Hot

প্রধানমন্ত্রীর চীন সফরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি পশ্চিমাদের, গুরুত্ব পাবে আর্থিক সহায়তা ও নতুন প্রকল্পে অর্থায়ন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার দিনের সফরে আগামীকাল সোমবার চীন যাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর এ সফরের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখছে পশ্চিমা বলয়ের দেশগুলো। কারণ, বাংলাদেশের এই সফর দিয়ে এ অঞ্চলে বেইজিংয়ের ভবিষ্যৎ কৌশল কী হবে, তার একটি ধারণা পাওয়া যাবে। ঢাকার পশ্চিমা বলয়ের দূতাবাসের কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনায় এ তথ্য জানা গেছে।

আগামীকাল সকালে ঢাকা থেকে বেইজিংয়ের উদ্দেশে রওনা হবেন প্রধানমন্ত্রী। পরদিন তিনি বেইজিংয়ে বিজনেস ফোরামে যোগ দিয়ে বক্তব্য দেবেন। আগামী বুধবার চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াংয়ের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে বসবেন বঙ্গবন্ধুকন্যা। বৈঠকে আর্থিক সহায়তা এবং নতুন প্রকল্পে অর্থায়নের মতো বিষয়গুলো গুরুত্ব পাবে। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে আলোচনা করবেন। প্রধানমন্ত্রীর বেইজিং সফরের সময় দেশটির সঙ্গে বেশ কয়েকটি দলিল সইয়ের কথা রয়েছে। এ ছাড়া বঙ্গবন্ধুর বই ‘আমার দেখা নয়াচীন’-এর চায়নিজ ভাষায় অনুবাদের মোড়ক উন্মোচন করবেন তিনি। 

ইতোমধ্যে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) বা এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের (এআইআইবি) মতো চীনের বেশ কিছু বৈশ্বিক রাজনৈতিক কার্যক্রমে অংশীদার হয়েছে বাংলাদেশ। চীন এরই মধ্যে জানান দিয়েছে, আসন্ন সফরে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, রাজনৈতিক-পারস্পরিক বিশ্বাসকে দৃঢ় করা, উন্নয়ন কৌশলগুলো এগিয়ে নিতে আরও গুছিয়ে কাজ করা, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভকে এগিয়ে নেওয়া, বৈশ্বিক উন্নয়ন উদ্যোগ (জিডিআই), বৈশ্বিক নিরাপত্তা উদ্যোগ (জিএসআই), বৈশ্বিক সভ্যতা উদ্যোগের (জিসিআই) দ্রুত বাস্তবায়নের মাধ্যমে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া তাদের অগ্রাধিকার। এর পাশাপাশি ঢাকা-বেইজিং রাজনৈতিক-পারস্পরিক বিশ্বাসকে সুসংহত করার মাধ্যমে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও উইন উইন সহযোগিতামূলক সম্পর্ক তৈরির মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চায় চীন। গত বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমকে এ তথ্য জানিয়েছেন ঢাকায় চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন।

এর সঙ্গে চীনের রাষ্ট্রদূত ও দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং সাম্প্রতিক সময়ে চীনের প্রেসিডেন্টের পাঁচ নীতির কথা তুলে ধরে এ চেতনার ওপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। ফলে পুরো বিষয়টি আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ, চীনের প্রেসিডেন্ট কিছুদিন আগে ৭০তম সম্মেলনে এক বক্তৃতায় দক্ষিণের দেশগুলোর মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানো ও অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে পাঁচ নীতির ওপর জোর দেন।

পশ্চিমা দেশের এক রাষ্ট্রদূত নাম না প্রকাশের শর্তে সমকালকে বলেন, তৃতীয় দেশ নিয়ে আমরা কোনো মন্তব্য করতে পারি না। তবে স্বাগতিক দেশ আসলে কোন দিকে যাচ্ছে বা কী করছে, তা বোঝা আমাদের নিজস্ব স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

সম্প্রতি রাশিয়ার অর্থনীতির উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, রাশিয়ার যুদ্ধকালীন অর্থনীতি ফুলেফেঁপে ওঠার কারণ হচ্ছে তারা মধ্যপ্রাচ্য ও গ্লোবাল সাউথের বিকল্প বাজারকে নিয়মিত করে তুলেছে। পশ্চিমা বলয়ের সব উচ্চ আয়ের দেশ তাদের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিলেও দেশটির তেল, অস্ত্রসহ অন্যান্য পণ্য ক্রয় করে চীন, ভারত, পাকিস্তান, ইরানসহ দক্ষিণ ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো রাশিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছে। এভাবে এই অঞ্চলের বাকি মিত্র দেশগুলো এ বলয়ের মধ্যে চলে এলে আমাদের নিজস্ব অর্থনীতি ও কৌশল নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে।

প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে হামলা চালানোর পর থেকে সোয়া দুই বছরে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কাটিয়ে নিজেদের অর্থনীতি আবার চাঙ্গা করে তুলেছে রাশিয়া। দেশটির যুদ্ধকালীন অর্থনীতি এতটাই ভালো অবস্থানে যে, বিশ্বব্যাংক রাশিয়াকে ‘উচ্চ আয়ের দেশ’-এ উন্নীত করেছে। এর আগে ২০১৪ সালে সর্বশেষ রাশিয়া উচ্চ আয়ের দেশ ছিল।

