Hot

পোশাক খাতে নয়া উদ্বেগ

ইরান-ইসরাইল সংকট বাংলাদেশের রপ্তানি বাণিজ্যে নতুন করে উদ্বেগ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ ছাড়া চলমান দ্বন্দ্ব দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় সম্ভাব্য হুমকি তৈরি করেছে। বলা হচ্ছে বৈশ্বিক জ্বালানি বাজার অস্থিতিশীল হলে বাড়তে পারে জ্বালানি তেলের দাম। বেশি দামে জ্বালানি আমদানিতে ব্যর্থ হলে লোডশেডিং ও অর্থনৈতিক ক্ষতি বাড়তে পারে। সুয়েজ খাল বন্ধ থাকলে বাড়বে পণ্য পরিবহন ও আমদানি ব্যয়। বাড়বে পণ্য পৌঁছানোর সময়ও। এমন পরিস্থিতিতে ক্রেতারা পোশাকের জন্য বিকল্প উৎস খুঁজবে। এতে বাংলাদেশের রপ্তানি অর্ডার হারানোর শঙ্কা রয়েছে। যদি এ সংঘর্ষ দীর্ঘায়িত হয়, তাহলে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে এর বিভিন্ন প্রভাব পড়তে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা। তাদের মতে, ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর যেমনটা ঘটেছিল, ঠিক সেই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। 

সংশ্লিষ্টরা সতর্ক করে বলছেন, ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীদের হামলায় ইতিমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত লোহিত সাগরের শিপিং রুট বাড়তি বাধার সম্মুখীন হয়েছে।

বিশেষ করে হরমুজ প্রণালিতে আরও জটিলতা দেখা দিলে চলমান পরিস্থিতি বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলে উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। এ নৌপথটি দিয়ে প্রতিদিন বৈশ্বিক তেল উৎপাদনের এক-পঞ্চমাংশ পরিবাহিত হয়। এর ফলে পণ্য পরিবহনের খরচ ও শিপিংয়ের সময় বেড়ে যেতে পারে।

গত রোববার সিরিয়ার দামেস্কে নিজেদের কনস্যুলেট ভবনে ইসরাইলি হামলার প্রতিশোধ নিতে ইসরাইলে সরাসরি ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। মধ্যপ্রাচ্যের আরও কয়েকটি দেশ এ উত্তেজনায় জড়িয়ে পড়েছে। এতে মধ্যপ্রাচ্য সংকট দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ থেকে সময়মতো পণ্য হাতে না পাওয়ার শঙ্কায় ইউরোপের ক্রেতারা তাদের কাছাকাছি কোনো দেশে রপ্তানি আদেশ দিতে পারে বলে মনে করছেন রপ্তানিকারকরা।

এদিকে গতকাল মন্ত্রিসভা বৈঠকে ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ পরিস্থিতির ঘটনা প্রবাহের দিকে সংশ্লিষ্টদের নজর রাখার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। একইসঙ্গে যুদ্ধের সম্ভাব্য প্রভাব মোকাবিলায় প্রস্তুতি নেয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন।
ওদিকে গত সোমবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটু বলেন, সম্প্রতি ইরান-ইসরাইল হামলার ঘটনায় অস্বস্তিতে আছি। আন্তর্জাতিক ঘটনা প্রবাহের প্রভাব বাজারে পড়বে। এসব চ্যালেঞ্জ যাতে বাজারে না আসে, তা মোকাবিলা করতে হবে। তিনি বলেন, বাজার নিয়ন্ত্রণ এখনো চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়েছে। 

রপ্তানিকারকরা জানান, বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের প্রধান গন্তব্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) দেশগুলোতে পণ্য পৌঁছাতে সুয়েজ খাল ব্যবহার করা হয়। এতে পণ্য পরিবহনে সাশ্রয়ী। বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্য চট্টগ্রাম বন্দর থেকে এ খালের মাধ্যমে লোহিত সাগর দিয়ে ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বন্দরে পৌঁছে। এতে সময় বাঁচে অন্তত ১৫ দিন। এই রুট ব্যবহার করতে না পারলে বিকল্প দক্ষিণ আফ্রিকা হয়ে ইউরোপে যেতে হয়। এতে সময় লাগে অতিরিক্ত ১৫ দিন। এতে পরিবহন ব্যয়ও বাড়ে। 

ইভিন্স গ্রুপের পরিচালক শাহ রাঈদ চৌধুরী বলেন, ইইউ’র দেশগুলোতে পণ্য পৌঁছাতে সুয়েজ খাল ব্যবহার করা হলে এতে অন্তত ১৫ দিন সময় বেঁচে যায়। মধ্যপ্রাচ্যে চরম অস্থিরতার কারণে সাশ্রয়ী এই রুট ব্যবহার করতে না পারলে আটলান্টিক মহাসাগর ব্যবহার করতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক বাণিজ্য ব্যবস্থায় যা বাংলাদেশকে সমস্যায় ফেলবে। তিনি বলেন, ক্রেতারা সময়মতো পণ্য পাওয়ার বিষয়ে সংশয়ে রয়েছে। কোনো কোনো ক্রেতা বিকল্প দেশে রপ্তানি আদেশ দিচ্ছে।

