পৃথক পূর্বাঞ্চলীয় রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা!, পাহাড়ে কেএনএফের তৎপরতা
নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরামসহ ইস্টার্ন স্টেট গঠনের প্রচেষ্টা দীর্ঘদিনের-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
অশান্ত হয়ে উঠেছে পাহাড়। কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) নামের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর তৎপরতায় সবাই বিস্মিত। সরকারের তরফে বলা হচ্ছে, এ তৎপরতার নেপথ্যে বাইরের সংযোগ আছে। বিশেষ করে এ অঞ্চলে একটি আলাদা পূর্বাঞ্চলীয় রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনার অংশ কেএনএফ-এর তৎপরতা। এ ধরনের প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন ধরেই চলছে। বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলায় ব্যাংক ডাকাতি এবং ব্যাংক ম্যানেজারকে অপহরণের ঘটনার সঙ্গে এ তৎপরতার যোগসূত্র পেয়েছে সরকার।
কেএনএফ-এর তৎপরতার সঙ্গে ভূরাজনীতির কোনো সংযোগ আছে কি না জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘এটার তো ইমপ্যাক্ট আছে। নাগাল্যান্ড, মণিপুর, মিজোরাম নিয়ে ইস্টার্ন স্টেট গঠনের একটা প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে। বাংলাদেশের পাহাড়ি অঞ্চলে বোম জনগোষ্ঠীর মাত্র কয়েক শ পরিবার রয়েছে। তারা সবাই খ্রিষ্টান। কুকি-চিন গ্রুপটা তাদেরই। এই গ্রুপের সঙ্গে বাইরের সংযোগ এটুকুই। এর বেশি বাইরের সংযোগ নেই। এদের তৎপরতায় নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, মণিপুরের লোকেরাও বিরক্ত।’
কুকি-চিনের তৎপরতা দমনে আঞ্চলিক কোনো সহযোগিতা নেওয়া হবে কি না-জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমন সম্ভাবনা নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, ‘এসব তৎপরতা দমনে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর ভূমিকা ইতিবাচক। বিশেষ করে ভারত নিজেও এসব তৎপরতায় বিরক্ত। মিয়ানমারে এখন যুদ্ধ চলছে।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘কুকি-চিনের বিরুদ্ধে পুলিশ ও র্যাব অভিযান চালাবে। প্রয়োজন হলে আর্মিও তাতে যোগ দেবে। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন সেনাপ্রধান।’
এদিকে বান্দরবানে থানচি ও রুমায় কয়েক দফা সন্ত্রাসী হামলার পর সেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দমনে কম্বিং অপারেশন শুরু করেছে যৌথ বাহিনী। রোববার দুপুরে বান্দরবান সেনা রিজিয়ন মাঠে গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানান সেনাপ্রধান জেনারেল এসএম শফিউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, ‘ইতোমধ্যে কম্বিং অপারেশন শুরু হয়েছে। বিভিন্ন বাহিনী সম্মিলিতভাবে এ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এর আগে সেনাপ্রধান সকাল ১০টার দিকে হেলিকপ্টারে বান্দরবানের রুমা ও থানচি উপজেলা পরিদর্শন করেন।
জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্তমান পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ বিষয়টাই প্রধান। ওই অঞ্চলে খুনখারাবির ঘটনা বৃদ্ধি পেয়ে অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা বিরাজ করছে। এভাবে বাইরের ইন্ধনের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এ কারণে সশস্ত্র উপায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে নিরাপত্তার উদ্যোগের পাশাপাশি সংকটের গভীরে প্রবেশ করতে হবে। ভূরাজনৈতিক ঝুঁকি থাকায় অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করাই হবে বুদ্ধিমানের।’
বান্দরবানের দুই উপজেলায় মঙ্গলবার রাতে ১৭ ঘণ্টার মধ্যে দুটি ব্যাংকের তিনটি শাখায় হামলা, অস্ত্র লুট ও অপহরণের ঘটনা ঘটে। এরপর বৃহস্পতিবার রাতে থানচি থানা লক্ষ্য করে গুলি করেছে সশস্ত্র গোষ্ঠী। কেএনএফ তাদের শক্তির জানান দিচ্ছে।
প্রসঙ্গত, পাহাড়ে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তি চুক্তি সই হলে কয়েক দশক ধরে চলতে থাকা অশান্তির অবসান হয়। পার্বত্য শান্তিচুক্তিতে সই করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির প্রধান জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় লারমা ওরয়ে সন্তু লারমা। পার্বত্য অঞ্চল থেকে অনেক সেনা ক্যাম্প সরিয়ে আনা হয়। কিন্তু শান্তিচুক্তির প্রায় আড়াই দশক পর তুলনামূলক নতুন কেএনএফ গ্রুপের হামলার ঘটনায় নতুন করে অশান্তি সৃষ্টির আশঙ্কা করা হয়। কেএনএফ গ্রুপের প্রধান নাথান বম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের সাবেক ছাত্র। তিনি চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা জনগোষ্ঠীর বাইরে ক্ষুদ্র গোষ্ঠীগুলোর জন্য পৃথক রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে কেএনএফ গঠন করেন। এ গোষ্ঠীর সশস্ত্র কর্মীরা মিজোরামসহ বাংলাদেশের বাইরে বিভিন্ন স্থানে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন।
ভারত মহাসাগর ঘিরে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো চীনের আধিপত্য কমাতে তৎপর। ভূরাজনীতির এমন এক সমীকরণের মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তপ্ত হয়ে উঠল। বিশেষ করে মিয়ানমারে জান্তাবিরোধী গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্র বার্মা অ্যাক্ট করেছে। ভূরাজনীতির এমন প্রতিযোগিতার সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রামের ঘটনার কোনো যোগসূত্র আছে কি না, সেসব নিয়েও বেশ আলোচনা হচ্ছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) উদ্যোগে বাংলাদেশ যুক্ত হয়েছে আগেই। যুক্তরাষ্ট্র ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজি (আইপিএস) গড়ে বাংলাদেশকে যুক্ত করতে চাইছে। বড় শক্তিগুলোর অধিপত্য বিস্তারের লড়াইয়ে বাংলাদেশ চাপে পড়েছে।