপি হবেন। তা ছাড়া প্রয়োজনে এমপিদের কাছে যে তারা যাবেন, নির্ধারিত কোনো ব্যক্তিকে খুঁজে পাবেন না।

রাজনীতি বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জোবাইদা নাসরীন বলনে, আনুপাতিক পদ্ধতিতে সরাসরি ভোটে এমপি নির্বাচনের ব্যবস্থা না থাকায় সংসদে কারা যাবেন, সেটি পুরোপুরি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। আমরা আগে দেখেছি, দুর্নীতির মাধ্যমে মনোনয়ন কেনাবেচা হয়, পিআর পদ্ধতির নির্বাচন হলে প্রতিনিধি কেনাবেচা ভয়াবহ রূপ নেবে।

  জানতে চাইলে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সিনিয়র সহসভাপতি আল্লামা আব্দুর রব ইউসুফী ইনকিলাবকে বলেন, এদেশে পিআর পদ্ধতির নির্বাচন হবে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে পুর্নবাসনের নির্বাচন। জুলাই-আগস্টের ঐতিহাসিন গণঅভ্যুত্থানের অর্জনকে নস্যাৎ করতেই নির্বাচনী কাঠামোতে নতুন আবিষ্কার পিআর পদ্ধতির নির্বাচন। ভিনদেশীয় আবিষ্কার পিআর পদ্ধতির নির্বাচন জাতির ওপর চাপিয়ে দেয়া শুভ লক্ষণ নয়। এর পেছনে অনেক কিছু লুকিয়ে রয়েছে। তিনি বলেন, ভারত এবং ফ্যাসিস্ট হাসিনার প্রেসক্রিপশনে কোনো গোষ্ঠী বাংলাদেশের ক্ষমতায় আসুক তা’ দেশবাসী চায় না। আমরা এসব পিআর পদ্ধতির সাথে আমরা নেই।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

bacan4d slot toto