পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ: ফিরে দেখা কিছু স্মৃতি
এ বছর ৬ এপ্রিল একটি পূর্ণ সূর্যগ্রহণ হবে। আর মাত্র আট দিন বাকি। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসসহ উত্তর আমেরিকার বেশ কিছু অঞ্চল থেকে এই পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দৃশ্যমান হবে। চাঁদ সূর্যকে পুরোপুরি ঢেকে ফেলায়, সেই সময় কিছুক্ষণের জন্য দিনের বেলায় রাত নেমে আসবে।
রাতের তারারা দৃশ্যমান হবে দিনের বেলায়। এই বিরল দৃশ্য দেখার জন্য সারা পৃথিবীর মহাকাশপ্রেমীরা খুবই আগ্রহ নিয়ে বসে আছেন।
সেজন্য ঠিক করেছি, কদিন পরেই বাক্স পেটরা, ক্যামেরা সব গুছিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে ছোট ভাইয়ের বাসার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ব। পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখার এই সুবর্ণ সুযোগ কী হেলায় হারানো যায়?
পূর্ণ সূর্যগ্রহণ নিয়ে ছাত্র জীবনের স্মৃতিচারণমূলক লেখাটি আজ আবার শেয়ার করলাম।
ফিরে দেখা সূর্যগ্রহণ
ছোটবেলা থেকেই মহাকাশ নিয়ে আমার উৎসাহ একটু বেশি। এর জন্য অবশ্য আমার আম্মার কিছুটা প্রভাব ছিল। ছোটবেলায় বাসার ছাদে বসে তিনি আমাকে রাতের আকাশের তারাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেন। মহাকাশ যে কত বিশাল সেটা আম্মার কাছেই প্রথম জানতে পারি। পরে এ ব্যাপারে আমার আগ্রহ ধীরে ধীরে আরও বৃদ্ধি পায় আমার বাল্যবন্ধু জামিলের কল্যাণে। জামিলের আব্বা বাংলাদেশের প্রখ্যাত বিজ্ঞান লেখক আব্দুল্লাহ আল মুতি শরফুদ্দিন। উনি বাংলায় জনপ্রিয় বিজ্ঞানের অনেক বই লিখেছেন। বাংলাভাষায় এতটা প্রাঞ্জল করে বিজ্ঞানের কঠিন বিষয়গুলো তাঁর মতো করে আর কেউ লিখতে পেরেছেন কিনা আমার জানা নেই। জামিল আর আমি ছিলাম হরিহর আত্মা।
আমরা একসাথে গল্প করতে বসলে বিজ্ঞানের কথাই হত বেশি। জামিলের কাছ থেকে নিয়েই প্রথম কার্ল সেগানের লেখা ‘কসমস’, আইজ্যাক আসিমভের লেখা ‘দি কলাপসিং ইউনিভার্স’ বইগুলো পড়ি। মহাকাশ নিয়ে আমার আগ্রহ দিন দিন বাড়তে থাকে।
একদিন জামিল আমাকে জানাল কিছুদিন পর একটি পূর্ণ সূর্যগ্রহণ হবে, যেটা বাংলাদেশ থেকেও দেখা যাবে। তবে ঢাকা থেকে পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখা যাবে না।
পূর্ণ সূর্যগ্রহণ দেখতে হলে যেতে হবে চট্রগ্রামের কাপ্তাইতে। আমরা তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র। আমাদের জন্য কাপ্তাই যাওয়া মানে বিশাল খরচের ধাক্কা। কী করব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। ১৯৮০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখে পূর্ণ সূর্যগ্রহণ হবে। তখনও বেশ কিছুদিন সময় আছে। টাকাপয়সা জমানো শুরু করলাম। কথায় বলে, উঠল বাই তো কটক যাই। আর এতো মাত্র কাপ্তাই যাওয়া। পূর্ণ সূর্যগ্রহণ কি আর মিস করা যায়। বাসায় আব্বা আম্মাকে রাজি করাতে বেগ পেতে হলো না। তারা ছেলের মহাকাশ বাতিক নিয়ে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল ছিলেন।
