প্যাথলজি পরীক্ষা করছে কারা?
কোমর ব্যথার চিকিৎসা নিতে গিয়ে ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মরতে বসেছিলেন বরগুনা জেলা পরিষদের সাবেক সদস্য পান্না হাওলাদার। তাঁর ভুল চিকিৎসার কারণ ছিল ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরীক্ষার ভুল প্রতিবেদন। পরে ঢাকায় গিয়ে বেশ কয়েকটি হাসপাতালে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে তাঁকে চিকিৎসা নিতে হয়। প্রায় দেড় বছর চিকিৎসা শেষে সুস্থ হয়ে ওঠেন তিনি। এর মধ্যেই তাঁর খরচা হয়ে যায় পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা।
বরগুনার বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর খামখেয়ালিতে পান্না হাওলাদারের মতো ভুল চিকিৎসার গ্যাঁড়াকলে পড়ছেন অনেকে। কেননা, নির্ভুল স্বাস্থ্য পরীক্ষার পূর্বশর্তই হচ্ছে প্যাথলজিস্টের উপস্থিতি। তবে আশ্চর্যজনক হলেও সত্য, এ নিয়ম মানছে না এসব প্রতিষ্ঠান।সিভিল সার্জন অফিসের তথ্য অনুযায়ী, বরগুনার বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকের সংখ্যা ১০৭। এর মধ্যে শুধু জেলা সদরেই আছে ৩৭টি। এ ছাড়া আমতলীতে ১৯টি, বামনায় ১০টি, বেতাগীতে ৮টি, পাথরঘাটায় ২৭টি ও তালতলীতে আছে ৬টি ক্লিনিক।
এসব ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চিকিৎসা-সংক্রান্ত বেশির ভাগ নিয়মকানুনই মানে না। অধিকাংশেরই নেই স্বাস্থ্য বিভাগের অনুমোদন। ১০৭টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকের মধ্যে ৪৬টির ছাড়পত্র বা লাইসেন্স নবায়ন নেই দুই থেকে ছয় বছর। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২৯টি প্রতিষ্ঠান নবায়ন আবেদন করলেও তা এখনও রয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগের তদন্তের অপেক্ষায়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মাত্র একটি প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়ন হয়েছে এবং তদন্তের অপেক্ষায় আছে ২৩টি। ২০২২-২৩ অর্থবছরে চারটি প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স পেলেও তারা নতুন অর্থবছরে নবায়ন আবেদন করেনি। অন্যদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে দুটি নতুন আবেদন ও দুটি অসম্পূর্ণ আবেদন রয়েছে।
একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিক পরিচালনার ক্ষেত্রে হালনাগাদ ট্রেড লাইসেন্স, টিআইএন/আয়কর প্রত্যয়নপত্র, ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন নম্বর, পরিবেশ ছাড়পত্র, নারকোটিক পারমিট, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চুক্তিপত্রসহ বেশ কিছু কাগজপত্র ও অবকাঠামোগত বিষয় থাকতে হয়। আর এসব না থাকার কারণে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়ন হচ্ছে না বলে জানান স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা। তবে দু-একটি ছাড়া সব প্রতিষ্ঠানেই দিব্যি চলছে চিকিৎসা কার্যক্রম।
প্যাথলজিস্ট ছাড়াই পরীক্ষা
ডায়াগনস্টিক সেন্টারে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক (প্যাথলজিস্ট), একজন রিপোর্ট প্রদানকারী, মেডিকেল টেকনোলজিস্ট থাকা বাধ্যতামূলক। তবে ক্লিনিকের ক্ষেত্রে এর বাইরে সার্বক্ষণিক ডাক্তার, নার্সসহ বেশ কিছু যন্ত্রপাতি থাকার কথা। বরগুনার ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকে এসব নিয়মের কিছুই মানা হয় না।
ক্লিনিকগুলো ঘুরে জানা গেছে, ১০৭ ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকের কোথাও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক (প্যাথলজিস্ট) নেই। নামেমাত্র একজন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট সব গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রতিবেদন দিচ্ছেন। হাতেগোনা দু-একটি প্রতিষ্ঠান তাদের প্রতিবেদনে মেডিকেল টেকনোলজিস্টের পাশাপাশি একজন মেডিকেল অফিসারের কাউন্টার সই রাখে। অনেকের ক্ষেত্রে মেডিকেল অফিসারের সেই সইও জাল ব্যবহার করা হচ্ছে।
