পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী ও মেয়ের নামে থাকা সম্পদ জব্দ করার আদেশ
পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী ও মেয়ের নামে থাকা স্থাবর সম্পদ জব্দ (ক্রোক) করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে তাঁদের ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ (ফ্রিজ) করারও আদেশ দেওয়া হয়েছে। ঢাকা মহানগর আদালতের সিনিয়র স্পেশাল জজ মোহাম্মদ আস্সামছ জগলুল হোসেন আজ বৃহস্পতিবার এ আদেশ দেন।
আদালতের আদেশের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। তিনি রাতে মুঠোফোনে বলেন, বেনজীর আহমেদের সম্পদ কেনার ৮৩টি দলিল জব্দ করার আদেশ দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে তাঁর স্ত্রী ও মেয়ের নামে থাকা ব্যাংক হিসাবগুলোও অবরুদ্ধ করতে আদালত আদেশ দিয়েছেন।
বেনজীর আহমেদের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের বিষয়ে সংবাদমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং লোকমুখে সব সময়ই আলোচনা ছিল। বিষয়টি প্রায় সবাই জানত।
শাহদীন মালিক, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী
দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালতের এই আদেশ এসেছে। বেনজীর আহমেদের সম্পদ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে আদালতে ওই আবেদন করেছিল দুদক।
এর আগে বেনজীরের সম্পদের অনুসন্ধানে একটি কমিটি করার কথা গত ২২ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলেন দুদকের সচিব খোরশেদা ইয়াসমীন। সেদিন তিনি বলেছিলেন, গণমাধ্যমে সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের যেসব অভিযোগ এসেছে, সেগুলোর বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে।
এরপর ২৩ এপ্রিল হাইকোর্ট এক আদেশে বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধানের অগ্রগতির বিষয়টি হলফনামা আকারে দুই মাস পর জানাতে দুদককে নির্দেশ দেন।
বেনজীর আহমেদ ২০২০ সালের ১৫ এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আইজিপি ছিলেন। এর আগে তিনি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার ও র্যাবের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাবের সাত কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র। ওই সময় র্যাবের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের পাশাপাশি এই বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তারাও নিষেধাজ্ঞার আওতায় ছিলেন। যার মধ্যে বেনজীর আহমেদের নামও ছিল। যুক্তরাষ্ট্র যখন নিষেধাজ্ঞা দেয়, তখন আইজিপির দায়িত্বে ছিলেন বেনজীর আহমেদ।
অবশ্য নিষেধাজ্ঞার মধ্যেই ২০২২ সালের আগস্টে বেনজীর আহমেদ জাতিসংঘের পুলিশপ্রধান সম্মেলনে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে যান। তবে সম্মেলনের কার্যক্রমে অংশ নেওয়ার বাইরে ওই সফরে যুক্তরাষ্ট্রের অন্য কোথাও তিনি যেতে পারেননি।
বেনজীর আহমেদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও তাতে সরকারের কোনো দায় নেই বলে মনে করেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব উল আলম হানিফ। রাতে তিনি মুঠোফোনে বলেন, বেনজীর আহমেদ পুলিশপ্রধানের পদ থেকে অবসর নেওয়ার অনেক পর গণমাধ্যমে তাঁর দুর্নীতির খবর এসেছে। তিনি পুলিশপ্রধান হিসেবে কর্মরত থাকা অবস্থায় কোনো সংবাদমাধ্যমে এসব খবর আসেনি। কর্মরত অবস্থায় দুর্নীতির অভিযোগ যদি উঠত, তখন নিশ্চয়ই সরকার ব্যবস্থা নিত।
