Hot

প্রিপেইডেও ভূতুড়ে বিল, বিপাকে লাখো বিদ্যুৎ গ্রাহক, মে-জুনে ভোগান্তি বাড়ে

চট্টগ্রামের সলিমপুরের গ্রাহক মশিউর রহমানের একাধিক মিটারে এপ্রিল মাসের বিদুৎ বিল আসে ৬ লাখ ৬৬ হাজার ৭২৮ টাকা। মে মাসে ওই বিল বেড়ে হয় ১৮ লাখ ৬৬ হাজার ৯৯০ টাকা। মশিউরের মতো এমন অস্বাভাবিক বিলের কবলে দেশের লাখ লাখ বিদ্যুৎ গ্রাহক। প্রতিবছর মে-জুন এলেই গ্রাহকরা এমন ভোগান্তিতে পড়েন। প্রিপেইড মিটারেও ঘটছে এমন ভূতুড়ে বিলের ঘটনা। গ্রাহকদের অভিযোগ, দুই মাস থেকে প্রিপেইড মিটারে অতিরিক্ত টাকা কাটা হচ্ছে। 

এ ছাড়াও প্রিপেইড মিটার নিয়ে গ্রাহকরা নানা অভিযোগ তুলছেন। সবচেয়ে বেশি অভিযোগ আসছে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির গ্রাহকদের কাছ থেকে। স্থানীয় বিদ্যুৎ অফিসে অভিযোগ জমছে। বিভিন্ন এলাকায় ক্ষুব্ধ গ্রাহকরা বিক্ষোভও করছেন। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত আদালতে গড়িয়েছে। অভিযোগ খতিয়ে দেখতে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। তবে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, প্রিপেইড মিটার নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে। 

দেশে বর্তমানে ছয় বিতরণ কোম্পানির বিদ্যুৎ গ্রাহক মোট ৪ কোটি ৭১ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ৫২ লাখ গ্রাহক প্রিপেইড মিটার ব্যবহার করেন। বাকিদের ক্রমান্বয়ে এর আওতায় আনার কাজ চলছে। বিতরণ কোম্পানিগুলো হলো– বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি), পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি (আরইবি), ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি), ঢাকা ইলেকট্রিক পাওয়ার কোম্পানি (ডেসকো), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন  কোম্পানি (ওজোপাডিকো) ও নর্দার্ন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো)। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) 
নির্দেশনা অনুযায়ী, বিতরণ পর্যায়ে গ্রাহককে ডিমান্ড চার্জ, মোট বিলের ৫ শতাংশ বিলম্ব মাশুল (বিলম্বে বিল পরিশোধ) এবং ১৫ শতাংশ মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) দিতে হয়। বিইআরসির অনুমোদন ছাড়া বিদ্যুৎ ব্যবহারের ওপর কোনো ধরনের চার্জ বা অর্থ আরোপ করার ক্ষমতা নেই বিতরণ কোম্পানির। অথচ দেশের ছয় বিতরণ কোম্পানি এমন সব খাতে গ্রাহকের কাছ থেকে অর্থ নিচ্ছে, যাতে বিইআরসির অনুমোদন নেই।
গত কয়েক দিন ঢাকার ডিপিডিসি ও ডেসকোর একাধিক আঞ্চলিক অফিস ঘুরে এবং অন্য জেলার বিতরণ কোম্পানির অফিসে খোঁজ নিয়ে বিলের বিষয়ে বেশ কিছু অভিযোগ পাওয়া যায়। যেমন– পোস্টপেইড মিটারে অতিরিক্ত বিল আসছে, দেরিতে বিল পাঠিয়ে জরিমানা নেওয়া হচ্ছে, প্রিপেইড মিটারে রিচার্জের পর আগের ব্যালান্স যোগ হচ্ছে না, বিদ্যুৎ ব্যবহারের তুলনায় বাড়তি টাকা কাটা হচ্ছে এবং অনেক সময় ব্যালান্স দেখা যাচ্ছে না। 

বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. হাবিবুর রহমান বলেন, ‘গ্রাহককে ভালো সেবা দিতেই প্রিপেইড মিটারের ব্যবস্থা। বিদ্যুতের এই মিটারে কোনো হিডেন চার্জ নেই। এটা নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি হচ্ছে।’  অতিরিক্ত বিলের অভিযোগ খতিয়ে দেখতে বিতরণ কোম্পানিগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ‘বিতরণ কোম্পানিগুলো প্রিপেইড বিলিং পদ্ধতির বিষয়ে গ্রাহকদের সচেতন করছে। শিগগির বাড়তি বিলের ভোগান্তি দূর হবে।’ 

প্রিপেইডে ভোগান্তি
ভোগান্তি কমানোর কথা বলে চালু করা বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটার এখন অনেক গ্রাহকের ‘গলার কাঁটা’য় পরিণত হয়েছে। তাদের অভিযোগ, দুই মাস ধরে মিটারে রিচার্জ করলে টাকা থাকছে না, বাড়তি টাকা কেটে নিচ্ছে কোম্পানিগুলো। রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকার ডিপিডিসির এক গ্রাহক জানান, মার্চে তাঁর প্রিপেইড মিটারে খরচ হয় ৭০০ টাকা, এপ্রিলে তা বেড়ে হয় ১ হাজার ২০০ টাকা এবং মে মাসে খরচ হয় ১ হাজার ৮০০ টাকা। অথচ এই তিন মাস বিদ্যুতের ব্যবহার একই রকম ছিল বলে দাবি তাঁর। শেওড়াপাড়ার এক গ্রাহক জানান, তাঁর প্রিপেইড মিটারে রিচার্জের সময় আগের ব্যালান্স যোগ হচ্ছে না।
প্রিপেইড মিটারের ব্যালান্স শেষ হয়ে গেলে জরুরি ব্যালান্স হিসেবে ২০০ টাকা নেওয়া যায়। এই টাকা ফেরত দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গ্রাহককে ৫০ টাকা সুদ হিসেবে দিতে হয়। অথচ বিইআরসির নির্দেশনা রয়েছে, জরুরি ব্যালান্সে কোনো সুদ নেওয়া যাবে না। 

তবে বেশি ভোগান্তি হচ্ছে রিচার্জে। আগে রিচার্জ করতে ২০ ডিজিট (সংখ্যা) মিটারে প্রবেশ করাতে হতো। কয়েক মাস ধরে ২২০ থেকে ২৪০টি ডিজিট মিটারে প্রবেশ করাতে হচ্ছে। একসঙ্গে এত ডিজিট প্রবেশ করাতে গিয়ে ভুল হচ্ছে। আর কয়েকবার ভুল হলে মিটার লক হয়ে যাচ্ছে। তখন দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎহীন থাকতে হচ্ছে গ্রাহককে। মিটার আনলক করতে অনেক এলাকায় টাকা দিতে হচ্ছে বলে অভিযোগ করছেন গ্রাহকরা। 

ডেসকোর এক নির্বাহী পরিচালক সমকালকে বলেন, ‘নিয়মের বাইরে বাড়তি টাকা নেওয়ার সুযোগ নেই। তবে বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাওয়া, স্ল্যাব পুনর্বিন্যাস ও গরমে ব্যবহার বাড়ায় বিল বেশি হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘৪০০ ইউনিট পর্যন্ত আবাসিকে প্রতি ইউনিট ৮ টাকার মতো, ৪০১ ইউনিট হলে তা সাড়ে ১২ টাকার ওপরে চলে যায়। এ কারণে মাসের মাঝখান থেকে বেশি টাকা কাটা শুরু করে। নিজে মিটার কিনলেও প্রতি মাসে মিটার ভাড়া কাটে বিতরণ কোম্পানিগুলো।’
পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির একাধিক কর্মকর্তার দাবি, আরইবিতে নিম্নমানের মিটার ব্যবহার হচ্ছে। তাই গ্রাহকদের টাকা বেশি কাটছে।

