Bangladesh

প্রাণহানি-সহিংসতা, আন্তর্জাতিক তদন্তে জোর কূটনীতিকদের

কোটা সংস্কার আন্দোলনে দুই শতাধিক মৃত্যু, হাজার হাজার আহত এবং রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের দাবি পুনর্ব্যক্ত করলেন ঢাকায় নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত। বৃহস্পতিবার বিকালে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত জরুরি কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে পশ্চিমা দুনিয়ার প্রতিনিধিরা প্রায় অভিন্ন সুরে কোটা আন্দোলনে ব্যাপক প্রাণহানি ও সহিংসতার আন্তর্জাতিক তদন্তের দাবি পুনর্ব্যক্ত করেন। ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন। সরকার এরইমধ্যে বিভিন্ন ঘটনার তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জানিয়ে তারা দেশীয় তদন্ত কাজে ফরেনসিক তথা কারিগরি সহায়তা নেয়ার কথা জানান। ব্রিফিংয়ে সরকারের প্রতিনিধিরা কোটা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের চলমান আন্দোলনে তৃতীয়পক্ষের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ হিসেবে বিভিন্ন ডকুমেন্ট উপস্থাপন করেন। অনেকটা বাধ্য হয়েই আইনশৃঙ্খলাবাহিনী বল প্রয়োগ করেছে বলে তারা কূটনীতিকদের বোঝানোর চেষ্টা করেন। ব্রিফিং সূত্র বলছে, এ নিয়ে পররাষ্ট্র সচিবের স্বাগত বক্তব্যের পর উন্মুক্ত আলোচনা ও প্রশ্নোত্তর পর্বে ফ্লোর নেন ঢাকায় নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি গেয়েন লুইস। তিনি সহিংসতা ব্যাপকতার বিষয়টি তুলে ধরে শিক্ষার্থী, সাংবাদিক, পুলিশ, শিশুসহ প্রত্যেকটি প্রাণহানির বিশ্বাসযোগ্য তদন্তে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততার প্রস্তাবের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন। পরবর্তীতে ফ্লোর নেন বৈঠকে উপস্থিত কানাডিয়ান হাইকমিশনার লিলি নিকোলস। তিনি জাতিসংঘ দূতের সঙ্গে অভিন্ন অবস্থান ব্যক্ত করে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগের অভিযোগ নিয়ে কথা বলেন।

