পুলিশের সংস্কার বাস্তবায়নে জরুরি রাজনৈতিক সদিচ্ছা
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে একগুচ্ছ সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তদন্ত ও সরাসরি সব পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষমতা আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পরিবর্তে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের ওপর ন্যস্ত করা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইন বদলানো ছাড়া জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের এই ধরনের এখতিয়ার নেই। আইন পরিবর্তন করা হলে তারা তদন্ত করতে পারবে। এর আগে তাদের তদন্ত করার মতো জনবল ও প্রশিক্ষণ দেওয়ার প্রয়োজন হবে। কারও মতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার তদন্তে ‘মাল্টি ডিসিপ্লিনারি টিম’ থাকতে পারে। পুলিশ সংস্কার কমিশন বিভিন্ন বিষয়ে যে প্রস্তাব দিয়েছে তাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, বাজেট বাড়ানো এমনকি বেশ কিছু আইনের সংস্কারসহ নানা চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তারা বলছেন, সংস্কার প্রস্তাবের উদ্দেশ্য ভালো হলেও এটি কীভাবে কোন প্রক্রিয়ায় বাস্তবায়ন হবে, তা নিয়ে এখনই বলা কঠিন। কারণ এর আগে পুলিশ সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখেনি।
এ ব্যাপারে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক মুহাম্মদ নুরুল হুদা সমকালকে বলেন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত করার আইনগত ক্ষমতা মানবাধিকার কমিশনের নেই। আইন বদল করলে তারা সেটি করতে পারবে। আবার যে পুলিশ কমিশনের কথা বলা হয়েছে তাদের কর্মপরিধি কী হবে তা স্পষ্ট নয়। বিদেশে ‘কমপ্লেইনস কমিশন’ রয়েছে। তারা গুরুতর অভিযোগ তদন্ত করে।
তিনি আরও বলেন, সুপারিশে বলা হয়েছে আদালতের আদেশ ছাড়া কোনোভাবে এফআইআরবহির্ভূত আসামি গ্রেপ্তার করা যাবে না। যদি এফআইআরে সব আসামির নাম থাকে তাহলে তদন্তের দরকার হবে কেন? অনেক মামলায় তদন্তের সময় জড়িত অপরাধীদের নাম উঠে আসে। এর পর তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। আসামি গ্রেপ্তারের ব্যাপারে যে সুপারিশ করা হয়েছে সেটি খুব বেশি বাস্তবসম্মত নয়।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, পুলিশের যে সমস্যা রয়েছে তা আমাদের কম-বেশি জানা রয়েছে। আগেও পুলিশ সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া পুলিশের গুণগত পরিবর্তন আনা কঠিন। কারণ অনেকে পুলিশকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে চায়। একদিকে পুলিশকে বলব স্বাধীন ও স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করতে, আরেকদিকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা থাকবে– এটা হতে পারে না। স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত জনবল, বাজেট, যানবাহনসহ সরবরাহ করা দরকার।
পুলিশের একজন কর্মকর্তা জানান, সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বেশ কয়েকটি বিষয় আসেনি।
পুলিশ থেকে যখন মতামত দেওয়া হয়, তখন ওই বিষয়গুলো নিয়ে আলোকপাত করা হয়েছে। বর্তমানে চার ধাপে পুলিশে জনবল নিয়োগ করা হয়– কনস্টেবল, এসআই ও সার্জেন্ট এবং এএসপি। পুলিশের অনেকে মনে করেন– দুটি ধাপে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে। একটি কনস্টেবল; তারা যোগ্যতা ও মেধার ভিত্তিতে পদোন্নতি পেয়ে এএসপি এবং তদূর্ধ্ব কর্মকর্তা হবেন। যারা পদোন্নতির যোগ্য হবেন না, তারা নির্দিষ্ট বয়সের পর অবসরে যাবেন। আরেকটি হলো এএসপি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া। বর্তমানে এসআই থেকে পরিদর্শক এবং পরিদর্শক থেকে এএসপি হতে দীর্ঘ সময় লাগে। অনেকে যোগ্যতা নিয়ে বাহিনীতে ঢুকলেও তাঁর সামনে বড় ধরনের স্বপ্ন থাকে না। পুলিশের মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনার বিষয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশে স্পষ্টভাবে থাকলে ভালো হতো।