জেনে-বুঝেই বেশি বিল করা হয়!
জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জে চর ভবসুরে কুদ্দুস নামে এক গ্রাহকের মে মাসের বিল করা হয় ৬ জুন পর্যন্ত। বিলে সেদিন পর্যন্ত বিদ্যুতের ব্যবহার দেখানো হয় (মিটার রিডিং) ২৩৮৩৫। গ্রাহকের হাতে বিল আসার পর ১১ জুন মিটারে রিডিং দেখা যায় ২৩৬৯৪। যশোরের চৌগাছা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির গ্রাহক আবদুল্লাহ আল মামুনের ৬ জুন পর্যন্ত মিটার রিডিং ২১৯৭০ ধরে বিল করা হয়। কিন্তু ১৯ জুন তিনি মিটারে রিডিং দেখেন ২১৯৪১। এভাবে লাখ লাখ গ্রাহকের বিল উল্টাপাল্টা হচ্ছে। যারা অভিযোগ দেন, তাদের বিল অনেক ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ঠিক করে দেওয়া হয়। তবে অধিকাংশ গ্রাহক বিল যা আসে তাই পরিশোধ করেন। প্রতিবছর এপ্রিল-জুনে অভিযোগ বেশি আসে। 

পিডিবির সাবেক এক কর্মকর্তা বলেন, জুন ক্লোজিংয়ে আদায় বেশি দেখাতে বেশি রিডিং ধরে বিল করা হয়। পরে তা সমন্বয় করা হয়। কিন্তু বেশি ইউনিট ধরা হলে ওপরের স্ল্যাবে গিয়ে বিল বেশি আসে। এতে গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। 

২০২০ সালে দেশজুড়ে ভূতুড়ে বিলের অভিযোগ উঠলে বিদ্যুৎ বিভাগ তদন্ত কমিটি গঠন করে। ওই কমিটি অভিযোগের সত্যতা পেয়ে ছয় বিতরণ কোম্পানির ২৯০ জনকে শাস্তির সুপারিশ করে। সে সময় ডিপিডিসির জোন অফিসগুলোতে একটি চিঠি পাঠানোর তথ্য পাওয়া যায়। তাতে কত শতাংশ করে বিল বেশি ধরতে হবে, তা উল্লেখ ছিল। এ ঘটনা জানাজানি হলে কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে শাস্তি দেওয়া হয়। 

বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশ আদালতের 
প্রিপেইড মিটার নিয়ে অভিযোগ তদন্তে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। গত ১২ জুন বিচারপতি মো. মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি এস এম মাসুদ হোসেন দোলনের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেন। বিদ্যুতের প্রিপেইড মিটারের বিল আদায় ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা আনাসহ কয়েকটি নির্দেশনা চেয়ে গত ৬ জুন সুপ্রিম কোর্টের কয়েকজন আইনজীবীর পক্ষে রিট আবেদন করেন আব্দুল্লাহ আল হাদী। আবেদনে বলা হয়, প্রিপেইড বৈদ্যুতিক মিটার চালু থাকা সত্ত্বেও ভোক্তাদের অতিরিক্ত চার্জ ও গোপন চার্জ দিতে হয়। বিদ্যুতের বিল আদায় ব্যবস্থায় স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে। এসব বিষয় পর্যালোচনা ও সংস্কার প্রয়োজন।
পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করা হয়নি। তবে বিষয়টি নিয়ে বৈঠক হয়েছে; শিগগির আবার বসব। 

ক্ষুব্ধ গ্রাহকরা রাস্তায়
অস্বাভাবিক বিদ্যুৎ বিলের প্রতিবাদে গ্রাহকরা রাস্তায় নেমেছেন। গত দু-তিন মাসে দেশের নানা স্থানে বিক্ষোভ, বিদ্যুৎ অফিস ঘেরাও, মানববন্ধনসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন তারা। গত মঙ্গলবারও দেশের বিভিন্ন স্থানে কর্মসূচি পালিত হয়। এদিন নোয়াখালীর সুবর্ণচর নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন কমিটির আয়োজনে উপজেলা গোলচত্বরে ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন করেন পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির গ্রাহকরা। চাঁদপুর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-২-এর ফরিদগঞ্জ জোনাল অফিসের সামনে বিক্ষুব্ধ গ্রাহকরা মানববন্ধন করেন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto