Bangladesh

প্লট দখলের নয়া তরিকা

হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ উপেক্ষা করে ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তিকে অর্পিত সম্পত্তি দেখিয়ে চারটি বেসরকারি সংগঠনকে লিজ দেয়ার অভিযোগ উঠেছে ঢাকা জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে। সাড়ে ৩ কাঠা করে যে পাঁচটি প্লট লিজ দেয়া হয়েছে সেগুলো ইস্টার্ন হাউজিংয়ের আফতাব নগর হাউজিং প্রকল্পের। লিজ দেয়া প্রত্যেকটি প্লটই অনেক আগে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিদের কাছে বিক্রি করে দেয় হাউজিং কর্তৃপক্ষ। তবে হঠাৎ করেই জেলা প্রশাসন চারটি সংগঠনকে প্লটগুলো লিজ দিয়েছে। আর সংগঠনগুলো প্লট দখলে নিতে রাতের অন্ধকারে ইট-বালু, সিমেন্ট দিয়ে সীমানা প্রাচীর দিয়েছে। এখন তারা প্লটগুলো নিজস্ব লোকবল দিয়ে নজরদারি করাচ্ছেন। যাতে করে আর কেউ এসব প্লটে হস্তক্ষেপ করতে না পারে। যে চারটি সংগঠনকে লিজ দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো-পাবনা ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন, অভিনয়শিল্পী সংঘ, বাংলাদেশ আবৃত্তি পরিষদ ও জহির রায়হান চলচ্চিত্র পরিষদ। এ নিয়ে প্লট মালিক ও ভাড়াটিয়ার মধ্যে ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকের মনে আতঙ্কও বিরাজ করছে। 

সূত্রগুলো বলছে, ঢাকা জেলার বাড্ডা মৌজার ৩৮৯ খতিয়ান ও  ১৪৮৯ দাগের যে জমিকে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ‘ক’ তালিকাভুক্ত করা হয়েছে তার বিরুদ্ধে ইস্টার্ন হাউজিং কর্তৃপক্ষ ২০১২ সালে আদালতে মামলা করে।

বিজ্ঞাপন মামলার রায় তাদের পক্ষেই যায়। ফলে আইন অনুযায়ী জমির মালিক হাউজিং কর্তৃপক্ষ। পরে সরকার পক্ষ এ নিয়ে আপিল করে। আপিলের পর এটি এখন সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে আছে। প্রশ্ন উঠেছে, আইন অনুযায়ী হাউজিং কর্তৃপক্ষ মালিক হওয়া সত্ত্বেও এবং আপিলের রায়ের আগেই জেলা প্রশাসন এই জমিটি কীভাবে লিজ দেয়। এ ছাড়া এই জমি নিয়ে হাউজিং কর্তৃপক্ষ একটি রিট করে- যার নং-৪৭০৭/২০২৪। ওই রিটে হাইকোর্টের বিচারপতি মো. খসরুজ্জামান ও কেএম জাহিদ সারওয়ার জমির উপর ৬ মাসের স্থগিতাদেশ দেন। একদিকে মামলা চলমান অন্যদিকে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ রয়েছে। তার মধ্যেই জেলা প্রশাসন ওই জমি লিজ দেন। 

গত মাসের ২১শে এপ্রিল ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের অর্পিত সম্পত্তি শাখা থেকে সিনিয়র সহকারী কমিশনার ফারজানা আক্তার ও নাজির মিল্টন রায় স্বাক্ষরিত ডুপ্লিকেট কার্বন রসিদ (ডিসিআর) ইস্যু করা হয়। রসিদ নং-১৭৮৭৬৮। সেখানে উল্লেখ করা হয় ঢাকা জেলার বাড্ডা মৌজার খতিয়ান নং-৩৮৯, দাগ ১৪৮৯ জমির পরিমাণ ১১.৫৪ শতক। জমির সাবেক মালিক প্রহ্লাদ চন্দ্র মণ্ডল গং। তাকে ভারতীয় নাগরিক হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। বর্তমানে জমিটির ইজারাদার মো. সেলিম রেজা। তিনি পাবনা ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক। এ ছাড়া তিনি মানবাধিকার কমিশনের সদস্য। এর আগে তিনি রেল সচিব ছিলেন। ওই  রসিদে বাংলা ১৪২৫ সাল থেকে ১৪৩০ সাল পর্যন্ত লিজমানি হিসেবে ৩৮ হাজার ৭৭৪ টাকার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়।

