প্রার্থী তালিকা থেকে বাদ যেতে পারেন বিএনপির অনেক হেভিওয়েট নেতা

আগামী নির্বাচনে সারা দেশে তিন ডজনেরও বেশি হেভিওয়েট নেতা দলীয় মনোনয়ন নাও পেতে পারেন। তাদের মধ্যে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির দুই-একজন নেতাও থাকতে পারেন।
গণ-অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষাকে ধারণ করে রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে নির্বাচনে বিতর্কিত কাউকে প্রার্থী করতে চায় না বিএনপি। এ ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত তরুণ, সংগঠনের জন্য নিবেদিত এবং বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে যুক্ত নয়- তাদের হাতেই আগামী নেতৃত্বের ঝাণ্ডা তুলে দেয়ার চিন্তা করছে বিএনপি। দলটি মনে করছে, ৫ আগস্টের পরে তরুণ নেতৃত্বের প্রতি মানুষের এক ধরনের আগ্রহ তৈরি হয়েছে। জনগণের সেই আগ্রহ-আকাক্সক্ষাকে কিভাবে দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় জায়গা দেয়া যায়, সেটা নিয়ে ভাবছে হাইকমান্ড। এতে আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নের ক্ষেত্রে চমক আসতে পারে। এর অংশ হিসেবে সারা দেশে শতাধিক আসনে তরুণ প্রার্থীদের অগ্রাধিকার দেয়া হতে পারে। বাদ যোতে পারেন দলটির পরিচিত অনেক হেভিওয়েট নেতা।
দলের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্র মতে, অতীতে বারবার নির্বাচন করেছেন এমন সিনিয়র নেতা কিন্তু এলাকায় অজনপ্রিয় হয়ে গেছেন এবং বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত থাকাসহ যাদের ভাবমর্যাদা সঙ্কটে রয়েছে- তাদের ব্যাপারে বিএনপি এবার কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে আগামী নির্বাচনে সারা দেশে তিন ডজনেরও বেশি হেভিওয়েট নেতা দলীয় মনোনয়ন নাও পেতে পারেন। এদের মধ্যে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির দুই-একজন নেতাও থাকতে পারেন। অনেককে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হলেও বিএনপি সরকার গঠন করলে তাদের মন্ত্রিসভায় রাখা নাও হতে পারে।
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে যে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন হবে, সেটা ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের তরফ থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশনা অনুযায়ী নির্বাচন কমিশনও (ইসি) নির্বাচনের সার্বিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে। এর ফলে রাজনীতিতেও এক ধরনের নির্বাচনী হওয়া বইছে। কয়েকটি রাজনৈতিক দল ইতোমধ্যে তাদের সম্ভাব্য প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে মাঠে রয়েছে। তবে বিএনপি এখন পর্যন্ত আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো আসনেই প্রার্থিতা চূড়ান্ত করেনি। যদিও দলের ভেতরে বিচ্ছিন্নভাবে কেউ কেউ ‘গ্রিন সিগন্যাল’ পেয়েছেন বলে দাবি করছেন। কিন্তু সেই সিদ্ধান্ত এখনো চূড়ান্ত নয় বলে দলীয় একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
জানা গেছে, আগামী নির্বাচনে বিভিন্ন আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী কে হতে পারেন, সেটা নিয়ে দলের ভেতরে কাজ চলছে। এর অংশ হিসেবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের তত্ত্বাবধানে ইতোমধ্যে একাধিক জরিপও করা হয়েছে। কাকে কোথায় প্রার্থী করলে জিতে আসতে পারে, একইসাথে পজিটিভ ইমেজ আছে- এগুলো বিবেচনা করে প্রার্থী চূড়ান্ত করার চিন্তা-ভাবনা করছে বিএনপি। ধারণা করা হচ্ছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগেই প্রাথমিক বাছাই শেষ করবে দলটি। আর তফসিল ঘোষণার পরপরই বিএনপি তাদের প্রার্থিতা চূড়ান্ত করবে।
