Hot

প্রলোভনের করুণ পরিণতি

ইউরোপ যেতে পারলেই উপার্জন করা যাবে কোটি কোটি টাকা। আসবে সচ্ছলতা, একদিন হবে বিত্তবৈভব। এমনই উন্নত জীবনের মোহে লাখ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশ পাড়ি দিতে গিয়ে ভূমধ্যসাগরে ডুবে মরছেন বাংলাদেশি তরুণরা। অবৈধ পথে যাত্রা বন্ধে নানা উদ্যোগ ও প্রচার থাকলেও তা কোনো কাজে আসছে না।

দেশে বেকারত্ব, বৈধ পথে ইউরোপে যাওয়ার সুযোগ কম থাকায়, সাগর, তুষার ও বনভূমি পাড়ি দেওয়ার ঝুঁকি নিচ্ছেন তারা। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ইতালির পথে ভূমধ্যসাগরে প্রাণ গেছে আট বাংলাদেশির। 

জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ থেকে ২০২৩ সালের জুলাই পর্যন্ত শুধু ইতালিতে অবৈধভাবে পাড়ি দিয়েছেন ২২ হাজার ৭৭৮ বাংলাদেশি, যা দেশটিতে মোট অবৈধ অভিবাসীর ১৪ শতাংশ। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) মিসিং মাইগ্রেন্টের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, আগের বছরগুলোর তুলনায় ভূমধ্যসাগরে ডুবে মৃত্যু এবং নিখোঁজের সংখ্যা বাড়ছে। ২০২১ সালে ২ হাজার ৪৮ জন, পরের বছর ২ হাজার ১১ এবং ২০২৩ সালে ৩ হাজার ৪১ জন নিখোঁজ অথবা ডুবে মারা গেছেন ভূমধ্যসাগরে। তাদের মধ্যে কয়েকশ বাংলাদেশি বলে ধারণা করা হচ্ছে। 

ইউরোপীয় ইউনিয়নের পরিসংখ্যান দপ্তর ইউরোস্ট্যাটের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সাল পর্যন্ত সোয়া ১ লাখ বাংলাদেশি অবৈধভাবে জোটভুক্ত দেশগুলোতে ছিলেন। ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ইতালিতে অবৈধভাবে ১৫ হাজার ২২৮ জন এবং ২০২১ সালে ৭ হাজার ৮৩৮ জন যান, তাদের ৯৮ শতাংশই লিবিয়া হয়ে। 

লিবিয়ার বাংলাদেশ দূতাবাস জানিয়েছে, গত ১৪ ফেব্রুয়ারি অভিবাসনপ্রত্যাশী একটি দল নৌকায় করে লিবিয়ার জুয়ারা উপকূল থেকে ইউরোপের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করে। নৌকাটি তিউনিসিয়ার উপকূলে ডুবে যায়। এতে চালকসহ ৫৩ জন ছিলেন। আট বাংলাদেশিসহ ৯ জন ডুবে মারা গেছেন। উদ্ধার করা ৪৪ জনের ২৭ জনই বাংলাদেশি। প্রাণ হারানো আটজনের পাঁচজন মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার এবং বাকি তিনজন গোপালগঞ্জের মুকসুদপুর উপজেলার। 

আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া ও ইরাকের মতো যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের অনেক নাগরিক প্রাণ বাঁচাতে অবৈধ পথে ইউরোপ যান। বাংলাদেশিরা কেন যাচ্ছেন– এ প্রশ্নের জবাবে পাওয়া যায়, যত বাংলাদেশি লিবিয়া, ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালি যান, তাদের বড় অংশ বৃহত্তর ফরিদপুরের। এই পথ ধরে যাওয়া প্রবাসী বাংলাদেশিরা সমকালকে জানিয়েছেন, প্রায় দুই দশক ধরে এভাবে দেশান্তর হচ্ছেন অনেকে। আগে সরাসরি লিবিয়া যাওয়া যেত। কিন্তু ২০১১ সালে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ এবং ভূমধ্যসাগরে ডুবে মৃত্যুর কারণে এখন আর যাওয়া যায় না। 

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বৈধভাবে লিবিয়ায় চাকরি নিয়ে গেছেন মাত্র ৯৪ বাংলাদেশি। ইউরোপে পাড়ি জমানো বাংলাদেশি এবং ১৪ ফেব্রুয়ারি ডুবে মারা যাওয়া তরুণদের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, দালালের মাধ্যমে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিতে প্রথমে যেতে হয় দুবাই। সন্দেহ হলে ইমিগ্রেশন ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমাবন্দরে ইমিগ্রেশন আটকে দেয়। 

 তাই সড়কপথে প্রথমে ভারতে যান অবৈধভাবে ইউরোপগামীরা। মুম্বাই থেকে আকাশপথে দুবাই যান। সেখান থেকে সরাসরি লিবিয়া, আবার কোনো ক্ষেত্রে সুদান বা মিসর থেকে লিবিয়া নেওয়া হয়। 

জনশক্তি রপ্তানিকারকদের সংগঠন বায়রা সভাপতি আবুল বাশার সমকালকে বলেছেন, সাগরপথে ইউরোপ পাঠানোর কাজে কোনো রিক্রুটিং এজেন্সির সংশ্লিষ্টতা নেই। পুরোটাই দালালভিত্তিক। 

আদম ব্যবসায়ীদের সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশের গ্রামে গ্রামে, বিশেষত মাদারীপুর, শরীয়তপুর, গোপালগঞ্জজুড়ে রয়েছে ‘রিক্রুটার’। 

এরা প্রথম ধাপের দালাল, যারা মূল দালালের হয়ে ইউরোপ যেতে ইচ্ছুক যুবকদের সংগ্রহ করে। মূল দালালরা গ্রাম থেকে তরুণ ও যুবকদের লিবিয়া পর্যন্ত পাঠায়। সেখানে থাকে আরেক দালাল চক্র। তারা অভিবাসনপ্রত্যাশীদের কয়েক মাস পর্যন্ত লিবিয়ায় নিজেদের জিম্মায় রাখে। তারপর সময়-সুযোগ বুঝে নৌকায় করে ইউরোপে পাঠায়। এই প্রক্রিয়াকে ‘গেম’ বলা হয়। ইতালির কোস্টগার্ড নৌকা ফিরিয়ে দিলে, কয়েকদিন পর আবার পাঠায়। লিবিয়া, তিউনিসিয়া এবং ইতালিতে যাতে নৌকা না আটকায় সেজন্যও দালাল রয়েছে। 

স্থানীয় দালাল সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে ইতালি যেতে ২০ লাখ টাকা পর্যন্ত লাগে। তবে শুরুতে অভিবাসনপ্রত্যাশীকে বলা হয় ৭-৮ লাখ টাকা লাগবে। এর পর লিবিয়ায় নিয়ে আটকে আরও ৭-৮ লাখ টাকা নেওয়া হয়। টাকা আদায়ে মারধর, খুন পর্যন্ত করা হয়। লিবিয়ায় আবার দালালদের অনেক দল-উপদল রয়েছে। এক দালাল চক্র আরেক চক্রের আনা অভিবাসনপ্রত্যাশীকে জিম্মি করে। মারধর করে মুক্তিপণ আদায় করে। ২০২০ সালের মে মাসে ২৬ বাংলাদেশি গুলিতে মারা গিয়েছিল দুই দালাল চক্রের দ্বন্দ্বে। 

মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও গোপালগঞ্জে ‘গেম’ কথাটি ঘরে ঘরে পরিচিত। ইতালির সিসিলিতে থাকা তারিকুল ইসলাম মুন্সি সমকালকে বলেন, এ দেশে মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও গোপালগঞ্জের হাজার হাজার মানুষ থাকেন। তাদের বড় অংশ ‘গেম’ করে এসেছেন। যারা দেশে আছেন, তারাও ইউরোপে থাকা স্বজনের আয়-উন্নতি দেখে একই পদ্ধতিতে আসতে চান। এ কারণেই সাগর পাড়ি দেওয়া বন্ধ হয় না। বাবা-মা জমি বিক্রি করে, সুদে ঋণ নিয়ে ছেলেকে সাগরপথে পাঠান। বড়লোক হওয়ার মোহ না কাটা পর্যন্ত  ‘গেম’ বন্ধ হবে না। 