জামিল বলল শুধু সূর্যগ্রহণ দেখলেই চলবে না। একে বৈজ্ঞানিক ভাবে পর্যবেক্ষণ করতে হবে। তার মানে সূর্যগ্রহণের সময় প্রকৃতিতে কী কী পরিবর্তন হয় সেটাও রেকর্ড করতে হবে। আর অবশ্যই ছবি তুলতে হবে সূর্যগ্রহণের। সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখে জামিলকে আহ্বায়ক করে দুই সদস্যের একটি পর্যবেক্ষক টিম গঠন করা হলো। এই পর্যবেক্ষক টিমের অপর সদস্য নির্বাচিত হলাম আমি।
যথাসময়ে পর্যবেক্ষক টিম যন্ত্রপাতি নিয়ে চট্রগ্রামে গিয়ে হাজির হলো। যন্ত্রপাতি মানে একটি কমদামি ক্যামেরা, ট্রাইপড, ফিল্টার, কালো চশমা ইত্যাদি। বুদ্ধি করে সাথে করে একটা থার্মোমিটারও নিয়ে গিয়েছিলাম সূর্যগ্রহণের সময় তাপমাত্রা রেকর্ড করার জন্য। চট্রগ্রামে গিয়ে উঠলাম জামিলের খালার বাসায়। পাহাড়ের উপর বিশাল বাসা। যত্ন আত্তির কোনো অভাব হলো না। খালা মনে হয় একটু অবাকই হলেন আমাদের আগমনের হেতু শুনে।
সূর্যগ্রহণের দিন ভোরে কাঠবডি বাসে চেপে কাপ্তাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হলাম আমরা। এখানে বলে রাখি চট্রগ্রাম থেকে আমাদের অভিযাত্রায় আরও দুটি ছেলে যোগ দিয়েছিলে। দুজনেই ঢাকার ছেলে। একজন হলো বাবলু, জামিলের ক্লাসমেট। অন্যজন বাবলুর বন্ধু, নামটি একদম ভুলে গেছি এখন। দলে ভারী হয়ে ভালোই লাগল। একসময় আঁকাবাঁকা পথে আমরা কাপ্তাই পৌঁছে গেলাম।
কাপ্তাই পাহাড়ি জায়গা। কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে এখানে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছিল পাকিস্তান আমলে। এর ফলে বিশাল এলাকা প্লাবিত হয়ে কাপ্তাই হ্রদের সৃষ্টি হয়, ডুবে যায় পাহাড়ি মানুষের ঘরবাড়ি, জায়গা জমি। কাপ্তাই হ্রদের পানিতে কত পাহাড়ি মানুষের কান্না জমানো আছে আমরা সমতলের মানুষেরা সেটা বুঝি না বা বুঝতে চাই না।
কাপ্তাই পৌঁছে শহর থেকে একটু দূরে কর্ণফুলীর তীরে একটা খোলা জায়গা বেছে নিলাম আমাদের পর্যবেক্ষণের স্থান হিসেবে। ক্যামেরা রেডি, বাকি শুধু অ্যাকশন। সূর্য তখনও মাথার উপর জ্বলজ্বল করছে। সূর্যগ্রহণের তখনও কিছুটা সময় বাকি রয়েছে।
দুপুর সোয়া দুইটার দিকে সূর্যগ্রহণ শুরু হলো। চাঁদ আস্তে আস্তে সূর্যের বলয়কে ঢেকে দেয়া শুরু করল। সূর্যগ্রহণের সময় সরাসরি সূর্যের দিকে তাকালে চোখের ক্ষতি হতে পারে। তাই আমরা ফিল্টার গ্লাস দিয়ে গ্রহণ দেখতে থাকলাম । প্রথমে কিছুই বোঝা যাচ্ছিল না। কিন্তু একটু পরই দেখলাম সূর্যের আলো ধীরে ধীরে কমে যাওয়া শুরু করেছে। চাঁদ গ্রাস করছে সূর্যকে।