কী ঘটেছিল সেদিন: চলতি মাসের ৩ তারিখ শুক্রবার। সময় তখন সকাল ৯টা থেকে সাড়ে নয়টা হবে। ছুটির দিন থাকায় আফতাব নগরের বাসিন্দাদের অনেকেই ঘুম থেকে উঠেননি। আবার কেউ কেউ সকালের নাস্তা করছিলেন। ঠিক তখনই ইস্টার্ন হাউজিংয়ের আফতাব নগর প্রকল্পের সি ব্লকের ২ ও ৩ নং সড়ক ও আশেপাশের রাস্তায় একে একে সরকারি স্টিকার সংবলিত দামি দামি গাড়ি আসতে থাকে। এসব গাড়িতে সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের কর্তারা আসেন। তাদের সঙ্গে পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের দেখা যায়। তারপর গাড়ি থেকে নামতে থাকেন সরকারের বর্তমান সাবেক কয়েকজন সচিব, ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার ও অতিরিক্ত সচিব, অতিরিক্ত আইজিপি, ডিআইজি, জেলা প্রশাসক ঢাকা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব), সহকারী কমিশনার (ভূমি) সরকারের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবীরা। এর বাইরে বেসরকারি চাকরিজীবী, অভিনয়-আবৃত্তিশিল্পীসহ বেসামরিক বিভিন্ন পর্যায়ের লোক সমাগম হয়। উপস্থিত বেশির ভাগ ব্যক্তির বাড়ি পাবনায়। সরকারের বড় বড় কর্তাদের আগমনে পুরো এলাকা সুনসান নীরব ছিল কয়েক ঘণ্টার জন্য। তাদের উপস্থিতির কারণ অনেকেই প্রথমে ভেবে বুঝে উঠতে পারেননি। অবশ্য সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সবার কাছে বিষয়টি পরিষ্কার হয়। মূলত এসব কর্মকর্তার কেউ কেউ আসেন লিজগ্রহীতা চারটি সংগঠনকে প্লটের দখল দেয়ার জন্য। আবার কর্মকর্তাদের কেউ কেউ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত থাকায় তারা দখল বুঝে নেয়ার জন্য আসেন। লিজদাতা ও লিজগ্রহীতাদের অনেকেই পাবনা ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের সঙ্গে জড়িত। 
পুলিশের একটি সূত্র বলছে, প্লটগুলোতে সাইনবোর্ড স্থাপন করে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য ছুটির দিন সবাই উপস্থিত হন। বিষয়টি সিভিল মেটার হওয়ায় জেলা প্রশাসনও পুলিশের সহযোগিতা চায়নি। তাই থানা পুলিশ খবর পেয়ে সেখানে উপস্থিত হলেও তারা কোনো ধরনের হস্তক্ষেপ করেনি। ইস্টার্ন হাউজিং কর্তৃপক্ষ ঘটনাস্থলে হাইকোর্টের রিট পিটিশন নং-৪৭০৭/২০২৪ সংক্রান্ত সুপ্রিম কোর্টের এডভোকেট কাজী এখলাছুর রহমান স্বাক্ষরিত একটি ল’ ইয়ার সার্টিফিকেট থানায় দাখিল করেন। সেটাতে এই জমির উপর ৬ মাসের স্থগিতাদেশের বিষয়টি উল্লেখ ছিল। পুলিশের ওই সূত্রটি বলছে, ৩রা মে দিবাগত রাত সাড়ে ১২টার দিকে প্লটগুলোতে বাউন্ডারি নির্মাণের উদ্দেশ্যে ৭ থেকে ৮টি ট্রাকে নির্মাণসামগ্রী নিয়ে প্রবেশ করতে চায় লিজগ্রহীতারা। এসময় ইস্টার্ন হাউজিং কর্তৃপক্ষ বাধা দেয়। এতে করে দুই পক্ষের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। তখন থানা পুলিশ হস্তক্ষেপ করে উত্তেজনা প্রশমিত করে। এ ঘটনায় ইস্টার্ন হাউজিংয়ের কর্মকর্তা মো. সহিদুল ইসলাম (৪৮) বাড্ডা থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন। জিডি নং-২০৭, তারিখ ৩রা মে ২০২৪। সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, হাইকোর্টের স্থিতিবস্থা থাকা সত্ত্বেও ওই জমিতে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করার পাঁয়তারা করছে। সেই পাঁয়তারা কারা করছে সেটি জিডিতে উল্লেখ নাই। 

