Bangladesh

প্রার্থীদের হলফনামায় কোটি টাকার জমি লাখ টাকা দেখিয়েও সম্পদ বেড়েছে শতগুণ!

সমসাময়িক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান ‘৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লোপাটের বিষয়টি স্বীকৃত’ :: শৈথিল্য দেখালে মার্কিন বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি বাড়বে :: দুষ্টচক্রের কবলে ব্যাংক খাত

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রার্থীদের হলফনামায় সম্পদ বৃদ্ধির হার দেখে বিস্মিত হয়েছি। যেখানে এক কাঠা জমির দাম এক কোটি টাকা; সেখানে এক লাখ টাকা দেখানো হয়েছে। তারপরও যদি শতগুণ সম্পদ বাড়ে তাহলে বাস্তব চিত্র কী! এটা দেখে তো বুঝা যায় না আসলে সম্পদ কত বেড়েছে।

গতকাল রাজধানীর পল্টনে ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম (ইআরএফ) আয়োজিত দেশের সম-সাময়িক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে মতবিনিময়কালে এ মন্তব্য করেন তিনি। ইআরএফ-এর সভাপতি মোহাম্মদ রেফায়েত উল্লাহ মীরধার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠান সঞ্চালন করেন সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম।

তিনি বলেন, প্রার্থীদের হলফনামায় অনেকের সম্পত্তি কয়েকশগুণ বেড়েছে। কীভাবে এত কম সময়ে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি বাড়ল তা দেখার বিষয়। যাদের সম্পত্তি এতো বেড়েছে সরকার ও নিজ দলের উচিত এসব সম্পত্তির উৎস জানতে চাওয়া। একই সঙ্গে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাজ হবে তাদের সম্পত্তির উৎস বের করা। তাদের সম্পত্তি অবৈধ দুর্নীতির মাধ্যমে হয়েছে কি না তা জানা এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া। কারণ রাজনীতিবিদদের বিষয়ে যদি জনগণের সন্দেহ অনাস্থা থাকে, তাহলে নির্বাচনের পর সাধারণ মানুষ তাদের কীভাবে গ্রহণ করবে।

‘ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এমন বক্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, প্রধানমন্ত্রী দেশ চালান তার কাছে হয়ত অনেক বেশি তথ্য উপাত্ত আছে, তাই তিনি এমন কথা বলেছেন। তবে আমাদের যে ফসল হয়েছে, খাদ্য মজুত আছে, আন্তর্জাতিক বাজারের খাদ্যপণ্যের দাম সব কিছু বিবেচনা করলে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা দেখছি না।

তিনি বলেন, নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন অনেক আগে বলেছিলেন, খাদ্যের অভাবে পৃথিবীতে কখনও দুর্ভিক্ষ হয়নি, হয়েছে সুষম বণ্টনের অভাবে। আমাদের উৎপাদন ও মজুতের সমস্যা নেই। তবে যেটা হতে পারে তা হলো মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশের কারণে দেশের বড় অংশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। এখন উৎপাদন ভালো হলেও মানুষ যদি ক্রয় করতে না পরে তাহলে সমস্যা দেখা দেবে। এজন্য সামাজিক সুরক্ষা বাড়াচ্ছে। এটা সঠিক নিয়মে বাড়াতে পারলে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

‘৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লোপাটের বিষয়টি স্বীকৃত’
গত ১৫ বছরে ব্যাংকিং খাত থেকে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লোপাটের বিষয়টি স্বীকৃত বলে মন্তব্য করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)‘র সম্মাননীয় ফেলো ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মোস্তাফিজুর রহমান।

তিনি বলেন, ২০০৮ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের মাধ্যমে ব্যাংক খাত থেকে ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লোপাট সংক্রান্ত সিপিডি যে তথ্য প্রকাশ করেছে, সেটা বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যম প্রকাশিত তথ্য থেকে নেওয়া হয়েছে। সিপিডি‘র সংবাদ সম্মেলনে এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। আমরা নিজেরা কোনো গবেষণা করিনি। বরং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় যেসব তথ্য এসেছে তার আলোকে আমরা এটা প্রকাশ করেছি। একই সঙ্গে পত্রিকাগুলোতে প্রকাশিত ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা লোপাটের বিষয়ে প্রকাশিত তথ্যের বিষয়ে কোনো ধরনের প্রতিবাদ ইত্যাদি হয়নি। ফলে সাধারণভাবে এই অর্থ লোপাটের বিষয়টি স্বীকৃত। ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, যারা সিপিডি ব্যাংক খাতের লোপাট হওয়া বক্তব্যের বিষয়ে কথা বলেছেন, তারা খুব ভালো করেই জানেন, ব্যাংক খাত থেকে লোপাট হওয়া ৯২ হাজার ২৬১ কোটি টাকা কেবল আইসবার্গ বা একটি ছোট্ট অংশ। আসলে এটা আরও বেশি হবে। বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে কিভাবে টাকা চলে গেছে। আর এই কারণেই বিভিন্ন ব্যাংকের বোর্ড পুর্নগঠন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন সময়ে এসব বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করেছে। হয়তো অনেক সময় তা সফল হয়নি।