বরগুনা শহরের শেরেবাংলা সড়কের শরীফ এক্স-রে অ্যান্ড প্যাথলজিসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে এমন চিত্র ধরা পড়ে। আলিফ নামে এক রোগীর পরীক্ষা প্রতিবেদনে দেখা যায়, অবসরপ্রাপ্ত এমবিবিএস চিকিৎসক আবুল হাশেম খানের নামসর্বস্ব সই। ওই প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের কাছে সই ব্যবহারকারী চিকিৎসকের অবস্থান জানতে চাওয়া হলে আবদুল জলিল নামের এক কর্মকর্তা জানান, তিনি (ডাক্তার) এসে সই করে চলে যান। পরে ওই প্রতিষ্ঠানে একাধিকবার গিয়েও সই দেওয়া চিকিৎসক আবুল হাশেমকে পাওয়া যায়নি। পরে জানা যায়, ওই চিকিৎসক বয়সের কারণে বেশির ভাগ সময় বাসায় থাকেন।
এর বাইরে দু-একটি প্রতিষ্ঠান পরীক্ষার প্রতিবেদনে চিকিৎসকের প্রতিস্বাক্ষর ব্যবহার করলেও বাকিরা সবাই মেডিকেল টেকনোলজিস্ট দিয়ে রিপোর্ট দিচ্ছেন। এসব কারণে প্রতিনিয়ত রোগীরা পরীক্ষার ভুল প্রতিবেদনের পাশাপাশি নানাভাবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। তবে এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য বিভাগ কিংবা প্রশাসনের উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ নেই।
বরগুনা শহরের চরকলোনি এলাকার সুমাইয়া ওমি জানান, গত ১ জুন শহরের শরীফ এক্স-রে অ্যান্ড প্যাথলজি সেন্টারে গিয়ে প্রেগন্যান্সি পরীক্ষা করালে সেখানে পজিটিভ আসে। এর ১৫ থেকে ২০ দিন পর চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী অন্য একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে আলট্রাসনোগ্রাফি করলে সে প্রতিবেদনে প্রেগন্যান্সির কোনো আলামত ছিল না। সুমাইয়া বলেন, এ ধরনের ভুল প্রতিবেদন আমরা কখনোই প্রত্যাশা করি না। কারণ, প্রেগন্যান্সি না হওয়ার পরও যদি পজিটিভ আসতে পারে, তাহলে এদের কাছে প্রেগন্যান্সি হওয়ার পর নেগেটিভও আসতে পারে। সে ক্ষেত্রে ভুল প্রতিবেদনের জন্য একটি জীবন চলে যেতে পারে। এ ব্যাপারে শরীফ এক্স-রে অ্যান্ড প্যাথলজি সেন্টারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও বরগুনা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের সিনিয়র মেডিকেল টেকনোলজিস্ট সুভাষ দত্ত বলেন, অনেক সময় প্রেগন্যান্সি হয়ে রক্তের সঙ্গে সেটি নেমে যায়। এ প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে এমনটি হতে পারে।
পাথরঘাটার কালমেঘা ইউনিয়নের আমরাতলা গ্রামের স্কুলশিক্ষক মো. আল-আমীন তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর রক্তের গ্রুপসহ কয়েকটি পরীক্ষার জন্য তাঁকে নুর ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যান। সেখানে পরীক্ষার পর জানানো হয়, তাঁর স্ত্রীর রক্তের গ্রুপ ‘বি পজিটিভ’। সন্দেহ হলে তিনি আরও দুটি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে ফের পরীক্ষা করান। সেখানে রক্তের গ্রুপ ‘ও পজিটিভ’ পাওয়া যায়। ওই শিক্ষক বলেন, ‘আমি অন্য জায়গায় পরীক্ষা না করিয়ে বি পজিটিভ রক্ত আমার স্ত্রীর শরীরে প্রবেশ করালে বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যেত।’
এ ব্যাপারে নুর ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পরিচালক মো. জামাল হোসেন বলেন, ‘মেডিকেল টেকনোলজিস্ট রুবেল ভুলটি করেছিল। তবে এ ধরনের ভুল ধরা পড়ার পর তাঁকে প্রতিষ্ঠানে আর রাখা হয়নি। ল্যাবে পরীক্ষার সময় ভুলে অন্যের রক্ত দিয়ে পরীক্ষা হতে পারে কিংবা কম্পিউটারেও ভুল হতে পারে।’
মো. রাসেল মাহমুদ নামের এক রোগী রক্তে কোলেস্টেরল পরীক্ষার জন্য শহরের শরীফ এক্স-রে অ্যান্ড প্যাথলজিতে যান। সেখানকার পরীক্ষার রিপোর্ট পেয়ে সন্দেহ হলে তিনি একই দিন শহরের মিনতি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও নিউ গ্রিন লাইফ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে আবার একই পরীক্ষা করান। তিনটি প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টে তিন ধরনের ফল আসে! পরে তিনি কোন প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট আমলে নিয়ে চিকিৎসাসেবা নেবেন, তা বুঝতে পারছিলেন না। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে শরীফ এক্স-রে অ্যান্ড প্যাথলজির স্বত্বাধিকারী সুভাষ দত্ত দাবি করেন, আমার প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষার রিপোর্ট ঠিক আছে। তবে অন্য প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষার রি-এজেন্ট ঠিক না থাকার কারণে এমন হতে পারে। সরেজমিনে পাথরঘাটার বিসমিল্লাহ্ ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে দেখা যায়, রুবেল মিয়া নামের এক রোগীর এক্স-রে রিপোর্টে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) অধ্যাপক জুবেরুল ইসলাম চৌধুরী নামে এক চিকিৎসকের সই। ওই চিকিৎসকের অবস্থান জানতে চাওয়া হলে প্রতিষ্ঠানের পরিচালক হারুন অর রশীদ জানান, তিনি (চিকিৎসক) ঢাকায় অবস্থান করেন এবং কম্পিউটারের মাধ্যমে এক্স-রে দেখে রিপোর্টে সই করেন।
চলে অভিযানও
জেলা সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি অভিযান চালিয়ে ল্যাবের আয়তন এবং প্রয়োজনীয় পরিবেশ না থাকা, পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি, চিকিৎসক ও জনবল না থাকার অভিযোগে পাথরঘাটার ১৮টি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে শর্তসাপেক্ষে ১৩টি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম চালানোর অনুমতি দেওয়া হলেও এখনও বন্ধ পাঁচটি। অন্যদিকে তালতলীর সাতটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে পাঁচটির কার্যক্রম বন্ধ ঘোষণা করা হলেও পরে শর্তসাপেক্ষে সেগুলো পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয়।
কারা কী বলছেন
ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর স্বাস্থ্য পরীক্ষার মান নিয়ে জানতে চাইলে বরগুনা জেনারেল হাসপাতালের মেডিকেল অফিসার ডা. মো. মেহেদী হাসান বলেন, ‘কোনো প্যাথলজি কিংবা ডায়াগনস্টিক সেন্টার রোগীকে পরীক্ষার ভুল বা অনুমাননির্ভর রিপোর্ট দিলে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হয়। কারণ, পরীক্ষা-নিরীক্ষার রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসকরা রোগীকে ব্যবস্থাপত্র দেন। সেখানে ভুল হলে রোগীরা সুস্থতার বদলে মৃত্যুঝুঁকিতে পড়েন। তাই এ ব্যাপারে সচেতন থাকা জরুরি।’ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যাথলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বিষ্ণুপদ দে বলেন, মেডিকেল কিংবা ল্যাব বিজ্ঞানে রোগনির্ণয়পত্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। সঠিক রোগ নির্ণয় করা গেলে একজন রোগী হাসপাতাল বা বাড়ি যে কোনো জায়গায় চিকিৎসা নিতে পারেন। তবে রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ভুল হলে রোগীর মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে। তিনি আরও বলেন, সঠিক রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোকে নিয়মিত তদারকির আওতায় আনা জরুরি। তাঁর দাবি, সারাদেশে চিকিৎসক সংকট আছে সেটা ঠিক; তবে একটি জেলায় একজনও প্যাথলজিস্ট থাকবে না, এটা হয় না।
এ ব্যাপারে বরগুনার সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ফজলুল হক বলেন, ‘সব নিয়মনীতি বাস্তবায়ন করতে চাইলে বরগুনার একটি ডায়াগনস্টিক সেন্টার কিংবা ক্লিনিকও চলবে না। তাই আমরা চেষ্টা করছি এগুলোকে যথাসম্ভব নিয়মের মধ্যে রাখতে।’ এ বিষয়ে বরগুনা জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘জেলা উন্নয়ন সভায় বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ক্লিনিকের বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কোনটা কোন অবস্থায় আছে, সে বিষয়ে আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি। এরপর তাদের সতর্ক করা হবে। যদি সংশোধন না হয়, তাহলে স্বাস্থ্য বিভাগের সমন্বয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।’