পুলিশ সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জব্দকৃত মালপত্রের যথাযথ তালিকা না হলে ও তল্লাশি কার্যক্রমকে সন্দেহজনক মনে হলে তাৎক্ষণিকভাবে ডেপুটি পুলিশ কমিশনার ও জেলা পুলিশ সুপার বরাবর জরুরি কল সার্ভিস চালু করা। থানায় মামলা রুজু ও তদন্ত কঠোরভাবে সার্কেল অফিসার বা পুলিশ সুপার নিয়মিত তদারক করবেন। পুলিশের তত্ত্বাবধানে থানা হাজত ও কোর্ট হাজতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং বন্দিদের আদালত থেকে আনা-নেওয়ার সময় ব্যবহারকারী যানবাহনগুলোতে মানবিক সেবার মান উন্নয়নে সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো। থানার কোনো কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ভয়ভীতির মাধ্যমে অর্থ আদায়ের অভিযোগ উঠলে তাৎক্ষণিকভাবে পুলিশ সুপার ব্যবস্থা নেবেন। এ ছাড়া থানায় বাদী-বিবাদী নিয়ে কোনো ধরনের মধ্যস্থতা বৈঠক করা যাবে না। ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে মামলা দায়ের ও রেকার বিল চার্জ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তদারক করবেন।
পুলিশ বাহিনীকে নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচয় করানোসহ সাইবার ঝুঁকি প্রতিরোধ, আইসিটি খাতের উন্নয়ন, আইসিটির সরঞ্জামাদির প্রমিত মান অনুসরণ করে তা সংগ্রহ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনে একটি আইসিটি এবং টেক কোর গঠনের সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া পুলিশের জন্য একটি পরিপূর্ণ মেডিকেল সার্ভিস গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে।
কমিশনের সুপারিশে আরও বলা হয়– প্রতিটি থানায় আগত নারী ভিকটিম বা আটক নারী ও নারী পুলিশ সদস্যদের জন্য চেঞ্জিং, ড্রেসিং এবং ব্রেস্ট ফিডিং কর্নারের ব্যবস্থা করা। পুলিশ লাইন্স, থানা, ক্যাম্পে কনস্টেবল পর্যায়ের সদস্যদের শতভাগ ডরমেটরি ও কোয়ার্টারের ব্যবস্থা। ডরমেটরিতে নারী-পুরুষের স্বাস্থ্যসম্মত আবাসন সুবিধা, বিশ্রামাগার ও শৌচাগার নিশ্চিত করা। বর্তমানে সহকারী পুলিশ সুপার নিয়োগের ক্ষেত্রে যে ধরনের শারীরিক ও মানসিক যোগ্যতার প্রয়োজন, তা উপেক্ষিত হচ্ছে। এ জন্য বিসিএস পরীক্ষায় পুলিশ ক্যাডারের জন্য আলাদাভাবে শারীরিক যোগ্যতা ও মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা অন্তর্ভুক্ত করে আবেদনের যোগ্যতা নিরূপণ।
কনস্টেবল থেকে এএসআই এবং এএসআই থেকে এসআই পদোন্নতিতে প্রতি বছর পরীক্ষা নেওয়া। বর্তমান পরীক্ষার যে রীতি, তা বাতিল করা। একবার উত্তীর্ণ হলে শারীরিক যোগ্যতা সাপেক্ষে তিন বছরের জন্য পদোন্নতির জন্য যোগ্য হিসেবে বিবেচনার সুপারিশ করা হয়। বিভাগীয় পদোন্নতির নীতিমালা সংস্কার করে কনস্টেবল ও এসআই নিয়োগের ক্যারিয়ার প্ল্যানিং প্রণয়ন। বর্তমানে থানাসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করা নারী পুলিশের সংখ্যা শতকরা মাত্র ৮ শতাংশ। থানা, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারসহ অন্য ইউনিটে নারী পুলিশের সদস্য বাড়িয়ে ২৯ হাজার ২৪৮ জনে উন্নীত করা। বর্তমানে নারী পুলিশ সদস্য রয়েছেন ১৬ হাজার ৮০১ জন।
গত ৩ অক্টোবর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব সফর রাজ হোসেনের নেতৃত্বে পুলিশ সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার। তিন মাসের বেশি সময় কাজ করে গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টার কাছে প্রতিবেদন জমা দেয় কমিশন। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর সবচেয়ে নাজুক পরিস্থিতিতে পড়ে পুলিশ বাহিনী। অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ ও অপেশাদার কর্মকাণ্ডে সমালোচনার মুখে পড়ে তারা।