Hot

পুষ্টিহীনতার শঙ্কা এখন মধ্যবিত্তও 

  • আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি প্রায় ৩ বছর
  • খাবারের তালিকা ছোট হচ্ছে মধ্যবিত্তের
  • পুষ্টিহীনতার শঙ্কায় শিশুরা
  • খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় নির্দিষ্ট আয়ের মানুষও

দেশে প্রায় তিনবছর ধরে গড় মজুরির চেয়ে গড় মূল্যস্ফীতি বেশি। অর্থাৎ মানুষের আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি। একসময় এটি শুধু নিম্নবিত্তদেরই ভোগান্তির কারণ ছিল। কিন্তু উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে এটি এখন মধ্যবিত্তদেরও চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাজারের তালিকা প্রায় অর্ধেকে নেমেছে অধিকাংশ পরিবারে। পর্যাপ্ত খাবার কিনতে না পারায় অধিকাংশ পরিবারই আছে পুষ্টিহীনতার ঝুঁকিতে। বিশেষ করে এটি প্রভাব ফেলছে শিশুদের পুষ্টিতে।

অর্থনীতির স্বাভাবিক হিসাবে দেশের গড় মূল্যস্ফীতির চেয়ে গড় মজুরি বেশি হলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ইতিবাচক থাকে। কিন্তু ২০২২ সালের মার্চ মাস থেকে দেশের গড় মজুরির চেয়ে গড় মূল্যস্ফীতি বেশি। অর্থাৎ মানুষের আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি।

খাদ্য নিরাপত্তা আইন অনুযায়ী খাদ্য মূল্যস্ফীতি যদি ১০ শতাংশের বেশি চলতে থাকে তাকে নীরব দুর্ভিক্ষ হিসেবেই ধরা হয়। পুষ্টিবিদরা বলছেন, কেবল মাছ, মাংসে পুষ্টি সীমাবদ্ধ নয়। শাক-সবজির আহারের মাধ্যমেও পুষ্টি ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব। তবে, মানুষের  আয় বৈষম্যের কারণে খাদ্যের কাঁটছাঁট আরও ব্যাপক হারে বাড়ছে। বাদ যায়নি নিম্ন আয়ের মানুষ থেকে মধ্যম আয়ের মানুষও। এসব মানুষ খেতে পারছে না বিষয়টি এমনও নয়। তবে অনেকটা অর্ধাহারেই দিন কাটছে বলা যায়।
 
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য বলছে, ২০২২ সালের জানুয়ারিতে দেশে সার্বিক মূল্যম্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। আর মজুরি বৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক ৯২ শতাংশ। পরের মাস ফেব্রুয়ারিতে মূল্যস্ফীতি হয়েছিল ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ; মজুরি বেড়েছিল ৬ দশমিক শূন্য তিন শতাংশ। এরপর থেকে মূল্যস্ফীতির তুলনায় মজুরি বৃদ্ধির হার কম হওয়ার তথ্য দিচ্ছে বিবিএস। সবশেষ নভেম্বর মাসে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। আর জাতীয় মজুরি হার ছিল ৮ দশমিক ১০ শতাংশ। এরমানে মূল্যস্ফীতি যে হারে বেড়েছে, মজুরি সেই হারে বাড়েনি। 

গ্রাম-শহর নির্বিশেষে ১৪৫টি নিম্ন দক্ষতার পেশার মজুরির ওপর হিসাব করে এই তথ্য দিয়েছে পরিসংখ্যান ব্যুরো।

বিষয়টি সহজভাবে ব্যাখ্যা করলে এমনভাবে বলা যায়, গত নভেম্বরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশ। এর মানে হলো, ২০২৩ সালের নভেম্বরে চাল, ডাল, তেল, লবণ, পোশাক, বাসাভাড়া, যাতায়াত, শিক্ষা খরচসহ জীবনযাপনের খরচ চালাতে যদি ১০০ টাকা খরচ হতো, তাহলে এ বছরের নভেম্বরে একইভাবে জীবন যাপন করতে আপনার খরচ হয়েছে ১১১ টাকা ৩৮ পয়সা। খরচ বৃদ্ধির হার ১১ দশমিক ৩৮।