সূত্র বলছে, কোটা সংস্কার আন্দোলেনে ব্যাপক প্রাণহানির পর লাখো মানুষের বিরুদ্ধে মামলা ও গণগ্রেপ্তারে দেশব্যাপী আতঙ্ক এবং চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। এতে নতুন করে আর কোনো জানমালের ক্ষতি দেখতে চায় না আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়। দেশজুড়ে সংঘাত-প্রাণহানি এবং ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে গত সপ্তাহে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদকে যৌথ চিঠি দেয় ঢাকার ১৪ মিশন। সেই চিঠিতে সংকটের টেকসই সমাধান খোঁজার আহ্বান জানানোর পাশাপাশি নতুন প্রাণহানির ঘটনা এড়াতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোকে সংলাপের তাগিদ দেয়া হয়। সেই আহ্বান বিবেচনায় সরকার গৃহীত পদক্ষেপগুলোর বিষয়ে অবহিত করতে কূটনীতিক ব্রিফিংয়ের উদ্যোগ নেয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। অপ্রত্যাশিতভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বিদেশ সফর দীর্ঘ হওয়ার প্রেক্ষিতে (অর্থাৎ মন্ত্রী ব্রাসেলস থেকে লন্ডন হয়ে ফেরার নির্দেশনা থাকায়) পররাষ্ট্র সচিব ব্রিফিংটি করেন। এতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বরাবর পাঠানো যৌথ চিঠির ১৪ সিগনেটরি যুক্তরাষ্ট্র, বৃটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, স্পেন, নেদারল্যান্ডস, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, সুইডেন, ডেনমার্ক, নরওয়ে ও অস্ট্রেলিয়া দূতাবাস এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ডেলিগেশন কার্যালয়ের প্রতিনিধি ছাড়াও জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি, ভারত, চীন, রাশিয়া ও সৌদি রাষ্ট্রদূত বিশেষভাবে আমন্ত্রিত ছিলেন। মন্ত্রীকে লেখা চিঠিতে চলমান সংকট সমাধানে আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত বল প্রয়োগের জবাবদিহি, আটককৃত ব্যক্তিদের বিচারে যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ এবং যত দ্রুত সম্ভব সারা দেশে পুরোদমে ইন্টারনেট চালুর অনুরোধ জানানো হয়েছিল। চিঠিতে আন্তর্জাতিক অংশীদার হিসেবে তারা ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরকারের সংলাপের তাগিদ দিয়েছিলেন। চিঠিতে ২১শে জুলাই কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ের প্রসঙ্গ টেনে বলা হয়েছিল, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তাদের মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগের জবাবদিহি নিশ্চিতে সরকারের আন্তরিকতা প্রশংসনীয়। সহিংসতায় জড়িত সন্দেহে আটককৃতদের বিচারে মানবাধিকার সমুন্নত রাখার তাগিদও ছিল ১৪ মিশনের সেই চিঠিতে। সূত্র বলছে, ১লা আগস্টের ব্রিফিংয়ে ইন্টারনেট সচল করা এবং ডিবি হেফাজত থেকে ৬ সমন্বয়কের মুক্তির বিষয়টি তুলে ধরা হয়, যা কূটনীতিকদের প্রশংসা কুড়িয়েছে। ওদিকে ব্রিফিং শেষে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, সহিংসতার ঘটনা তদন্তে জাতিসংঘের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশন পাঠানোর প্রস্তাব এখনই স্বাগত জানাতে চায় না বাংলাদেশ। চলমান বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশনের রিপোর্ট পর্যন্ত অপেক্ষা করা দরকার। কারণ এটি রাষ্ট্রের উদ্যোগ। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় যুক্তরাষ্ট্র-চীন-রাশিয়া-ভারত-যুক্তরাজ্যসহ ২২টি দেশ ও জাতিসংঘের মিশন প্রধানদের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে ব্রিফ করা হয়েছে উল্লেখ করে পররাষ্ট্র সচিব জানান, ব্রিফিংয়ে বিভিন্ন ঘটনার ভিডিও কূটনীতিকদের দেখানো হয়েছে। এখানে তৃতীয় পক্ষের উপস্থিতি ছিল তা বিভিন্ন ফুটেজেই স্পষ্ট। গত কয়েকদিনে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যথেষ্ট ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে বলে দাবি করেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মাসুদ বিন মোমেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে চলমান ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে কয়েকটি দেশ সরকারের ব্যাখ্যা শুনতে চেয়েছিল বলে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন বলেন, সামপ্রতিক ঘটনা নিয়ে দেশে এবং বিদেশে নানা গুজব ছড়ানো হচ্ছে। এতে করে যাতে কূটনীতিকরা প্রাভাবিত না হন সেজন্য এবং এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করতে বিদেশি মিশনগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ততা অব্যাহত রাখবে সরকার। সচিব বলেন, চলমান ঘটনা নিয়ে সরকারের ব্যাখ্যা জানতে অনেক দেশ আগ্রহী ছিল। গ্রেপ্তারের সংখ্যা, অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ হচ্ছে কি না, বাকস্বাধীনতা আছে কি না- এসব বিষয়ে প্রশ্ন রয়েছে কয়েকটি দেশের। র?্যাব হেলিকপ্টার থেকে গুলি করেনি বিষয়টি প্রমাণ করে- এমন ভিডিও দেখানো হয় বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের। আন্দোলনকারীদের কর্মসূচিতে বাধার বিষয়ে তিনি বলেন, যেসব জায়গায় শান্তিপূর্ণ সমাবেশ করছে সেখানে বাধা দেয়া হচ্ছে না। বাংলাদেশে গঠিত তদন্ত কমিটিকে জাতিসংঘ কারিগরি সহায়তা করতে চাইলে সরকারের আপত্তি নেই বলে জানিয়ে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, তবে আলাদা কোনো তদন্ত কমিটিতে এখনই উৎসাহ নেই সরকারের। 

সরকারের প্রতি অনাস্থা নেই বিদেশিদের: নাঈমুল ইসলাম
ওদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলন ঘিরে চলমান ঘটনায় সরকারের প্রতি বিদেশিদের অনাস্থা নেই বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাঈমুল ইসলাম খান। রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত উন্নয়ন অংশীদার রাষ্ট্রের কূটনীতিকদের সঙ্গে আলোচনা শেষে সাংবাদিকদের তিনি এ কথা জানান। তিনি বলেন, ‘আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কে কোনো সমস্যা নেই।’

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button