প্রভাবশালী নেতারাও ছাড় পাচ্ছেন না

জুলাই আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক মাহিন সরকারকে এনসিপি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে সোমবার তার বিরুদ্ধে এ ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এই বহিষ্কারাদেশ ঘিরে বিতর্ক শুরু হয়েছে। এদিকে দলীয় শৃঙ্খলা রক্ষা এবং জবাবদিহি নিশ্চিতে কঠোর অবস্থানের জানান দিচ্ছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। এক্ষেত্রে দলে প্রভাবশালী হিসাবে পরিচিত হলেও কোনো নেতাকে ছাড় দেওয়া হচ্ছে না। নানা অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এর আগে একাধিক কেন্দ্রীয় নেতাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দেওয়া হয়েছে।
দল থেকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে জানতে চাইলে মাহিন সরকার মঙ্গলবার রাতে যুগান্তরকে জানান, কোনো ধরনের নোটিশ ছাড়া এ ধরনের বহিষ্কারাদেশ দিয়ে তার সঙ্গে একধরনের বিমাতাসুলভ আচরণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, মূল দলে যুক্ত থেকেও আমি যদি এনসিপির প্যানেল থেকে ডাকসু নির্বাচনে অংশ নিতাম, তাহলে হয়তো বহিষ্কার হতাম না। কিন্তু যখন আমি স্বতন্ত্র প্যানেল দিয়েছি, তখনই আমাকে বহিষ্কার করা হলো। দলের এমন একতরফা সিদ্ধান্ত অবশ্যই গণতান্ত্রিক হয়নি।
দলের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা এবং জুলাই আন্দোলনের শীর্ষ সংগঠক মাহিন সরকারের বহিষ্কারাদেশ নিয়ে রাজনীতির মাঠে নানা কথা শোনা যাচ্ছে। যথারীতি এর পেছনে কোন্দল এবং দলে ভাঙনের গল্প প্রচার করা হচ্ছে। অবশ্য এনসিপির পক্ষ থেকে পরিষ্কার করে বলা হয়েছে-মাহিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ দলীয় শৃঙ্খলাভঙ্গের।
সূত্র বলছে, মাহিন সরকার মূল দলের হয়ে সিরাজগঞ্জ এলাকায় দায়িত্বপ্রাপ্ত। সেখানে তিনি নেতাকর্মীদের সংগঠিত করেছেন। কিন্তু কাউকে কিছু না জানিয়ে আকস্মিক তিনি ডাকসু নির্বাচনের জন্য তৎপর হন। তার এসব কর্মকাণ্ড নিয়ে দলের অভ্যন্তরে একধরনের মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। বিষয়টি দলীয় ফোরামে দীর্ঘ আলোচনার পর তাকে সাময়িকভাবে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
মাহিনের বিষয়ে এনসিপির একাধিক নেতার প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয়। কিন্তু নেতাদের কেউ এ বিষয়ে নাম প্রকাশ করে কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি। দলের এক সিনিয়র যুগ্ম-আহ্বায়ক বলেন, একই বয়সের অনেক তরুণ একসঙ্গে রাজনীতির মাঠে হাঁটছে। আবু বাকের, নাহিদ ইসলাম, হাসনাত আবদুল্লাহ এবং সারজিস আলম-তাদের সবাই প্রায় একই বয়সের। কিন্তু যখন কেউ দলীয় কাঠামোর মধ্যে থাকে, তখন ব্যক্তিগত ইচ্ছাকে ছাড় দিতে হয়। তখন দলীয় সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। মাহিনের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। মূল দলে সক্রিয় থাকার পরও শুধু ব্যক্তিগত ইচ্ছায় ডাকসু নির্বাচন করতে গিয়ে মাহিন দল থেকে বহিষ্কার হয়েছেন। এটি দলের অন্যদের জন্য একটি বিশেষ ধরনের বর্তা দেবে।