পোশাক রপ্তানিকারকরা বলছেন, যুদ্ধের কারণে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক নতুন বাজার গড়ে তোলার প্রচেষ্টাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ওই অঞ্চলের ১৮টি দেশে রপ্তানি বাড়াতে গত কয়েক বছর ধরে নানা উদ্যোগ নিচ্ছে সরকার এবং তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএ।

আরেক উদ্যোক্তা বলেন, পণ্যবাহী জাহাজে প্রায়ই হামলার ঘটনা ঘটছে। নতুন করে ইরান-ইসরাইল যুদ্ধে তা আরও কঠিন হয়ে পড়লো। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতির জেরে সময়মতো পণ্য হাতে পাওয়া যাবে না- এমন শঙ্কায় রয়েছে ক্রেতারা। বাংলাদেশের সঙ্গে ব্যবসা আছে ইউরোপের- এমন অনেক ক্রেতা তাদের কাছাকাছি দেশ তুরস্কে রপ্তানি আদেশ স্থানান্তর করছে বলে শোনা যাচ্ছে। 
একটি গ্রুপের চেয়ারম্যান মানবজমিনকে বলেন, তেলের দাম ইতিমধ্যেই প্রতি ব্যারেল ১ ডলার বেড়েছে এবং ইরান ও ইসরাইলের মধ্যে সংঘাত অব্যাহত থাকলে তা আরও বাড়তে পারে। ফলে লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর চাপ আরও তীব্র হবে।

পলিসি এক্সচেঞ্জ অব বাংলাদেশের সিইও ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, বৈশ্বিক জ্বালানি বাজার অস্থিতিশীল হলে তা জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি এবং আমদানি বিল বাড়তে পারে। সরকার বেশি দামে জ্বালানি আমদানিতে ব্যর্থ হলে লোডশেডিং ও অর্থনৈতিক ক্ষতি বাড়তে পারে। তিনি বলেন, লোহিত সাগরের নৌপথের পরিবর্তে ইতিমধ্যেই আফ্রিকার মধ্যদিয়ে জাহাজ চলাচল করছে। যদি হরমুজ প্রণালি দিয়ে বাণিজ্য ব্যাহত হয় তাহলে শিপিং সময় এবং খরচ আরও বাড়বে। আফ্রিকান অঞ্চলের মধ্যদিয়ে চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় অতিরিক্ত সময় ব্যয়ের কারণে এ পরিস্থিতি জাহাজগুলোর জন্য সম্ভাব্য সংকট তৈরি করতে পারে। তিনি বলেন, যদি এ সংঘাত এক বছর বা তার বেশি সময় ধরে চলে, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশিরাও তাদের চাকরি হারাতে পারেন।

সিপিডি বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এবং সমুদ্রপথে বাণিজ্য ব্যয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, সংঘাত বাড়লে বৈশ্বিক অর্থনীতি নেতিবাচক পরিণতি ভোগ করবে। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে চাহিদা হ্রাস পেতে পারে, যার সুস্পষ্ট প্রভাব বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানিতে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। সাধারণভাবে, শিপিং খাতে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো আরও গুরুতর হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া জ্বালানি ব্যয় আকাশচুম্বী হতে পারে।

ইসরাইলে ইরানের হামলার পর তেলের দাম: ইরানের বড় পরিসরে তেলের মজুত রয়েছে। ওপেক দেশগুলোর মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম উৎপাদক এটি। আমেরিকান ব্যবসায়িক নিউজ চ্যানেল সিএনবিসি’র মতে, বিশ্ববাজারে ইরানের তেল সরবরাহ করার সক্ষমতায় কোনো বাধা পড়লে তেলের দাম বাড়তে পারে। হরমুজ প্রণালির সম্ভাব্য বন্ধ এ পরিস্থিতিকে আরও গুরুতর করে তুলতে পারে।
আঞ্চলিক যুদ্ধের নতুন করে আশঙ্কা দেখা দিলে তেলের দাম ব্যারেল প্রতি ১০০ ডলার বা তারও বেশি ছাড়াতে পারে।
এদিকে রয়টার্স গত সোমবার তেলের দামে ১ শতাংশ হ্রাসের কথা জানিয়েছ। এটি ইসরাইলে ইরানের ১৪ই এপ্রিলের হামলার পরে একটি বৃহত্তর আঞ্চলিক সংঘাতের আশঙ্কায় বাজার নিম্নমুখী হওয়ার ইঙ্গিত। তবে ২০২৪ সালের মার্চ মাসে ওপেক-এর গড় তেলের মূল্য ৮৪.২২ ডলারে পৌঁছে যা পূর্ববর্তী মাসের তুলনায় ২.৯৯ ডলার বৃদ্ধি বলে জানিয়েছে রয়টার্স।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button