ডুবে মারা যাওয়া আটজনের স্বজন জানিয়েছেন, সবাই বাড়িতে জানিয়ে ইতালির পথে যাত্রা করেছিলেন। তাদের অভিযোগ, গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের গজারিয়া গ্রামে রহিম শেখ ও রাঘদি ইউনিয়নের সুন্দরদী গ্রামের বাদশা কাজীর ছেলে মোশারফ কাজী জনপ্রতি ১২ থেকে ১৫ লাখ টাকা নিয়ে এই আট যুবককে পাঠিয়েছিলেন। 
রাজৈরের নিহত সজীব কাজীর বাবা মিজানুর রহমান কাজী টেলিফোনে সমকালকে বলেন, দালাল রহিম শেখের সঙ্গে ১৪ লাখ টাকা চুক্তি হয়। তার ভাই কামাল নগদ ১২ লাখ টাকা নিয়ে ছেলেকে লিবিয়া পাঠায়। ছেলে বলেছিল ‘গেম’ হবে। 

রাজৈরের আরেক নিহত সজল বৈরাগীর বাবা সুনীল বৈরাগী বলেন, টাকার লোভে ছেলেকে স্বপ্নের দেশ ইতালি পাঠাতে চেয়েছিলাম। জমি বিক্রি করে দালালের কাছে টাকা দিয়েছি। এখন আমার সবই শেষ হয়ে গেল।

নৌকাডুবির পর থেকে দালালরা এলাকাছাড়া। তাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, দালালদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে সাধারণ মানুষকেও সচতেন হতে হবে। তা না হলে এমন মৃত্যু কমবে না।

অবৈধ অভিবাসন বন্ধে ২০২১ সাল থেকে কৃষিসহ মৌসুমি শ্রমিক নিয়োগ করছে ইতালি। ২০২৩ সালে রেকর্ড ১৬ হাজার ৮৭৯ বাংলাদেশি কর্মী দেশটিতে চাকরি নিয়ে যান। আগের বছর যান ৭ হাজার ৫৯৪ জন। অবৈধ অভিবাসন বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টিতে ২০২২ সালের জুলাইয়ে শরীয়তপুরে গিয়ে প্রচার চালান পুলিশের মহাপরিদর্শক, পররাষ্ট্র সচিব, প্রবাসীকল্যাণ সচিব এবং ঢাকায় নিযুক্ত ইতালির রাষ্ট্রদূত। কিন্তু তাতে ফল হয়নি। যারা ইতালিতে চাকরি করতে যাওয়ার দক্ষ নন কিংবা ভিসা পাচ্ছেন না, তারা সাগরপথই বেছে নিচ্ছেন। 

গত বছর বাংলাদেশ থেকে রেকর্ড ১৩ লাখ কর্মী চাকরি নিয়ে বিদেশ যান। বৈধ পথ খোলা থাকলেও, কেন তরুণরা মৃত্যুপথে ইউরোপ যাচ্ছেন– এর জবাবে জনশক্তি খাত সংশ্লিষ্টরা জানান, মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরে শ্রম দিতে যান দরিদ্র পরিবারের সন্তানরা। গ্রামের অবস্থাসম্পন্নরা সামাজিক অবস্থানের কারণে শ্রমিকের কাজ করতে চায় না। তারা দালাল ধরে ইউরোপ বা আমেরিকা যাওয়ার চেষ্টা করে। 

অভিবাসী কর্মী উন্নয়ন প্রোগ্রামের (ওকাপ) নির্বাহী পরিচালক শাকিরুল ইসলাম বলেন, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে প্রবেশে চেষ্টাকারীদের এক-তৃতীয়াংশ ধরা পড়ে বা ডুবে মারা যান। বাকি দুই-তৃতীয়াংশ কোনো না কোনোভাবে প্রবেশ করেন। যারা ব্যর্থ, তাদের কথা আসে না। যারা দেশে টাকা পাঠিয়ে দালান তোলেন, তাদের দেখে বাকিরা উৎসাহিত হয়। তাই উৎসমুখে তরুণদের থামাতে হবে। এ জন্য তাদের জন্য নিরাপদ অভিবাসন বাড়াতে দক্ষ কর্মী তৈরি করতে হবে। দক্ষতা এবং দেশে কর্মসংস্থান না থাকলে তরুণরা অবৈধ পথে পা বাড়াবেই। 

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d