আওয়ামী লীগের এই নেতা দাবি করেন, বেনজীর আহমেদ যখন র্যাবের প্রধান ছিলেন, তখন তাঁর ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপের পেছনে রাজনীতি ছিল। সরকারের ওপর চাপ তৈরি করার জন্য র্যাবের কয়েকজন কর্মকর্তার ওপর যুক্তরাষ্ট্র তখন নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। তিনি বলেন, বেনজীর আহমেদের দুর্নীতির অভিযোগের ব্যাপারে দুদক ব্যবস্থা নিচ্ছে।
বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের বিপুল সম্পত্তি অর্জনের বিষয়ে সম্প্রতি দুই পর্বে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন (সাবেক আইজিপির অপকর্ম-১ ও ২) প্রকাশ করে কালের কণ্ঠ। গত ৩১ মার্চ প্রকাশিত প্রথম পর্বের মূল শিরোনাম ছিল ‘বেনজীরের ঘরে আলাদীনের চেরাগ’। প্রতিবেদনে বলা হয়, বেনজীরের পরিবারের মালিকানায় রয়েছে প্রায় ১ হাজার ৪০০ বিঘা জমির ওপর নির্মিত ইকো রিসোর্ট। এই রিসোর্টের পাশে আরও ৮০০ বিঘা জমি কিনেছে তাঁর পরিবার। এ ছাড়া পাঁচ তারকা হোটেলের ২ লাখ শেয়ারও রয়েছে তাঁদের। ঢাকার বসুন্ধরায় সাড়ে তিন হাজার বর্গফুটের ফ্ল্যাটও রয়েছে বেনজীরের পরিবারের। এসব সম্পত্তি অবৈধ টাকায় কেনা হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
‘সাবেক আইজিপির অপকর্ম-২’ প্রকাশ করা হয় ২ এপ্রিল। এই পর্বের মূল শিরোনাম ছিল ‘বনের জমিতে বেনজীরের রিসোর্ট’। এই প্রতিবেদনে বলা হয়, গাজীপুর সদরের ভাওয়াল গড় ইউনিয়নের নলজানী গ্রামে ১৬০ বিঘা জমির ওপর ভাওয়াল রিসোর্ট গড়ে তোলা হয়েছে। এই রিসোর্ট করতে বনের ২০ বিঘা জমি দখল করা হয়েছে। এই রিসোর্টের ২৫ শতাংশের মালিকানা বেনজীর আহমেদের পরিবারের। এ ছাড়া দুবাইয়ে শতকোটি টাকার হোটেল ব্যবসা, সিঙ্গাপুরে সোনার ব্যবসা এবং থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ায় তাঁর পরিবারের জমি রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
কালের কণ্ঠ-এর প্রতিবেদনের পর ২০ এপ্রিল নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে একটি ভিডিও প্রকাশ করেন বেনজীর আহমেদ। ভিডিওতে তিনি দাবি করেন, তাঁর পরিবারের যে সম্পদ রয়েছে, তা বৈধ এবং এর হিসাব ট্যাক্স ফাইলে উল্লেখ রয়েছে। অবৈধ যেসব সম্পত্তির কথা বলা হচ্ছে, তা কেউ প্রমাণ করতে পারলে ওই ব্যক্তি বা গ্রুপকে সেই সম্পত্তি তিনি বিনা পয়সায় লিখে দেবেন বলেও ভিডিওতে দাবি করেন।
সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের ব্যাপারে দুদক আদালতে বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে পেরেছে বলে মনে করেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক। রাতে তিনি বলেন, আদালত তাতে সন্তুষ্ট হয়েই এই আদেশ দিয়েছেন। বেনজীর আহমেদের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদের বিষয়ে সংবাদমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং লোকমুখে সব সময়ই আলোচনা ছিল। বিষয়টি প্রায় সবাই জানত। একটি সংবাদমাধ্যম বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে। কারও এত সম্পদ থাকলে তা চাপা দেওয়া বা গোপন করা অসম্ভব।
গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে অনেকেই জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন করেছেন বলেও উল্লেখ করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, একটা-দুটো উদাহরণ যদি দুদক সৃষ্টি করতে পারে, তাহলে দুর্নীতির জোয়ারে কিছুটা ভাটা পড়বে। তবে দুদক শেষ পর্যন্ত বেনজীর আহমদকে আদালতে দোষী সাব্যস্ত করার মতো যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারবে কি না, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। সংবাদমাধ্যমে আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে লোক দেখানোর জন্য এগুলো করা হচ্ছে কি না, এমন সন্দেহও জনমনে রয়েছে।