Bangladesh

প্রমাণের আগেই ভুক্তভোগী ও অভিযুক্তের ‘মিডিয়া ট্রায়াল’

বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন শিক্ষাঙ্গনে প্রায়ই ঘটছে যৌন হয়রানির ঘটনা। উচ্চ আদালতের নির্দেশে দেশের ৪৫টি পাবলিক ও ৯৭টি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে যৌন নির্যাতন-সংক্রান্ত অভিযোগ কমিটি রয়েছে। এটি ‘সেল’ নামে পরিচিত। কোনো কোনো সময় ছাত্রী নিপীড়নের অভিযোগ তোলার পরপরই অভিযুক্তের ছবি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগকারী ছাত্রীর নাম-পরিচয়ও জানাজানি হয়ে যাচ্ছে। এরপর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি বুলিংয়ের শিকার হন।

যৌন নির্যাতন-সংক্রান্ত সেলে কাজ করছেন এমন একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী বলছেন, দোষী প্রমাণ হওয়ার আগেই গণমাধ্যমে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করলে একজন ব্যক্তি সামাজিক ও ব্যক্তিগতভাবে ক্ষতির মুখোমুখি হন। তাঁর পরিবার ও স্বজনরাও নানা হেনস্তার শিকার হন। পরে নির্দোষ প্রমাণিত হলেও হারানো মর্যাদা আর পূরণ করা সম্ভব হয় না। এ ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি ‘মিডিয়া ট্রায়ালের’ শিকার যাতে না হন, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকার পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের। ১৫ মার্চ কুমিল্লায় নিজের বাড়িতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকার আত্মহত্যার পর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যৌন নিপীড়নের বিষয়টি নতুনভাবে সামনে আসে। মৃত্যুর আগে ফেসবুকে তিনি লেখেন, মৃত্যুর জন্য দায়ী সহপাঠী রায়হান সিদ্দিকী আম্মান। বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম আম্মানের পক্ষ নিয়ে তাঁর সঙ্গে বাজে আচরণ করেছেন। এরপর ১৯ মার্চ বিকেলে রাজধানীর মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) কার্যালয়ে গিয়ে নিজের জীবনের নিরাপত্তা চান জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আরেক শিক্ষার্থী। পরে সেখানে তিনি সাংবাদিকদের কাছেও নিজ বিভাগের এক শিক্ষক ও বিভাগের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমে ওই ছাত্রী এবং অভিযুক্ত শিক্ষকদের নাম-পরিচয় প্রকাশিত হয়।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়ন ও প্রতিরোধ সেলের আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. লাইসা আহমেদ লিসা বলেন, তিন বছরের মধ্যে দুটি অভিযোগ পেয়েছি। অভিযোগকারী ও অভিযুক্তের গোপনীয়তা রক্ষার একটি গাইডলাইন রয়েছে। সেটি পুরোপুরি মানা হয়। অভিযোগ প্রমাণের আগে দু’পক্ষের কারও নাম-পরিচয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়া যথার্থ নয়। অভিযোগের সত্যতা যাচাইয়ের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। তদন্ত চলার সময়ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলে থাকি।

২০০৯ সালে এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট যৌন হয়রানি প্রতিরোধে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অভিযোগ কমিটি গঠনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তবে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নামমাত্র এই কমিটি থাকলেও তা কার্যকর নয়। ছাত্রীরা অভিযোগ করলেও তা তদন্তে গড়িমসি করা হয়। অনেক সময় অভিযুক্তরা প্রভাবশালী ও ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকার কারণে ঢিলেঢালাভাবে তদন্ত কার্যক্রম চলে। এতে অভিযোগকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরিয়ে কর্মজীবনে ঢুকে পড়েন। সর্বশেষ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ছাত্রী তাঁর বিভাগের দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন তাঁর ভাষ্য, দীর্ঘদিন তাঁর বক্তব্য আমলে নেওয়া হয়নি। অবন্তিকার ঘটনার পর তিনি সাহস করে বিষয়টি আবার সামনে এনেছেন।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নির্যাতন-সংক্রান্ত অভিযোগ কমিটির সভাপতি অধ্যাপক জেবউননেছা বলেন, আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর গত দুই বছরে ১৫টি অভিযোগ এসেছে। অধিকাংশই তাঁর সহপাঠী ও সিনিয়রদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন। একজন ছাত্রকে আজীবনের জন্য বহিষ্কার করা হয়েছে। অনেককে সাময়িক বহিষ্কার ও অর্থদণ্ড দেওয়া হয়। তদন্ত চলাকালে যাতে দু’পক্ষের কারও নাম-পরিচয় প্রকাশ না পায়, এ ক্ষেত্রে সতর্ক থাকি।