ফলে এসব মিলিয়ে প্রধানমন্ত্রীর আসন্ন সফরে কী হতে যাচ্ছে, তা নিয়ে প্রবল আগ্রহ রয়েছে পশ্চিমা দেশগুলোর। তারা ইতোমধ্যে চুলচেরা বিশ্লেষণ শুরু করেছে চীন, বাংলাদেশ ও এ অঞ্চল নিয়ে পরবর্তী কী পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে, মূলত কীভাবে চীন তার প্রভাব বিস্তার করছে। ফলে প্রধানমন্ত্রীর সফরটিতে কী হতে যাচ্ছে, তা জানতে বেশ কয়েকটি দেশের কূটনীতিকরা নিজ নিজ পর্যালোচনা করার পাশাপাশি বিষয়গুলোতে ওয়াকিবহালদের সঙ্গে বৈঠকও করছেন।

এমনকি প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে চীন সফর নিয়েও আলোচনা হয়েছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
কূটনীতিকদের মতে, প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর থেকে ভারতের অগ্রাধিকারের একটি চিত্র পাওয়া গেছে। চীনের সফরে কী ধরনের চুক্তি হচ্ছে বা কী কী ঘোষণা আসছে, তা থেকে চীনের এ অঞ্চলের অগ্রাধিকারের একটি চিত্র পাওয়া যাবে।

পশ্চিমা দেশের কূটনীতিক নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, চীনকে বোঝা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, দেশটির উত্থান-পতনের সঙ্গে আমাদের নিজ দেশের অর্থনীতির পাশাপাশি বৈশ্বিক অর্থনীতি জড়িত। আর বাংলাদেশ ভূরাজনৈতিক দিক থেকে যেহেতু কৌশলগত অবস্থানে রয়েছে, ফলে এখানে চীন নতুন কী করতে যাচ্ছে, তা থেকে পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে– তার একটি ধারণা পাওয়া যাবে।

চীন ও বাংলাদেশের ঐকমত্যের পাঁচ নীতি নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশের শর্তে বলেন, বাংলাদেশ ও চীনের সম্পর্ক কিছু মৌলিক নীতির ওপর ভিত্তি করে এগিয়ে যাচ্ছে। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, নিজ জাতীয় পরিস্থিতি বিবেচনায় উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে একে অপরকে সম্মান ও সহযোগিতা করা, সেই সঙ্গে একে অপরের মূল স্বার্থের জায়গাকে সম্মান করা ও সহযোগিতা করা। সর্বশেষ একে অপরের প্রধান উদ্বেগের জায়গাগুলো সম্মান করার পাশাপাশি বিষয়গুলোতে সহযোগিতা করা। এ বিষয়গুলোতে ঢাকা যেমন বেইজিংয়ের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, তেমনি বেইজিংও ঢাকার কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। অর্থাৎ চীনের গুরুত্বপূর্ণ স্বার্থ ও উদ্বেগের জায়গাগুলো উপেক্ষা করে বাংলাদেশ কিছু করবে না। তেমনি চীনও বাংলাদেশের স্বার্থ ও উদ্বেগের জায়গাগুলো উপেক্ষা করে কিছু করবে না।

প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরের মধ্য দিয়ে এ সম্পর্ক আরও এক ধাপ এগিয়ে নিতে আগ্রহী দুই দেশ। দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠকে স্বাগতিক দেশের পক্ষ থেকে যৌথ বিবৃতিসহ সংশ্লিষ্ট নানা সরকারি দলিলের খসড়া তৈরি করা হয়। এবারের সফরে চীন যে খসড়া যৌথ বিবৃতি তৈরি করেছে, তাতে সম্পর্কের আরও উন্নতি হিসেবে ‘নিবিড় কৌশলগত সহযোগিতামূলক অংশীদারিত্বের’ প্রস্তাব দিয়েছে বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে। বেইজিং চায়, ঢাকা জিডিআইতে যুক্ত হোক। ঢাকা চায়, পায়রাকে ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলের উন্নয়নে অংশীদার হোক চীন। ২০২৫ সালে বাংলাদেশ ও চীনের কূটনৈতিক সম্পর্কের ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে বছরব্যাপী রাজনৈতিক যোগাযোগ বৃদ্ধি ও দুই দেশের জনগণের মধ্যে যোগাযোগের মতো পরিকল্পনাগুলো করা হবে এ সফরে।

এ ছাড়া রিজার্ভ, বাজেট, বাণিজ্য ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ঋণ সহায়তারও আশা করছে ঢাকা। শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকে দুই দেশের মধ্যে সমুদ্রকেন্দ্রিক সহযোগিতা বৃদ্ধি, বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্রহ্মপুত্র নদের তথ্য-উপাত্ত সরবরাহ, বিআরআই এগিয়ে নিতে দিকনির্দেশনা, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ), বাণিজ্য ও বিনিয়োগ, শিক্ষা, জলবায়ু, পরিবর্তন, ডিজিটাল এবং স্বাস্থ্য সহযোগিতার মতো বিষয় আলোচনায় আসতে পারে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button