জামিল ব্যস্ত হয়ে পড়লো ওর ক্যামেরা নিয়ে। আমার দায়িত্ব ছিল তাপমাত্রা রেকর্ড করা। আমি সেটা বেমালুম ভুলে গিয়ে দেখতে থাকলাম ভর দুপুরবেলাটা কীভাবে সন্ধ্যা হয়ে যাচ্ছে। সূর্য তখনও মধ্যগগণে। অথচ নিভে যাচ্ছে তার আলো। নেই কোনো গোধূলিবেলা। আলো আর আঁধারের এই মোহনীয় খেলায় এক আশ্চর্য পরিবর্তন দেখলাম জীবজগতে। সূর্যের আলো কমে যাওয়াতে পাখির কলরবে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠল। বুঝলাম পাখিরা খুবই বিভ্রান্ত হয়ে গেছে। এখনো তাদের বাড়ি ফেরার সময় হয়নি, অথচ ভরদুপরেই রাত হয়ে আসছে। আকাশ জুড়ে পাখিদের ভীতসন্ত্রস্ত উড়াউড়ি দেখে আমিও মোহিত হয়ে গেলাম।
অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। পূর্ণ সূর্যগ্রহণের ঠিক পূর্ব মুহূর্তের কথা না বললে আমার গল্পটা অসম্পূর্ণ রয়ে যাবে। আমরা সবাই জানি চাঁদের পৃষ্ঠ মোটেই সমতল নয়। সেখানে রয়েছে নানা ধরনের খানাখন্দ, গিরিখাত আর পাহাড়-পর্বত। পূর্ণ সূর্যগ্রহণের ঠিক পূর্বমুহূর্তে সূর্যের শেষ রশ্মি এই অসমতল পৃষ্ঠের ফাঁকফোকর দিয়ে ঠিকরে বেরিয়ে আকাশের বিভিন্ন কোণে ছড়িয়ে পড়ে। তখন বিচিত্র এই আলোক রশ্মি অন্ধকার আকাশের দিগ্বিদিকে ছোটে । এটা স্থায়ী হয় মাত্র দশবারো সেকেন্ডের মতো। এ এক মোহনীয় দৃশ্য। এই দৃশ্য আমি জীবনে একবারই দেখেছি। এখন থেকে ৪৪ বছর আগে দেখা সূর্যগ্রহণের সেই অপরূপ রূপ আমি আজও ভুলিনি।
সূর্যের পূর্ণ গ্রহণের স্থায়ীত্ব ছিল মাত্র মিনিট দুয়েক। এই স্বল্প সময়ের জন্য অদ্ভুত এক আঁধার নেমে এলো চারপাশে। রাতের তারারা দৃশ্যমান হয়ে উঠলো দিনের আকাশে। রবিঠাকুর বলে গেছেন, ‘রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে’। কথাটি যে সত্যি, সেটা আবার প্রমাণ হলো। তারপর ধীরে ধীরে গ্রহণমুক্ত হওয়া শুরু করলেন দিনমণি। রাতের তারারা আবার হারিয়ে গেলো দিনের আলোর গভীরে। আমরাও অভিভূত হয়ে প্রত্যক্ষ করলাম একটি প্রাকৃতিক ঘটনা, যা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই মানুষকে বিমোহিত করে চলেছে।
প্রতি বছরই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও সূর্যগ্রহণ হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এটা হয় আংশিক সূর্যগ্রহণ। পূর্ণ সূর্যগ্রহণ কমই হয়। আর হলেও এটা দেখা যায় খুবই সীমিত এলাকা থেকে। সেজন্য বেশিরভাগ মানুষই এটা দেখার সুযোগ পান না। সেজন্য বলে রাখি, আপনার এলাকায় কখনো পূর্ণ সূর্যগ্রহণ হলে সেটাকে অবশ্যই ভালো করে পর্যবেক্ষণ করবেন। কারণ এই সুযোগটি আপনার জীবন আরেকবার নাও আসতে পারে।