ইস্টার্ন হাউজিং কর্তৃপক্ষ ও আফতাব নগর হাউজিং সোসাইটি সূত্রে জানা গেছে, পাবনা ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনকে আফতাব নগরের সি ব্লকের ৩ নম্বর রোডের ২৫ ও ২৭ নম্বর প্লট দুটি লিজ দিয়েছে ঢাকা জেলা প্রশাসন। এর পাশের একটি প্লটের পরে ৩১ নম্বর প্লট লিজ দেয়া হয়েছে বাংলাদেশ আবৃত্তিশিল্পী সংসদকে। একই ব্লকের ২ নং সড়কে ২৮ নম্বর প্লট জহির রায়হান চলচ্চিত্র সংসদ ও ৩২ নম্বর প্লট অভিনয় শিল্পী সংঘকে লিজ দেয়া হয়েছে। প্রতিটি প্লটেই সাড়ে ৩ কাঠা করে জমি আছে। এরমধ্যে ২৫ নম্বর প্লটের মালিক মতিঝিল এলাকার কাজী ফারুক মোহাম্মদ গোলাম কবীর। ২৭ নম্বর প্লটের মালিক বনশ্রীর বাসিন্দা প্রবাসী মোহাম্মদ আব্দুল আজিজ খান। ২৮ নম্বর প্লটের মালিক মো. মোকসেদ আলী। এক সময় প্লটটির মালিকানা ছিল শাহআলম খানের। পরে তিনি সেটি তার ভগ্নিপতিকে দেন। ৩১ নম্বর প্লটের মালিক ৫ জন। তারা হলেন- শিরীন আক্তার হোসেন, মো. ইবনে মাসুদ হোসেন, মো. আমানুল হোসেন উজ্জ্বল, আসমা আক্তার শিমু ও তাহমিনা খাতুন। ৩২ নম্বরের মালিক কাজী এনায়েত হোসেন। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, প্রতিটি সাড়ে ৩ কাঠা করে ৫টি প্লটে সাড়ে ১৭ কাঠা জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। বাজারমূল্য অনুযায়ী প্রতি কাঠা জমির দাম কোটি টাকা। সেই হিসাবে অন্তত ২০ কোটি টাকার জমি লিজ দিয়েছে জেলা প্রশাসন। 

সরজমিন দেখা যায়, প্রতিটি প্লটেই সাইনবোর্ড টানিয়ে লেখা আছে এই জমিটি সরকারি অর্পিত সম্পত্তি। যার মালিক সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসক ঢাকা। ভিপি কেস নং ১৫৪/১৯৬৮। মৌজা বাড্ডা, খতিয়ান ৩৮৯, দাগ ১৪৮৯ জমির পরিমাণ ১.৬৭ একর। তার পাশাপাশি যে চারটি সংগঠনকে প্লট লিজ দেয়া হয়েছে তাদের নিজস্ব একটি সাইনবোর্ড ঝুলছে। এসব প্লটে সাম্প্রতিক সময়ে ইটের বাউন্ডারি দেয়া হয়েছে। আশেপাশে ৭ তলা, ৮ তলা উচ্চতার কয়েকটি ভবন রয়েছে। এর বাইরে অধিকাংশ প্লট ফাঁকা। স্থানীয় সূত্রগুলো বলছে, গত বছরের অক্টোবর মাসে ভূমি অফিস থেকে একটি সাইনবোর্ড সেখানে ঝুলিয়ে মামলা চলার কথা উল্লেখ করে। আর ৩রা মে থেকে জেলা প্রশাসন এটিকে অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে উল্লেখ করে সাইনবোর্ড ঝুলায়।

ইস্টার্ন হাউজিং ও প্লট মালিকরা জানিয়েছেন, ১৯৮৬ সালের আগ পর্যন্ত বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মালিকের কাছ থেকে জমি কিনে নেয় হাউজিং কর্তৃপক্ষ। এরমধ্যে ৩৮৯ খতিয়ানের ১৪৮৯ দাগের জমি কিনে প্রহ্লাদ চন্দ্র মণ্ডল ও তার উত্তরসূরিদের কাছ থেকে। ওই দাগে ১.৬৭ একর জমি ছিল। পরে প্লট করে এসব জমি হাউজিং কর্তৃপক্ষ বিক্রি করে দেয়। যারা এসব জমি কিনেছেন তারা সরকারকে খাজনা দিয়েছেন। আগে ইস্টার্ন হাউজিংয়ের নামে নামজারি ছিল এবং তারা খাজনা দিতেন। এখন প্লটের মালিকদের নামে নামজারি। খাজনাও তারা দেন। ২০১০ সালের দিকে প্রহ্লাদ চন্দ্র মণ্ডল ভারতীয় নাগরিক বলে আলোচনা উঠে। তখন ইস্টার্ন হাউজিং এ নিয়ে একটি মামলা করে। ওই মামলায় হাউজিং কর্তৃপক্ষ মামলার রায় পায়। প্রমাণিত হয় প্রহ্লাদ বাংলাদেশি নাগরিক। কিন্তু ২০১২ সালে ওই সম্পত্তিকে ‘ক’ তালিকাভুক্ত করে সরকার। পরে ইস্টার্ন হাউজিংও মামলা করে। মামলায় হাউজিং জিতে গেলে সরকার পক্ষ আপিল করে। সেই আপিল এখন শুনানি পর্যায়ে আছে। 

কেন অর্পিত সম্পত্তি নয়: চারটি সংগঠনকে লিজ দেয়া প্লটগুলোকে জেলা প্রশাসন অর্পিত সম্পত্তি বলছে। কিন্তু বাস্তবে এই সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি নয় বলে বেশ কিছু প্রমাণ মানবজমিনের কাছে এসেছে। তার একটি হলো-পাবনা ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনকে যে দুটি জমি জেলা প্রশাসন লিজ দিয়েছে তার একটি ২৭ নম্বর নম্বর প্লট। এই প্লটটি ইস্টার্ন হাউজিং থেকে কিনেছেন আমেরিকা প্রবাসী মো. আব্দুল আজিজ খান ও জাহিদুল ইসলাম খান। যখন তারা তাদের প্লটটি অর্পিত সম্পত্তি নথিভুক্ত করা হয়েছে এমনটি জানতে পারেন তখন তিনি একটি মামলা করেন। অর্পিত সম্পত্তি ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তি হওয়া ওই মামলা নং ৩০৫৫/২০১৩। ওই মামলার রায় তাদের পক্ষেই আসে।  মামলায় বিবাদী করা হয় জেলা প্রশাসক ঢাকা, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) তেজগাঁও সার্কেলকে। মামলায় বাদী অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ আইনের বিধান অনুসারে ঢাকা জেলার বাড্ডা মৌজার ১৪৮৯ দাগের ১.৬৭ একরের মধ্যে সাড়ে ৩ কাঠা জমি অবমুক্তি ও প্রত্যর্পণের আদেশ ডিক্রির প্রার্থনা করেন। মামলায় জমিটি ঠিকানা ইস্টার্ন হাউজিংয়ের আফতাব নগর প্রকল্পের সি ব্লকের ৩ নং রোডে থাকার কথা উল্লেখ করা হয়। ২০১৫ সালের ৩০শে এপ্রিল এই মামলাটির রায় দেন ১ম আদালতের সিনিয়র সহকারী জজ বেগম কানিজ ফাতিমা। আদালত মামলার ডিক্রিতে বলেন, দরখাস্তের তফসিলে বর্ণিত সম্পত্তি অর্পিত নয় বিধায় ‘ক’ তালিকা থেকে অবমুক্তির আদেশ দেয়া হলো। অবগতি ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রায় ও ডিক্রির অনুলিপি জেলা প্রশাসক ঢাকার কাছে পাঠানোর নির্দেশ দেন বিচারক। ওই মামলার রায়ের বিপক্ষে আপিল করে সরকার পক্ষ। পরে অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ এস এম সাইফুল ইসলাম শুনানি শেষে আপিলের রায় দেন। ওই রায়ে বলেন, ‘অর্পিত সম্পত্তি আপিল মামলাটি বাদী রেসপনডেন্ট পক্ষের সহিত দোতরফা সূত্রে বিনা খরচায় নামঞ্জুর করা হলো। বিজ্ঞ অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক ৩০৫৫/২০১৩  নং অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ মামলায় প্রদত্ত ২০১৫ সালের ৩০শে এপ্রিলের রায় ও ২০১৫ সালের ৫ই মে তারিখে ডিক্রি বহাল ও বলবৎ  রাখা হলো। আদালতের দুইবারের রায়ে ওই দাগের জমি অর্পিত সম্পত্তি নয় বলে প্রমাণিত হয়েছে। এ ছাড়া প্রহ্লাদ চন্দ্র মণ্ডলকে ভারতীয় নাগরিক এমন আলোচনার পর ইস্টার্ন হাউজিং যে মামলা করে সেই মামলায় ২০১০ সালের রায়ে প্রহ্লাদ মণ্ডল বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে প্রমাণিত হন। সেই হিসেবেও এই সম্পত্তি অর্পিত সম্পত্তি নয়। এ ছাড়া ইস্টার্ন হাউজিংও জোর দাবি জানিয়েছে এটি অর্পিত সম্পত্তি নয়। তারা এটি ন্যায্যমূল্য দিয়ে কিনে নিয়েছে। প্রহ্লাদ যার কাছ থেকে জমি কিনেছেন সেই দলিলও তিনি বিক্রির সময় সরবরাহ করেছেন। জমি নিয়ে মামলা চলমান আছে। সাম্প্রতিক সময়ে আদালত যে স্থগিতাদেশ দিয়েছেন সেখানেও সেই মামলার নং (৭৭৮/২০১২) কথা উল্লেখ করেছেন।  

