প্রশাসনের সর্বত্রই এনজিও-আওয়ামী তাঁবেদারদের দৌরাত্ম্য, হালাল দালালিতে বুদ্ধিজীবী-গণমাধ্যম
‘হালাল সাবান’ স্লোগানে একটি সাবান ক্রেতাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। এ্যারোমেটিক নামের ওই সাবান এখন বাজারে দেখা যায় না। ‘নুন খাই যার গুণ গাই তার’ প্রবাদটি বাজারে এখনো চালু রয়েছে। শেখ হাসিনার শাসনামলের ১৫ বছর গুম-খুন-জুলুম-নির্যাতন-নিষ্ঠুরতা-পৈশাচিকতা দেখেও যারা ‘নুন খাওয়ায়’ নীরব থেকে সরকারের দালালি করেছেন, প্রগতিশীলতার নামে দিল্লির নুন খেয়ে ভারতের পক্ষে দালালি করেছেন; সেই দালালচক্র ফের সরব হয়ে উঠেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দিল্লি পালিয়ে যাওয়ার পর কেউ নীরব কেউ লুকিয়ে ছিলেন। কেউ কেউ গিরগিটির মতো রঙ বদল করার চেষ্টা করেছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের দু’-চারজন ভারতপ্রেমী উপদেষ্টা, প্রশাসনের কিছু সাবেক ছাত্রলীগ আমলা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে কিছু ছাত্রলীগ কোটার চাকরি পাওয়া কর্মকর্তা এবং শেখ হাসিনার ‘ড. ইউনূস সরকার এক মাসও টিকবে না’ এবং ‘চট করে দেশে ঢুকব’ বক্তব্যে আত্মবিশ্বাসী হয়ে তারা আবার নেমে পড়েছে। তারা এবার দিল্লির অ্যাজেন্ড আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন প্রকল্প ‘আনুপাতিক নির্বাচন’ অ্যাজেন্ডা নিয়ে সরব হয়ে উঠেছে। উদ্দেশ্য একদিকে বিএনপিকে ঠেকানো, অন্যদিকে নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে সংসদে পুনর্বাসন। এ লক্ষ্যে নির্বাচন-ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনকে ‘আনুপাতিক নির্বাচন’ পদ্ধতি প্রণয়ন করে আইন করতে বাধ্য করা।
দেশের রাজনীতিতে গণহত্যকারী পলাতক শেখ হাসিনাকে পুনর্বাসনে ভারতীয় অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে এই সব সুশীল-বুদ্ধিজীবী ও গণমাধ্যমের ‘নুন খেয়ে গুণ গাওয়া’ প্রবাদের মতোই যেন হালাল কাজে নেমেছেন। কারণ শেখ হাসিনা ১৫ বছর বিদেশ দেশে ফিরেই গণভবনে সংবাদ সম্মেলনের নামে যে ‘তোয়াজ পার্টি’র আয়োজন করতেন; এই দালাল শ্রেণির গণমাধ্যম, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীরা সেটিতে শরিক হতেন, পিঠা-পুলি খেতেন। তাছাড়া প্লট, ফ্ল্যাট, বিভিন্ন সেক্টরে পদ-পদবি, কন্ট্রাক্টরি, লাইসেন্স, প্রশাসনে নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা রোজগার করেছেন। এখন আওয়ামী লীগের দুর্দিনে তাদের পাশে থাকা হালাল দায়িত্ব। দেশে নানা ধরনের দালাল আছে। গরুর দালাল, জমির দালাল, থানার দালাল, বিদেশে লোক পাঠানোর দালাল, বিআরটিএর দালাল, হাসপাতালের দালাল, কোর্টের দালাল, বিমার দালাল, বেশ্যার দালাল, পাসপোর্ট অফিসের দালাল, সচিবালয়ের দালাল, বিআরটিএ দালাল, রাজনৈতিক দালাল, বিয়ের দালাল (ঘটক)। তবে রাজনীতির দালালরা হন বিবেকহীন, চাটুকার, অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ও ক্ষতিকর। এর দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি এবং গণতন্ত্র, জনগণের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অন্তরায়।
৫ আগস্ট হাসিনা পালনোর পর এই দালালচক্র লুকিয়ে পড়েছিল। অন্তর্বর্তী সরকার তাদের গ্রেফতার করে কি-না সে ভয়ে কেউ কেউ পালানোর চেষ্টাও করেন। এর মধ্যে শুরু হয় গ্রেফতার। সাবেক মন্ত্রী-এমপিদের গ্রেফতার শুরু হলে এদের কেউ কেউ রঙ বদলের চেষ্টা করেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক তথ্য উপদেষ্টা গত রোববারও রংপুরে বলেছেন, ‘যে সব গণমাধ্যম ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিল তাদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে।’ কিন্তু বাস্তবতা হলোÑ অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম কার্যত ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’ অবস্থা। সরকারের একাধিক উপদেষ্টার কার্যক্রম, প্রশাসনের বিভিন্ন সেক্টরে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগে আওয়ামী লীগ ও ভারতীয় চেতনাধারীদের অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে। পাশাপাশি প্রশাসনে নিয়োগ, বদলি, রদবদলের নামে হাসিনা অনুগতদের তাড়ানোর প্রচারণা চালানো হলেও এখনো সর্বত্রই জেঁকে রয়েছে সাবেক ছাত্রলীগ আমলারাই। পুলিশ প্রশাসনে একই চিত্র। বিতর্কিত পুলিশ কর্তাদের গ্রেফতারের বদলে তাদের বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার সহায়তা করা হচ্ছে। অন্যদিকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পুলিশ গুলি করে মানুষ হত্যার প্রতিবাদ করায় ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে পুলিশ হত্যা মামলায় গ্রেফতার করা হচ্ছে।
শেখ হাসিনা অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে একের পর এক ষড়যন্ত্র অব্যাহত রাখলেও প্রশাসন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ততটা কঠোর নয়; বরং লালমনিরহাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার (নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট) তাপসী তাবাসসুম ঊর্মির (সাময়িক বরখাস্ত) মতোই হাজার হাজার আওয়ামী লীগপ্রেমী আমলা প্রশাসনে রয়ে গেছে। গত রোববার বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, ‘প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা স্বৈরাচারের দোসররা অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলতে চাইছে। এই সরকারের প্রশাসনে তো রন্ধ্রে রন্ধ্রে পতিত স্বৈরাচাররা অপেক্ষা করে আছে। তারা তো এই সরকারের নীতি বাস্তবায়ন করতে বাধা দেবে। প্রশাসন হচ্ছে সরকারের নীতিকে বাস্তবায়ন করার সবচাইতে বড় মেশিন, সবচাইতে বড় যন্ত্র। সেই যন্ত্র যদি নিশ্চল থাকে, ঠিকমতো কাজ না করে তাহলে তো জনগণের ক্ষোভ গিয়ে সরকারের ওপর পড়বে। কিন্তু এই ঘাপটি মারা যারা স্বৈরাচারের লোক ভেতরে রয়েছে তারা তো কিছুু বুঝতে দেবে না।’ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে লুকিয়ে থাকা ভারতের তাঁবেদার সুশীল, বুদ্ধিজীবী, গণমাধ্যম হৈহৈরৈরৈ করে জেগে উঠেছে। তারা দিল্লির অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে দালালিতে নেমেছে।
সোশ্যাল মিডিয়ায় নেটিজেনরা প্রশ্ন তুলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসনযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণ কার হাতে? ড. মুহম্মদ ইউনূসের সরলতাকে পুঁজি করে কিছু এনজিও, ভারতীয় তাঁবেদার গণমাধ্যম, হাসিনার একান্ত অনুগত গণমাধ্যমকর্মী, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর, বুদ্ধিজীবী তথা সুশীলরা প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করছেন? বিভিন্ন সেক্টর, করপোরেশননে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রমোশন তথাকথিত চেনতাধারীদের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন সংবিধানিক প্রতিষ্ঠান সংস্কারে যে কমিশনগুলো গঠিত হয়েছে সেখানেও একই চিত্র। উপদেষ্টাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন রয়েছেন যারা এনজিও পরিচালনায় যুক্ত। সংস্কার সংক্রান্ত কমিশনেও এনজিও কর্মকর্তাদের অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এমনকি দুর্নীতি দমন কশিমন সংস্কারে কমিশনের দায়িত্বে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক এবং সংবিধান সংস্কার কমিটির প্রধান করা হয়েছে বিদেশি (যুক্তরাষ্ট্র) নাগরিককে। সোশ্যাল মিডিয়ায় নেটিজেনরা বলছেন, ভারতের তাবেদার দু’টি গণমাধ্যম যেভাবে চাচ্ছে সেভাবেই সংস্কার কমিশন করা হয়েছে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের প্রশাসন সাজানো হচ্ছে। জনপ্রিয় ইউটিউবার পিনাকি ভট্টাচার্য বলেছেন, বাংলাদেশে কি সংবিধান বিশেষজ্ঞের আকাল পড়েছে? যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিককে বাংলাদেশের সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হলে অন্য কোনো দেশে কাজ করলে বিশেষ প্রক্রিয়ায় এনওসি নিতে হয় এবং কি কাজ করবেন তা জানাতে হয় এবং কাজ জমা দিতে হয়। প্রফেসর আলি রিয়াজ কি বাংলাদেশের সংবিধান সংস্কার ভিনদেশ (যুক্তরাষ্ট্র) জানাবেন? তাহলে কি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব থাকে? আর না জানালে তো আলি রিয়াজের যুক্তরাষ্টের নাগরিক হিসেবে অপরাধী হবেন।
