Bangladesh

প্রধান উপদেষ্টাকে মার্চে বেইজিং সফরে নিতে আগ্রহী চীন

  • দ্বিপক্ষীয় সফরে আজ চীন যাচ্ছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা।
  • ভবিষ্যৎ সহযোগিতায় গুরুত্ব পেতে পারে স্বাস্থ্য খাত।
  • তিস্তায় আগ্রহী চীন, ঢাকার সাড়া পেলে এগোবে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে বাংলাদেশে ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দুই দেশের সম্পর্ক গভীর করতে মনোযোগ দিচ্ছে চীন। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে প্রথম দ্বিপক্ষীয় বৈঠক আয়োজনের ধারাবাহিকতায় সর্বোচ্চ স্তরের সফরে আগ্রহী বেইজিং। তাই দুই দেশের সম্পর্কের পাঁচ দশক পূর্তিতে আগামী মার্চে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে বেইজিং সফরে নিতে চায় চীন।

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, আগামী ২৭ ও ২৮ মার্চ বেইজিংয়ে অনুষ্ঠেয় বাও ফোরাম ফর এশিয়ার (বিএফএ) সম্মেলনে যোগ দিতে ইতিমধ্যে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে চীন। এশিয়াসহ বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু নিয়ে বেসরকারি ও অলাভজনক সংস্থার এই ফোরামে বিভিন্ন দেশের নেতা, শিল্পোদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী নেতা ও শিক্ষাবিদেরা অংশ নিয়ে থাকেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারের উচ্চপর্যায়ের একটি সূত্র রোববার সন্ধ্যায় এই প্রতিবেদককে বলেন, বিএফএ সম্মেলনে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি বেইজিং সফরের সময় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় শীর্ষ বৈঠক আয়োজন করতে আগ্রহী চীন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন আজ সোমবার দুপুরে দ্বিপক্ষীয় সফরে চীন যাচ্ছেন। আগামীকাল মঙ্গলবার বেইজিংয়ে তিনি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়াও ওয়েনের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করবেন।

সেখানে ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কের সুবর্ণজয়ন্তীতে সহযোগিতা কীভাবে এগোবে, তা গুরুত্ব পাবে। দুই দেশের সহযোগিতার ক্ষেত্রে সামনের দিনগুলোতে স্বাস্থ্য খাত গুরুত্ব পেতে পারে। বিশেষ করে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতো চীনের সহায়তায় মৈত্রী হাসপাতাল স্থাপন, বাংলাদেশের রোগীদের জন্য কুনমিংসহ একাধিক প্রদেশে বাংলাদেশের রোগীদের জন্য স্বল্প মূল্যে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করা এবং ঢাকায় আহত ব্যক্তিদের সেবা ও পুনর্বাসনে বিশেষ প্রকল্পের বিষয়ে একাধিক সমঝোতা স্মারকের বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।

ভাড়া করা উড়োজাহাজ পাঠাতে চায় চীন

আগামী ২৫ থেকে ২৮ মার্চ বেইজিংয়ে ২৫ দেশের জোট বিএফএর সম্মেলনে যোগ দিতে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। চীন ওই ফোরামের বৈঠকে যোগ দেওয়ার ফাঁকে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংসহ দেশটির রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে বাংলাদেশের শীর্ষ নেতার আলোচনা আয়োজন করতে আগ্রহী।

তবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক কর্মকর্তা মনে করেন, মার্চে এই সফর হওয়ার বিষয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে। কারণ, ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের কারণে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। তা ছাড়া পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বৈঠকের দুই মাসের মাথায় শীর্ষ বৈঠক আয়োজনের জন্য যথেষ্ট কি না, সেটিও বিবেচনার বিষয়। পাশাপাশি বিগত সরকারের একপেশে নীতির কারণে হুটহাট কোনো দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার পরিবর্তে ধীরেসুস্থে এগোনো সমীচীন বলে কূটনীতিকদের মত।

দুই দেশের সম্পর্কের পাঁচ দশক পূর্তি সামনে রেখে সহযোগিতা এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হবে। আমাদের অগ্রাধিকার থাকবে অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন সহযোগিতায়।

মো. তৌহিদ হোসেন, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

কূটনৈতিক একটি সূত্র জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূসকে বেইজিং সফরে নিতে চীনের পক্ষ থেকে ভাড়া করা উড়োজাহাজ পাঠানোর বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়েছে। পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বেইজিং সফরের সময় প্রধান উপদেষ্টার চীন সফরের বিষয়টি আলোচনায় আসতে পারে।

আলোচনায় ঢাকায় বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী হাসপাতাল

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, আগামীকাল বেইজিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে সহযোগিতার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য খাতকে গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে। বিশেষ করে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনে চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহায়তায় একটি বিশেষায়িত চিকিৎসা ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণে বেইজিংকে সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রস্তাব দিয়েছে ঢাকা। রাজধানীর পূর্বাচলে চীনের অর্থায়নে প্রথম মৈত্রী হাসপাতাল নির্মাণে বাংলাদেশ দ্রুত সমঝোতা স্মারক সই করতে আগ্রহী। বাংলাদেশ চায় চীনের দক্ষ চিকিৎসকসহ পেশাজীবীদের মাধ্যমে ওই হাসপাতাল পরিচালিত হবে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশের রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে কুনমিং ও আশপাশের এলাকার উন্নত মানের হাসপাতালে নির্দিষ্ট করে দিতে চীনের সহযোগিতা চায় বাংলাদেশ।