অপর এক নেতা বলেন, হয়তো মাহিনের বহিষ্কারাদেশ কিছুদিনের মধ্যেই প্রত্যহার হয়ে যাবে। কারণ, ইতোমধ্যে দলের যেসব নেতাকে শোকজ করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে অন্তত ৬ জনের শোকজ প্রত্যাহার করা হয়েছে। শুধু যুগ্ম সদস্য সচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরের বহিষ্কারেদশ এখনো প্রত্যাহার হয়নি। তার বিরুদ্ধে দলীয় শৃঙ্খলা কমিটি তদন্ত অব্যাহত রেখেছে।
এনসিপির কয়েকজন নেতা যুগান্তরকে বলেন, গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগকে বিদায়ের পর দেশ গড়তে এনসিপির জন্ম। এ গুরুদায়িত্ব পালন করতে গিয়ে পদে পদে বাধা আসবে। এমনকি বিদ্যমান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও অনেকেই আছেন যারা মনেপ্রাণে চান এনসিপি ভেঙে যাক। এছাড়া পতিত ফ্যাসিস্টের দোসররাও বসে নেই। তবে এসবকে পিছু হটিয়ে এনসিপি সামনের দিনগুলোয় আরও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এগিয়ে যাবে। কারণ, জুলাই যোদ্ধাদের বেশির ভাগই এনসিপির ব্যানারে নতুন করে সংগঠিত হয়েছেন। এছাড়া জুলাইয়ে উত্তাল দিনগুলোয় যারা রাজপথে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছেন, সেসব শহীদের পরিবারগুলোর কাছে এনসিপি দেশগড়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে রেখেছে, সেখান থেকে পিছু হটার কোনো সুযোগ নেই। দলটির বিভিন্ন পর্যায়ে নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রথাগত রাজনৈতিক বলয় থেকে বেরিয়ে নতুন ধারার সূচনা করতে চায় এনসিপি। বিশেষ করে অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রচর্চা এবং প্রশ্ন করার সংস্কৃতি চালু রাখতে কঠোর অবস্থানের পক্ষে বেশির ভাগ নেতা। এক্ষেত্রে প্রভাবশালী হলেও অভিযুক্ত কাউকে কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না। এছাড়া যে কোনো মূল্যে সবাইকে দলীয় শৃঙ্খলা মেনে চলার বার্তা দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে পিছপা হয়নি দলীয় হাইকমান্ড। ইতোমধ্যে চাঁদাবাজি এবং মব সন্ত্রাসে জড়িত থাকার অভিযোগে বেশ কয়েকজনকে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দেওয়া হয়েছে। এছাড়া তদবির বাণিজ্যের অভিযোগে দলের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা গাজী সালাউদ্দিন তানভীরকে সাময়িক অব্যাহতি দেওয়া হয়। তবে আগস্টে কক্সবাজার ভ্রমণে যাওয়ায় দলের চার শীর্ষ নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম, তাসনিম জারা ও নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীকে শোকজ করা হলে বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়। এ নিয়ে দলের ভেতরেও ভাঙনের গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কেন্দ্রীয় নেতা যুগান্তরকে বলেন, কক্সবাজার সফর নিয়ে কেন্দ্রীয় চার নেতাকে শোকজের ঘটনায় অনেকে রীতিমতো নড়েচড়ে বসেছিলেন। এ সময় দলীয় অন্তর্কোন্দলের গুজব ছড়িয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবে এর ভেতর দিয়ে দলের অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রচর্চার নজির স্থাপিত হয়। সংশ্লিষ্টরা যথানিয়মে তাদের অবস্থান তুলে ধরে শোকজের জবাব দাখিল করেন। পরে তাদের যুক্তি মেনে নিয়ে শোকজ প্রত্যাহার করা হয়েছে। বর্তমানে চার নেতা ফের মাঠে সক্রিয় ভূমিকা রাখছেন।