আওয়ামী লীগ রেজিমে কিছু মিডিয়া প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখে, সংবাদ প্রচার করে এবং টকশোর নামে প্রতিদিন শেখ হাসিনাকে উসকিয়েছেন। কোটাবিরোধী আন্দোলন শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে ঠেকানোর জন্য শেখ হাসিনাকে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাদের ইন্ধনেই শেখ হাসিনা নিষ্ঠুর হয়ে উঠেন এবং পুলিশ বাহিনীকে দানবে পরিণত করে ছাত্র-জনতাকে রাজপথ থেকে হটাতে গুলি চালাতে বাধ্য করেন। গুলি করে, ব্রাশফায়ার করে, স্নাইপার দিয়ে বহুদূরে গুলি করে শতশত ছাত্র-জনতা হত্যা করা হয়। সাংবাদিকতার নামে এতগুলো মানুষকে হত্যার এই উসকানিদাতারা দায় এড়াবেন কিভাবে? অপ্রিয় হলেও সত্য যে, সুযোগ-সন্ধানী গণমাধ্যম ও এই তথাকথিত প্রগতিবাদী সাংবাদিক নামধারী তোষামোদকারীরা দেশের গণমাধ্যমকে কলুষিত করেছেন। গণমাধ্যমের চরিত্রই পাল্টে দিয়েছে। দালাল শ্রেণির এই সাংবাদিকরা ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালের পাতানো নির্বাচনের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে জনগণের ভোটাধিকার হরণে শেখ হাসিনাকে সহায়তা করেছেন। বিনিময়ে নিজেরা কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। কেউ প্লট, ফ্ল্যাট নিয়েছেন, কেউ তদবির বাণিজ্য করে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন, কেউ কেউ আবার বিভিন্ন করপোরেশন, দূতাবাস, সেক্টর, ব্যাংক-বিমার মালিক হয়েছেন। কেউ সরকারি প্রতিষ্ঠানের পদ-পদবি এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে অর্থ-সম্পদ লুট করেছেন। দেশের বিপুল সংখ্যক সাংবাদিক এখনো অর্থাভাবে স্বাভাবিকভাবে চলতে পারেন না। শেখ হাসিনাকে খুশি করতে এরা ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে কোরাস গেয়েছেন। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতাচ্যুত হলে এক রাতে ১০ লাখ নেতাকর্মী মারা পড়বে।’ পলাতক ওবায়দুল কাদেরের সেই কাল্পনিক আশঙ্কা মিথ্যা প্রমাণ হয়েছে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পালানো এবং ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর সহিংসতা তেমন ঘটেনি। সম্প্রসারণবাদী ভারত বাংলাদেশ সংখ্যালঘু নির্যাতনের ধোঁয়া তুললেও বিএনপি, জামায়াতসহ রাজনৈতিক দলগুলো হিন্দুদের বাসা প্রহরা দিয়েছে। ফলে তেমন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু শেখ হাসিনার শাসনামলে প্রশাসনে যে সাবেক ছাত্রলীগ নেতাদের ভরে ফেলা হয়েছে। সচিব থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায়ের অফিস পিওন পর্যন্ত সাবেক ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের আত্মীয়-স্বজন। মানুষের প্রত্যাশা ছিল অন্তর্বর্তী সরকার প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল এনে সাবেক ছাত্রলীগ আমলাদের সরিয়ে নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসাবেন। সচিব ও ডিসি পর্যায়ে প্রক্রিয়াও শুরু হয়। কিন্তু টাকা নিয়ে ডিসি পদায়ন ইস্যু নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে প্রক্রিয়া থেমে যায়। বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার কাজ করলেও প্রশাসনে এখনো সাবেক ছাত্রলীগ আমলারা সুসংগঠিত। ফলে ভারত যেভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করতে চায় সেটিকে এগিয়ে নিতে বুদ্ধিজীবী, সুশীল, গণমাধ্যমগুলো তৎপর হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে গণমাধ্যম আওয়ামী লীগ পুনর্বাসন ইস্যু নিয়ে দালালিতে নেমে পড়েছে। কারণ তারা বিগত ১৫ বছর হাসিনার যে হালুয়া-রুটি খেয়েছে তার প্রতিদান দিতে চাচ্ছে। এটি তাদের নৈতিক দায়িত্ব। অবস্থা এমন যে, ‘তোরা যে যা বলিস ভাই, আমার সোনার হরিণ চাই’ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গানের বিপরীত চিত্রÑ ‘তোরা যে যা বলিস ভাই, নির্বাচনে বিএনপিকে ঠেকানো চাই।’