বিবিএসের খানা আয়-ব্যয় জরিপ ২০২২ এর তথ্য বলছে, দেশের মানুষের প্রতিদিন গড় ক্যালরি গ্রহণের হার ২ হাজার ৩৯৩। এটি দেশের গড় হিসাব। এখানে শহর ও গ্রামের ক্যালরি গ্রহণের হারে তফাত আছে। গ্রাম এলাকায় একজন মানুষের প্রতিদিন গড় ক্যালরি গ্রহণের হার ২ হাজার ৪২৪ গ্রাম, সেখানে শহর এলাকায় ১০০ গ্রাম কম, মাত্র ২ হাজার ৩২৪ গ্রাম। 

২০২২ সালের পর খানা আয়-ব্যয় জরিপ হয়নি। ২০২২ সালের আগস্ট মাসের হঠাৎ করে তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় ওই মাসেই মূল্যস্ফীতি ৭ দশমিক ৪৮ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে ঠেকে। এরপর থেকে মূল্যস্ফীতি আর নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি।

বিবিএস বলছে, জাতীয় মজুরি বেড়েছে এবং বৃদ্ধির হার ৮ দশমিক ১০ শতাংশ। এর মানে দাঁড়ায়, ২০২৩ সালের নভেম্বরে যদি একজনের আয় ১০০ টাকা হয়, তাহলে এ বছরের নভেম্বরে তার আয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০৮ টাকা ১০ পয়সা। সুতরাং আয় খানিকটা বাড়লেও গত বছরের একই সময়ের তুলনায় একই পণ্য ও সেবার জন্য বেশি টাকা খরচ করতে হচ্ছে। ফলে খরচের ফর্দ কাটছাঁট করতে হচ্ছে।

অর্থাৎ ৪ জনের পরিবারে আগে যে পরিমাণ খাবার কিনতে হতো, আয় কমে যাওয়ায় তা অনেককেই অর্ধেকে নামাতে হয়েছে। যার পরিবারে মাসে কমপক্ষে ৫ ডজন ডিমের প্রয়োজন হতো- তাকে এখন কিনতে হচ্ছে ২ থেকে সর্বোচ্চ ৩ ডজন।

আয় বাড়লেও খরচ যখন তার তুলনায় বেশি বাড়ে, তখন আসলে আপনার প্রকৃত আয় কমে যায়। বাংলাদেশে এখন ঠিক তা-ই ঘটছে। দেশের ৮০ শতাংশের বেশি কর্মসংস্থান হয় অনানুষ্ঠানিক খাতে। এগুলোর প্রায় শতভাগই মজুরিভিত্তিক কর্মসংস্থান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. আবু তোরাব এম এ রহিম দেশ রূপান্তরকে বলেন, দারিদ্রতার সময় মানুষ যা খায় তাকে আমরা স্ট্রেস ফুড বলে থাকি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মানুষ পর্যাপ্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার কতটা গ্রহণ করতে পারছে? তাছাড়া দীর্ঘদিন থেকেই আমাদের দেশে আয় বৈষম্য ব্যাপক আকারে রয়েছে। সে অবস্থায় নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ বাজারে ব্যয়ের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে পর্যাপ্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করতে পারছেন না। যা মাত্রাতিরিক্ত চলতে থাকলে মানুষ তাদের কর্মক্ষমতা হারানোর জোর সম্ভবানা রয়েছে। তিনি আরও বলেন, মানুষের এনার্জি রিকোয়েরমেন্ট (খাবারের চাহিদা) যদি যথাযথ পূরণ না হয়, তাহলে শরীর কিন্তু অন্যান্য নিউট্রেন্ট (পুষ্টি) কোনো কাজে ব্যবহার করতে দেয় না। সুতরাং বৈচিত্র্যময় অন্যান্য যাই খাক, প্রত্যেকের মূল ক্যালরি চাহিদা রয়েছে। সেটির ঘাটতি থাকলে অন্যান্য খাবার কোনো কাজে আসবে না। বিশেষ করে আমাদের শিশুরা যদি এই পুষ্টি শঙ্কার মধ্য দিয়ে বড় হয়, তাহলে তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতার পাশাপাশি মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়বে।