জেবউননেছা আরও বলেন, কেউ অভিযোগ দেওয়ার পর বিনা হয়রানিতে বিচার পাবেন– শিক্ষার্থীদের মধ্যে এ ধরনের সচেতনতা জরুরি। সব বিভাগের শিক্ষকও সচেতনতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। জাহাঙ্গীরনগর একমাত্র ক্যাম্পাস, যেখানে যৌন নির্যাতন-সংক্রান্ত অভিযোগ কমিটির আলাদা একটি কার্যালয় রয়েছে। সর্বক্ষেত্রে যৌন নিপীড়ন প্রতিরোধে সোচ্চার হতে হবে। অভিযোগ দিলে বিচার মিলবে– এই বার্তা ক্যাম্পাসে পৌছেছে। তাই ছাত্রীরা নি শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ড. সাবিনা ইসলাম বলেন, দুই বছরে দুটি অভিযোগ পাওয়া গেছে। আগের কমিটির রেখে যাওয়া আরও তিনটি অভিযোগ ছিল। এখানে একটি ব্যতিক্রমী দিক হলো বুলিংয়ের শিকার হয়েও একজন ছাত্র আরেক ছাত্রের বিরুদ্ধে অভিযোগ এনেছেন। অভিযোগ গুরুতর না হলে মৌখিক ও লিখিতভাবে সতর্ক করা হয়। কেউ চাইলে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে তাঁর বক্তব্য জানাতে পারেন। তদন্ত চলাকালে যাতে কারও পরিচয় প্রকাশ না হয়, সে লক্ষ্যে সব ধরনের নিয়ম মেনে চলি। অভিযোগকারী ও অভিযুক্তকে আলাদাভাবে ডাকা হয়।

যৌন নিপীড়নের বিষয়ে কীভাবে অভিযোগকারী ও অভিযুক্ত আইনি ন্যায্যতার ভিত্তিতে বিচার পেতে পারেন– সে ব্যাপারে অ্যাডভোকেট সালমা আলী বলেন, অভিযোগকারী না চাইলে তাঁর নাম-পরিচয় গণমাধ্যমে প্রকাশ করা অনুচিত। তবে অভিযোগকারী যদি নিজেই প্রকাশ্যে এসে ভিকটিম হিসেবে ঘোষণা দেন, তাহলে গণমাধ্যম তা প্রকাশ করতে পারে। এ ধরনের সাহস নিয়ে কোনো নারী লড়াই করলে আমরা সেটি উৎসাহ দিয়ে থাকি। বিদেশেও এটি দেখা যায়। অভিযোগকারী তখন অভিযুক্তের নাম প্রকাশ করলে গণমাধ্যমে তা প্রকাশিত হতে পারে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় অনেক সময় নিপীড়নের শিকার হলেও বিচার চাইতে গিয়ে পারিপার্শ্বিক নানা কিছু নিয়ে নারীরা ভাবনায় থাকে।