অবশ্য নির্বাচন সামনে রেখে ইতোমধ্যে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থীরা মাঠ পর্যায়ে আছেন। যারা মনোনয়ন পেতে পারেন অথবা মনোনয়নপ্রত্যাশী, তারা নিজ নিজ এলাকায় সাংগঠনিক কার্যক্রম ব্যাপকভাবে বিস্তার করেছেন, গণসংযোগ অব্যাহত রেখেছেন। দল ঘোষিত রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের ৩১ দফাকেন্দ্রিক প্রচারণা চালাচ্ছেন। ঢাকাকেন্দ্রিক নেতারা শুক্র-শনিবার হলেই এলাকামুখী হচ্ছেন। আর যাদের ঢাকাকেন্দ্রিক রাজনীতিতে অংশগ্রহণ কম, তারা এলাকাতেই রয়েছেন। মানুষের মন জয়ে তারা নানা কর্মকাণ্ডে নিজেদের যুক্ত রেখেছেন। কোনো কোনো প্রার্থী বিভিন্নভাবে দলের হাইকমান্ডের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করছেন। কেউ কেউ লন্ডনেও যাচ্ছেন নিজের সম্ভাবনার কথা জানাতে। পাশাপাশি দলের বিভিন্ন পর্যায়েও যোগাযোগ বাড়ানোর চেষ্টা করছেন।
বিএনপি মনে করছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচন অত্যন্ত কঠিন হবে। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দলীয় বিভিন্ন ফোরাম এবং সাংগঠনিক কর্মসূচিতে একাধিকবার এ কথা বলেছেন। নেতাকর্মীদেরও সেভাবে সতর্ক থাকতে বলেছেন। একই সাথে ইতিবাচক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে মানুষের পাশে থেকে তাদের মন জয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। ভাবমর্যাদা অক্ষুণœ রাখতে ৫ আগস্টের পরে অপকর্মে জড়িত এবং সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙের দায়ে দল ও অঙ্গসংগঠনের চার হাজারের বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে বহিষ্কারসহ শাস্তিমূলক বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে বিএনপি। দলীয় একাধিক সূত্রে জানা গেছে, আগামী দিনে মনোনয়ন প্রক্রিয়ায়ও সেটা বজায় রাখা হবে। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এ ব্যাপারে অত্যন্ত কঠোর। বিতর্কিত কাউকেই তিনি প্রার্থী করতে চান না।
রাজনীতিতে সত্যিকার অর্থে তিনি গুণগত পরিবর্তন চান বলে বিএনপির দায়িত্বশীল নেতারা জানিয়েছেন।
বিএনপির কমিটমেন্ট রয়েছে, আগামীতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় গেলে তারা তাদের ৩১ দফা বাস্তবায়ন করবে। একই সাথে ফ্যাসিবাদবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের মিত্রদের নিয়ে জাতীয় সরকারও গঠন করবে। বিএনপির এই যে লক্ষ্য, তা পূরণে আগামী নির্বাচনে কারা মনোনয়ন পাচ্ছে, সেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দলের ভেতরে বিবেচিত হবে। এই কারণে বিএনপি ও বিএনপি জোটের যারা খুবই সম্ভাবনাময়ী এবং তরুণ, অন্যদের সাথে তাদের গুরুত্ব দিবে দল।
জানা গেছে, যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের সাথে আসন ভাগাভাগি নিয়ে এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো আলোচনা করেনি বিএনপি। তবে বিএনপির পক্ষ থেকে মিত্রদের নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে যে, তারা একসাথে নির্বাচন এবং বিজয়ী হলে সরকার গঠন করবে। সময় এলে তারা জোটবদ্ধ নির্বাচনের ঘোষণা দিবেন।
বিএনপির নির্বাচনী প্রস্তুতি প্রসঙ্গে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, বাংলাদেশ তো ইতোমধ্যে নির্বাচনের চ্যানেলে ঢুকে গেছে। সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছে। বিএনপি বড় রাজনৈতিক দল, স্বাভাবিকভাবে বিএনপিও তাদের মতো করে প্রস্তুতি নিচ্ছে।
দলীয় মনোনয়ন বিষয়ে তিনি বলেন, মনোনয়নের ব্যাপারটি প্রোগ্রেসেভলি (ক্রমান্বয়ে) হবে। এ ক্ষেত্রে স্বাভাবিকভাবেই দলীয় একটা প্রোসেস আছে, সেটার মধ্য দিয়ে এটি হবে। আর নির্বাচন কমিশন শিডিউল ঘোষণা করলে তখন এটা চূড়ান্ত হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির এই নীতিনির্ধারক বলেন, আজকের প্রেক্ষাপটে জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্য, সৎ, জনপ্রিয় এবং বিগত দিনগুলোতে আওয়ামী ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজপথের আন্দোলন-সংগ্রামে অবদান, সবকিছু মিলিয়ে মনোনয়নের বিষয়টি চূড়ান্ত হবে।