গেল কয়েক বছর দেশে মূল্যস্ফীতি একের পর রেকর্ড গড়েছে। ব্যয়ের তুলনায় আয় না বাড়ায় মানুষ খাদ্যাভ্যাসে এনেছেন নানা পরিবর্তন। নিম্ন আয়ের মানুষ বহু আগেই পাত থেকে মাছ মাংস ছেটে ফেলে শাকসবজিতে নির্ভরতা বাড়িয়েছেন। তবে শীতের ভরা মৌসুমেও সবজির দাম এখনো সহনীয় পর্যায়ে না থাকায় অনেক ক্রেতায় দাম কমার অপেক্ষায় পর্যাপ্ত সবজি কিনছেন না। এতে এক শ্রেণী পেশার মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভুগেছেন।

এদিকে নতুন করে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে ১৪ শতাংশের কাছাকাছি পৌঁছেছে। টানা আট মাস ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে আছে। বাজারে জিনিসপত্রের ঊর্ধ্বমুখী দামের কারণে গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষের পাশাপশি বড় ধরনের ভোগান্তিতে পড়েছেন মধ্যম আয়ের মানুষও। ফলে অনেকে এখন চাহিদামতো খাবার যোগান দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।

তেমনি বেসরকারি ব্যাংকের এক কর্মকর্তা উচ্ছাশ হাওলাদার। ঝিগাতলা থেকে অফিস করেন নিউ এলিফ্যান্ড রোর্ডে। উচ্ছাস হাওলাদারের মাসিক বেতন ২৫ হাজার টাকা হলেও স্ত্রী, স্কুল পড়ুয়া এক মেয়ে ও মাকে নিয়ে এই টাকা সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। আগে প্রতি মাসে অন্তত ৫ কিলো গরুর মাংস কিনলেও এখন কেনেন মাত্র ২ কেজি। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনায় অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে ভোগপ্রবণতায় তাকে বেশ সতর্ক হতে হয়েছে। 

দেশ রূপান্তরকে তিনি জানান, নতুন চাকরিতে জয়েন করেছি মাত্র মাস চারেক হলো। যে টাকা আয় হচ্ছে, তা দিয়ে সংসার চালানো সত্যি কঠিন হয়ে যাচ্ছে। ২৫ হাজার টাকা মধ্যে বাসা ভাড়ায় চলে যাচ্ছে ১৩ হাজার টাকা। বাকি ১২ হাজার মায়ের ওষুধ, বাচ্চার টিউশন ও সংসারের খরচ চালানো অনেক বেশি কঠিন বিষয়। তিনি আরও বলেন, দেশের মূল্যস্ফীতি বাড়ার বিষয়টি নতুন কিছু নয়। এটি ক্রমাগত গেল কয়েক বছর বাড়ছে। আমরা এতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। কিন্তু পেটতো এই অভ্যস্ততা মানে না। মায়ের ওষুধের দেরি হলে রোগ সেটি শুনে না। তাই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনায় অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে আমাদের পরিবারের ভোগপ্রবণতাকে ছুড়ে ফেলেছি। এটি কেবল উচ্ছাশ হাওলাদারের একার গল্প নয়। শহর থেকে গঞ্জের প্রত্যের পরিবারের একই পরিস্থিতি।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ হিসাবে, গত নভেম্বর মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৩ দশমিক ৮০ শতাংশ। এটি গত সাড়ে ১৩ বছরের মধ্যে খাদ্য মূল্যস্ফীতির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ হার। গত জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ দশমিক ১০ শতাংশে উঠেছিল। নভেম্বরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বাড়ার পাশাপাশি সার্বিক মূল্যস্ফীতিও বেড়ে ১১ দশমিক ৩৮ শতাংশে উঠেছে। অর্থাৎ গত বছরের নভেম্বরে ১০০ টাকায় যে পণ্য ও সেবা কেনা গেছে, চলতি বছরের নভেম্বরে একই পরিমাণ পণ্য ও সেবা কিনতে ভোক্তাকে ১১১ টাকা ৩৮ পয়সা খরচ করতে হয়েছে।

এর আগে খাদ্য মূল্যস্ফীতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল ২০১১ সালের মার্চ মাসে। তখন এই হার ছিল ১৩ দশমিক ৮৭ শতাংশ। এরপর চলতি বছরের জুলাই মাসের খাদ্য মূল্যস্ফীতি সেই হার ছাড়িয়ে গিয়েছিল। অন্যদিকে গত মার্চ মাসের পর থেকে টানা আট মাস খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের নিচে আর নামেনি।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button