দুষ্টচক্রের কবলে ব্যাংক খাত
ব্যাংক খাত নিয়ে ড. মোস্তাফিজুর বলেন, এই খাতে অব্যবস্থাপনা অনিয়ম চলছে, খেলাপি ঋণ বাড়ছে, কিছু ব্যাংক বিপর্যয়ের মধ্যেও পড়েছে। আর্থিকভাবে দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত বা মার্জার করার বিষয় আগেই অনেকবার বলা হয়েছে। এজন্য আইনি দুর্বলতা ও নিয়মনীতিগুলো ঠিক করতে হবে। কারণ ব্যাংকিং সেক্টর হচ্ছে অর্থনীতির প্রাণ। এ খাতের সমস্যা পুরো অর্থনীতির ওপর পড়ে।

তিনি বলেন, ঋণ খেলাপির বিপরীতে একটি বড় অংকের অর্থ ব্যাংকের প্রভিশনিং করতে হচ্ছে। এর মানে টাকাটা অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারছে না ব্যাংকে পড়ে থাকছে। এতে করে একদিকে ব্যাংকের ঋণ দেওয়ার ক্ষমতা কমে যাচ্ছে। অন্যদিকে আয় কমে যাচ্ছে অর্থাৎ ১০০ টাকার আমানতের বিপরীতে সুদ দিচ্ছে কিন্তু ঋণ দিতে পারছে ৮০ টাকা। তার মানে ঋণের সুদহার বাড়াতে হচ্ছে। এটা আবার বিনিয়োগে প্রভাব ফেলছে।

ব্যাংকিং সেক্টরের এ অবস্থা একটি ‘দুষ্টচক্র’ সৃষ্টি করছে উল্লেখ করে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এ খাতের অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ পাচার সব কিছুই এক জায়গায় নিয়ে এসেছে। এটা নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে হবে। এখানে হস্তক্ষেপ করা যাবে না। আগামীতে এ খাতের শৃঙ্খলা ফেরাতে এ উদ্যোগ নিতে হবে।

শৈথিল্য দেখালে মার্কিন বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি বাড়বে
চলমান রাজনৈতিক সংকট এবং সে সুযোগে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে মার্কিন হস্তক্ষেপের রেশ ধরে নির্বাচনের পর আমেরিকার বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আসবে কিনা তাই এখন জনমনে বড় প্রশ্ন। অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান এমন শঙ্কা উড়িয়ে না দিয়ে বরং নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার অজুহাতগুলো বন্ধের তাগিদ দিলেন সরকারকে। যুক্তরাষ্ট্রের স্যাংশনের বিষয় সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আমেরিকা তাদের নিজেদের সুবিধার জন্য বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা (স্যাংশন) দেয়। আবার প্রয়োজনে ভেনিজুয়েলার মতো দেশের সঙ্গে চুক্তি করে। তাই তারা স্যাংশন দেবে কি দেবে না সেদিকে নজর না দিয়ে যেন স্যাংশন দেওয়ার সুযোগ না পায় এ বিষয়ে জোর দিতে হবে। আমাদের শ্রমিকদের মজুরি ও অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। সংস্কার নিয়ে সরকার যত শৈথিল্য দেখাবে মার্কিন বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞার ঝুঁকি তত বাড়বে মনে করেন সিপিডির এই ফেলো।

ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশি হস্তক্ষেপ এড়াতে চাইলে জনগণের সর্মথনে সরকার গঠন করতে হবে। আর্থিকখাতের সংস্কারে সরকার নির্মোহ না হলে আগামী দিনে ব্যাংকখাতের সংকট আরও বাড়বে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। তিনি বলেন ভু-রাজনৈতিক কারনেই বাংলাদেশ অনেক দেশের মাথা ব্যাথার কারন। জনগণের নির্বাচিত সরকারের পক্ষেই কেবল সম্ভব মাথা উঁচু করে নিজের স্বার্থ রক্ষা করা। সম্প্রতি ব্যাংকখাত ও অর্থ লোপাট নিয়ে সরকারের দায়িত্বশীলদের মন্তব্যে নিজের হতাশার কথা জানান এ অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, সিপিডির প্রত্যাশা নীতিনির্ধারকেরা সমস্যার গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে তা নির্বাচনী ইস্তেহারে রাখবেন। রাজনৈতিক নানা টানাপোড়েন থাকলেও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও ভাগ্য পরিবর্তনে দিন শেষে রাজনীতিবিদের কোনো বিকল্প নেই উল্লেখ করে নীতি নির্ধারকদের আরও সমালোচনা-সহিষ্ণু হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

তিনি বলেন, সরকার নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তৈরি পোশাক শিল্পকে এ পর্যায়ে এনেছে। পোশাকের বিশ্বের বাজার ৭০০ বিলিয়ন ডলার। এ শিল্পের বাইরে রফতানির সম্ভাবনা রয়েছে এমন বড় খাত আমাদের অন্য একটাও নেই। রফতানি বহুমুখীকরণ করতে হবে, নতুন বাজারে যেতে হবে তবে এ খাত বাদ দিয়ে নয়। কারণ এখনো এ বাজারের অনেক বড় অংশ দখল করার সুযোগ রয়েছে। এজন্য আমাদের আরও আধুনিকায়ন করতে হবে। এছাড়া আমাদের চামড়া খাত ও ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য রফতানিতে জোর দিতে হবে। বিশ্বে ফার্মাসিউটিক্যালে এক ট্রিলিয়ন ডলারের বাজার আছে। এটার বাজার ধরতেও কাজ করতে হবে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button