সালমা আলী আরও বলেন, ভারতের হাওড়ায় বাংলাদেশি এক তরুণীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের পর তাঁর ছবিসহ দুটি গণমাধ্যম তা প্রকাশ করে। বাংলাদেশের ওই গণমাধ্যমকে আমরা লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছিলাম। তারা ভুল স্বীকার করায় এটি আদালত পর্যন্ত যায়নি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত দুই বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৮টি যৌন নিপীড়নের অভিযোগ জমা পড়েছে। তার মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৫টি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছয়টি, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি।

এ ছাড়া বাংলাদেশে আলোচিত সব ঘটনায় সন্দেহভাজনদের আটকের পর সরাসরি গণমাধ্যমের সামনে উপস্থাপন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা। তাৎক্ষণিকভাবে তাদের ছবি, পরিচয় প্রচার করা হচ্ছে। এটি নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক সময় অভিযোগের ব্যাপারে আটকদের বক্তব্য জানার সুযোগ থাকে না। আলোচিত যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের ঘটনায় অভিযুক্তদের আটকের পরপরই মিডিয়ায় তাঁর ছবি প্রকাশ করা হয়। মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, এতে অভিযুক্তদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। এটি অভিযুক্ত ব্যক্তি ও তাঁর পরিবারের জন্য মানহানিকরও বটে।

বিদেশি নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করেছেন– এমন একাধিক শিক্ষক জানান, যৌন নিপীড়নের বিষয়গুলো অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে তদন্ত করে উন্নত বিশ্বের সব ধরনের প্রতিষ্ঠান। সেটি বিশ্ববিদ্যালয় বা ব্যক্তিমালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান হোক না কেন; সব জায়গায় অভিযোগ জানানোর সেল রয়েছে। অভিযোগ প্রমাণের আগে অভিযোগকারী বা অভিযুক্তের নাম-পরিচয় প্রকাশ করা হয় না। উভয়ের পরিচয় সম্পূর্ণ গোপন রাখা হয়। কেউ কাউকে পাবলিকলি দোষারোপ করে না। তবে অভিযোগ প্রমাণের পর প্রকাশ্যে অনেকে কথা বলেন। প্রায় সব অভিযোগকারী শতভাগ সৎ থেকে অভিযোগ আনেন। কাউকে ফাঁসানোর জন্য যৌন হয়রানির মতো অভিযোগ করা হবে– এটি তারা কল্পনাও করেন না। তাই নামিদামি অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিযোগ ওঠার পরপরই অভিযুক্তকে তাঁর দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করতেও দেখা যায়। অনেক খ্যাতনামা অধ্যাপক, এমনকি নোবেল বিজয়ীর বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছে। এরপর তাঁরা চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। কোনো কারণে অভিযোগ প্রমাণ না হলে অভিযোগকারীরও শাস্তি নিশ্চিত করা হয়।

বাংলাদেশের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০-এর ১৪(১) ধারায় সংবাদমাধ্যমে নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর পরিচয় প্রকাশের ব্যাপারে বাধানিষেধ সম্পর্কে বিস্তারিত বলা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘এই আইনে অপরাধের শিকার হয়েছেন এইরূপ নারী বা শিশুর ব্যাপারে সংঘটিত অপরাধ বা তৎসম্পর্কিত আইনগত কার্যধারার সংবাদ বা তথ্য বা নাম-ঠিকানা বা অন্যবিধ তথ্য কোন সংবাদপত্রে বা অন্য কোন সংবাদমাধ্যমে এমনভাবে প্রকাশ বা পরিবেশন করা যাইবে যাহাতে উক্ত নারী বা শিশুর পরিচয় প্রকাশ না পায়।’

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন) ড. খন্দকার মহিদ উদ্দিন বলেন, যৌন নিপীড়নের ঘটনা হলে আইনে ভুক্তভোগীর নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার ব্যাপারে বলা আছে। অভিযুক্তের ব্যাপারে স্পষ্ট কিছু বলা নেই। তবে কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তদন্তের আগে তাকে পুরোপুরি অপরাধী হিসেবে প্রকাশ করার সুযোগ নেই।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button