Bangladesh

পিয়াজের বাজারে কেন এই নৈরাজ্য

আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত পিয়াজ রপ্তানি বন্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত। এমন খবরে বাংলাদেশের বাজারে রীতিমতো প্যানিক ছড়িয়ে পড়ে। ঘোষণাটি ছিল গত শুক্রবার   সকালের। পিয়াজের কেজি ছিল ১০০ থেকে ১২০ টাকার মধ্যে। সন্ধ্যার মধ্যেই দাম ২০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। মূলত অসাধু ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কারণে এক রাতের ব্যবধানে দ্বিগুণ হয়ে প্রতি কেজি দেশি পিয়াজ মানভেদে ২৪০-২৬০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। এতে চক্রের সদস্যরা ভোক্তার পকেট থেকে প্রায় শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে বলে দাবি করেন সংশ্লিষ্টরা। 

বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, পিয়াজ ব্যবসায়ীরা দায়িত্বশীল আচরণ করেননি। তারা সুযোগ নিয়েছেন। 
বাজার ঘুরে ক্রেতাদের মধ্যেও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। অন্যদিকে বিক্রেতাদের মধ্যেও ছিল মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
এদিকে বাংলাদেশে ভারতের পিয়াজ রপ্তানি বন্ধের খবর আসার সঙ্গে সঙ্গে দামও প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যায়, এজন্য আড়তদারদের দুষছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। অতিলোভী মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্যই এজন্য দায়ী বলে মনে করেন তারা। 
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ মুহূর্তে দেশে পিয়াজের দাম বাড়ার কোনো কারণ নেই।

দেশে বছরে পর্যাপ্ত পিয়াজ উৎপাদন হয়েছে। আমদানিও হয়েছে অনেক। এ ছাড়া বাজারে নতুন মুড়িকাটা পিয়াজ উঠতে শুরু করেছে। ফলে বাজারে এ পণ্যের কোনো সংকট নেই। এ ছাড়া বছরে আমদানির দরকার হয় ৬ লাখ টন। কিন্তু আমদানি করা হয়েছে ৮ লাখ টনের বেশি। চাহিদার চেয়ে বেশি পিয়াজ দেশের বাজারে সরবরাহ ও মজুত রয়েছে। এ ছাড়া অনেক পিয়াজ দেশে আসতে পাইপলাইনে আছে। তারপরও কথিত সিন্ডিকেট ভারতের পিয়াজ রপ্তানি বন্ধের দোহাই দিয়ে পরিকল্পতিভাবে এর দাম বাড়াচ্ছে। 

গতকাল রাজস্ব ভবনে এনবিআর আয়োজিত ভ্যাট দিবস ও ভ্যাট সপ্তাহ-২০২৩ উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে বাণিজ্য সচিব বলেন, ভারতে পিয়াজ রপ্তানি বন্ধ সংক্রান্ত ঘোষণার পরদিনই দেশের বাজারে পিয়াজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়া দায়িত্বশীল ব্যবসা নয়। যে পণ্য কিনেছেন ১০০ থেকে ১২০ টাকায়, একদিনেই সে পণ্যের দাম ২০০ টাকা হয় কীভাবে? ভারত রপ্তানি বন্ধ করার পরপরই দাম বাড়তে পারে না।

জানা গেছে, বাংলাদেশে চাহিদার চেয়ে বেশি পরিমাণে পিয়াজ উৎপাদন হয়ে থাকে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তর বলছে, ২০২০-২০২১ সালে বাংলাদেশে পিয়াজের চাহিদা ছিল সোয়া ২৬ লাখ টন। ওই বছর উৎপাদন হয়েছিল ৩৩ লাখ ৬২ হাজার টন পিয়াজ। এর প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ পিয়াজ সংগ্রহ করার পর নষ্ট হয়ে যায়। সেই ঘাটতি পূরণে বাকি পিয়াজ আমদানি করে বাংলাদেশ। এক্ষেত্রে পরিবহন ও মূল্য বিবেচনায় পিয়াজ আমদানিতে প্রতিবেশী দেশ ভারত থাকে সবসময় প্রথম পছন্দ। ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ভারত পিয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিলে সে সময় ৩০০ টাকার বেশি হয়েছিল পিয়াজের কেজি।

তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রতিদিন দেশে পিয়াজের চাহিদা ৭ হাজার ৬৭১ টন বা ৭৬ লাখ ৭২ হাজার কেজি। প্রতি কেজিতে গড়ে অতিরিক্ত ১০০ টাকা মুনাফা করলে দিনে মুনাফা হচ্ছে ৭৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ ভোক্তার পকেট থেকে অতিরিক্ত মুনাফা হিসাবে সিন্ডিকেটের পকেটে যাবে এই টাকা।
ভারত সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র মতে, সবশেষ ২০২২-২৩ সালে দেশটি সবচেয়ে বেশি পিয়াজ রপ্তানি করেছে বাংলাদেশে, যার পরিমাণ ৬ লাখ ৭১ হাজার টনের বেশি। তবে বৃহস্পতিবার ৭ই ডিসেম্বর ভারত পিয়াজ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে গেজেট প্রকাশ করে। যেখানে ৮ই ডিসেম্বর থেকে ৩১শে মার্চ ২০২৪ পর্যন্ত পিয়াজ রপ্তানি নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

বাজার করতে আসা মাইনুল নামের এক ক্রেতা জানান, গত শুক্রবার সকালে বগুড়ায় ছিলাম। এখানকার বাজারে নতুন দেশি পিয়াজের পসরা বসছে। এখানে সাধারণত পাইকারি দরে বেচাকেনা চলে, তারপরও পিয়াজ ১০০ টাকা কেজি শুনে, ভাবলাম ঢাকাতেও তো এরকমই দাম, শুধু শুধু এখান থেকে কিনে এতটা পথ বয়ে নিয়ে যাওয়ার কী দরকার! ২৪ ঘণ্টা পার হয়েছে শনিবার সকালে ঢাকার বাজারে পিয়াজের দাম কেজিতে ৮০ থেকে ১০০ টাকা বেড়ে গেছে। দ্রুত বগুড়ায় বন্ধুকে ফোন করি, সে যেন ঢাকায় আসার সময় আমার জন্য ৫ কেজি পিয়াজ নিয়ে আসে। অপর পাশ থেকে বন্ধু বললো, এখানেও এখন পিয়াজ ২০০ টাকা কেজি।
পিয়াজের খুচরা বিক্রেতা জানালেন, ভারতীয় পিয়াজ বন্ধ শুনেই বাজারের এ অবস্থা, আগের দিনেও দাম ৭০-৮০ টাকা কম ছিল। আগে এমন ঘোষণার পর একটু সময় লাগতো দাম বাড়তে, কিন্তু এখন একেবারে সঙ্গে সঙ্গে খবর চলে আসে, সঙ্গে দামও বেড়ে যায়। তবে দাম বেশি হওয়ায় অনেক দোকানি পিয়াজ তোলেননি নিজের দোকানে। কারণ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার অভিযানে জরিমানা গুনতে হয়। 

বাড্ডার মুরাদ ট্রেডার্সের মালিক মুরাদ বলেন, বাজারে পিয়াজ নাই, কারণ তারা (আড়তদাররা) দেবে না। বাড়তি দামে কিনতে হচ্ছে আমাদের। কাস্টমারের থেকে এক কেজি পিয়াজের দাম ২১০ বা ২২০ টাকা চাইতে তো আমারই বিবেকে লাগে। তিনি বলেন, শুক্রবার সকালে দেশি পিয়াজ ১৬০ টাকা ছিল, বিকালে সেটা হয় ১৮০ টাকা এবং সন্ধ্যার পর ১৯৫ টাকা। গত শনিবার আড়ত থেকে পিয়াজ দিচ্ছে না, বলে অভিযোগ করেন তিনি। দুই দিন আটকে রেখে তারপর ছাড়বে। তবে এই বিক্রেতারা বলেন, আড়তদাররা যদি পিয়াজ গুদামজাত না করে দাম কমায়, তাহলে তারাও কমদামে ক্রেতাদের কাছে বিক্রি করতে পারবে।
কাওরান বাজারের এক খুচরা বিক্রেতা জানান, গত শুক্রবার দুপুর পর্যন্তও পিয়াজের দাম স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু বিকাল থেকে দাম বাড়তে থাকে। 

কাওরান বাজারের ভেতরে আড়তে সারি সারি বস্তায় পিয়াজের স্তূপ দেখা গেছে। একজন আড়তদার জানান, দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে পিয়াজ নেয়ার জন্য প্রায় ২০০ খুচরা ব্যবসায়ীর ফোন এসেছে। সবাই পিয়াজ নিতে চায়। আবার ভারতও পিয়াজ দেবে না। ফলে আমার পিয়াজ তো শেষ হয়ে যাচ্ছে। ফলে দাম বাড়াতে হয়েছে। তিনি বলেন, ভারত পিয়াজ রপ্তানি করবে না এই খবর তারা প্রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই জেনে যান। তবে কেবল ভারতের রপ্তানি বন্ধের কারণে নয় দাম বাড়ার আরও একটা কারণ আছে। আমাদের দেশীয় পিয়াজ প্রায় শেষের পথে। নতুন পিয়াজ বাজারে আসতে একটু দেরি হবে। ফলে দাম কমার সম্ভাবনা নাই।
আরেক আড়তদার জানান, আমরা পার্টির কাছ থেকে মাল নেই। আমরা হলাম দ্বিতীয় পর্যায়। পার্টি এলসি দিয়ে ভারত থেকে পিয়াজ আমদানি করে, তাদের কাছ থেকে আমরা কিনে নেই। এবার আমাদের কাছ থেকে ব্যবসায়ীরা কিনে নিয়ে চতুর্থ ধাপে ক্রেতাদের কাছে পৌঁছায়। তিনি বলেন, প্রতিটি ধাপেই পিয়াজের দাম বাড়তে থাকে। তিনি মনে করেন, অন্য দেশ থেকে পিয়াজ আনলে দাম কমতে পারে। 

কনজুমার্স এসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশ (ক্যাব) মনে করে, সরকারের যথেষ্ট গাফিলতি আছে। ক্যাবের সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ভারত রপ্তানি বন্ধ করেছে আর সঙ্গে সঙ্গে এটা দ্বিগুণ হয়ে যাবে? অথচ পিয়াজ আগে থেকেই মজুত ছিল। আমরা মনে করি এটা সুশাসনের ঘাটতি। তিনি অভিযোগ করেন, ব্যবসায়ীরা যেমন খুশি দাম নির্ধারণ করছে, সরকারের কোনো বিধিবিধানের তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। 
এদিকে পিয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে মাঠে নেমেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ ছাড়া মাঠে রয়েছে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তরও। বিভিন্ন বাজারে চলছে অভিযান। ইতিমধ্যেই গতকাল রাজধানীর ৪টি স্থানে অভিযান চালিয়েছে জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর। 
এদিকে পিয়াজ রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই গতকাল সোনামসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে ২৬টি ট্রাকে ৭৪৩ টন পিয়াজ আমদানি হয়েছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button