জানতে চাইলে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন গতকাল রোববার সকালে বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশকে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে নীতিগতভাবে রাজি আছি। আমরা এখন বাংলাদেশের কাছে বিস্তারিত প্রস্তাবের অপেক্ষায় রয়েছি। বাংলাদেশের কোথায় এই হাসপাতাল হবে, কেমন ধরনের হাসপাতাল বাংলাদেশ চাইছে, সেটা আমরা জানতে চাই। বাংলাদেশের প্রস্তাব পাওয়ার পর আমরা প্রক্রিয়া অনুযায়ী এগোব। আমরা বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের আধুনিকায়নে আগ্রহী।’

তিস্তায় এখনো আগ্রহী চীন

পররাষ্ট্র উপদেষ্টার আসন্ন সফরে দুই দেশের মধ্যে ২০১৬ সালে সই হওয়া নদীর পানির টেকসই ব্যবস্থাপনা নিয়ে সমঝোতা স্মারক নবায়ন করার কথা রয়েছে। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ও পাওয়ার চায়নার মধ্যে সই হওয়া ওই সমঝোতাকে একটি রূপরেখা সমঝোতা স্মারক বিবেচনা করা হয়। এই সমঝোতা স্মারকের ধারাবাহিকতায় তিস্তা প্রকল্প নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা হচ্ছে।

তিস্তা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ইয়াও ওয়েন বলেন, ‘আমরা এই প্রকল্পে বাংলাদেশকে সহায়তা করতে আগ্রহী। এখন বাংলাদেশকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে কীভাবে এটি বাস্তবায়নের পথে যাবে।’

কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, বেইজিংয়ের বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ব্রহ্মপুত্র নদের উজান অংশে চীনের মেগা বাঁধ নির্মাণ নিয়ে আলোচনা হবে। তিব্বতে প্রায় ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রায় ১০০ বিলিয়ন ডলারের বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে দেশটি। এর ফলে ভাটির দেশগুলোর পানির প্রাপ্যতা নিয়ে তৈরি হয়েছে সংশয়। ইতিমধ্যে ভারত এ বাঁধ নির্মাণ নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। বিষয়টি পররাষ্ট্র উপদেষ্টার বৈঠকে আলোচনায় থাকবে।

গতকাল সকালে উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন চীনের রাষ্ট্রদূত। পরে তিব্বতের বাঁধ নির্মাণ নিয়ে জানতে চাইলে চীনের রাষ্ট্রদূত বলেন, এ বাঁধ নির্মাণের ফলে ভাটির দেশগুলোর ওপর কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না।

সুদের হার হ্রাসে মনোযোগ বাংলাদেশের

পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিনিয়োগ, বাণিজ্য ও প্রকল্প অর্থায়নের গুরুত্ব দেওয়া হবে। সুদের হার ২ শতাংশ থেকে কমিয়ে যৌক্তিক পর্যায়ে আনার পাশাপাশি ঋণের প্রতিশ্রুতি ফি দশমিক ৫ শতাংশ বাতিল চাইবে ঢাকা। এ ছাড়া আগের সমঝোতা অনুযায়ী চারটি জাহাজ সংগ্রহসহ বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে, বিশেষ করে যে প্রকল্পগুলোতে বর্তমানে অর্থায়ন বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীনের সহযোগিতা চাইবে ঢাকা।

জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিলে রোহিঙ্গাদের পক্ষে থাকার আহ্বান জানানো হবে চীনকে। সেই সঙ্গে চীন থেকে আরও বিনিয়োগ প্রত্যাশা করে বাংলাদেশ। ৫ আগস্টের পর চীন ২০ কোটি ডলারের ওপর বিনিয়োগ নিয়ে এগিয়ে এসেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশের অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদার দেশটি। বিলম্বিত অর্থ প্রদানসহ পণ্য ও এর কাঁচামালের অবাধ বাণিজ্যে সহযোগিতা চাইবে ঢাকা। সেই সঙ্গে স্বল্প আয়ের দেশ থেকে উত্তরণের পর অতিরিক্ত আরও তিন বছর চীনের বাজারে বাংলাদেশি পণ্যের শুল্ক ও কোটামুক্ত সুবিধা চাইবে বাংলাদেশ।

চীন সফর নিয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, ‘দুই দেশের সম্পর্কের পাঁচ দশক পূর্তি সামনে রেখে সহযোগিতা এগিয়ে নেওয়ার বিষয়ে আলোচনা হবে। আমাদের অগ্রাধিকার থাকবে অর্থনৈতিক ও উন্নয়ন সহযোগিতায়।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button