প্লট মালিক সমিতির পক্ষে জুবায়ের ফেরদৌস বলেন, ৩রা মে সকাল ৯টার দিকে আমাদের এক প্লট মালিক সি ব্লকের ওই রোডে অনেক মানুষের সমাগম দেখতে পেয়ে আমাকে জানান। পরে আমিও অন্য মালিকদের সঙ্গে কথা বলি। সাড়ে ৯টার দিকে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হই। প্রায় ৩০টির মতো গাড়ি সেখানে আসে। বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক, এডিসিসহ উচ্চপদস্থ অনেক কর্মকর্তা, অভিনয়শিল্পীসহ অনেক লোকের সমাগম হয়। ইস্টার্ন হাউজিং থেকে উচ্চপদস্থ কেউ তখনো আসেননি। আমি সাইট ইনচার্জের সঙ্গে যোগাযোগ করে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের কপি মোবাইল ফোনে এনে জেলা প্রশাসককে দেখাই। কিন্তু তিনি কাগজ না দেখেই পরবর্তী কর্মদিবস রোববারে তার অফিসে যোগাযোগের জন্য বলেন। আমি থানার ওসি’র কাছে বিষয়টি জানতে চাইলে তিনিও তেমন কিছু জানেন না বলে জানান। এটি তার এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। পরে ওই চারটি সংগঠনের কাছে প্লট হস্তান্তর করা হয়। দোয়া করে তারা ছবি তুলেন। পরেই তারা প্লটের চারপাশে বাউন্ডারি দেয়ার তোড়জোড় শুরু করেন। ইট- বালু, সিমেন্ট ও মিস্ত্রি এনে সিনেমার স্টাইলে কাজ শুরু করেন। আমরা প্লট মালিকরা চিল্লাচিল্লি শুরু করলে সেখান থেকে সরকারি কর্মকর্তারা চলে যান। এভাবে পুরো বিকাল ও রাতের বেলা গানবাজনা বাজিয়ে এলাকা উত্তপ্ত করে তারা বাউন্ডারির কাজ করেন। প্রতিটি প্লটের জন্য এখন পেশিশক্তি প্রদর্শন করার মতো লোক ঠিক করা হয়েছে। তাদেরকে সামনে রেখে রাতারাতি সীমানা দেয়া হয়েছে।  

২৮ নম্বর প্লটের মালিক মোকসেদ আলী মানবজমিনকে বলেন, এটা আমাদের কেনা প্লট। নামজারি আছে, হাইকোর্টের স্থগিতাদেশও আছে। আর এটা অর্পিত সম্পত্তি না। ২০১২ সালে জমিটি ‘ক’ তালিকাভুক্ত করা হয়। এই জমিটি যার ছিল তিনি সনাতন ধর্মালম্বী ছিলেন। তিনিও যার কাছ থেকে জমি কিনেছেন সেই দলিলও আমাদের দিয়েছেন। ‘ক’ তালিকায় দেয়ার পর ইস্টার্ন হাউজিং সঙ্গে সঙ্গে মামলা করে জিতে যায়। পরে সরকার পক্ষ আপিল করেছে। মামলাটি সাক্ষী পর্যায়ে আছে। লিজ দেয়ার পাঁয়তারা চলছে জেনে ইস্টার্ন হাউজিং স্থগিতাদেশও চায়। কেউ যদি আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল না হয় তাহলে তো কিছু করার নাই। ইস্টার্ন হাউজিংয়ের সাইট ইনচার্জও ওইদিন সেখানে উপস্থিত কর্মকর্তাদের বলেছেন, আইনের লোক হয়ে আপনারা আইন মানেন না। গায়ের জোরে কাজ করছেন। মানবাধিকার কমিশনেরও একজন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তাকেও বলা হয়েছে এখানে মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে। কারণ এই সম্পত্তি কেনা সম্পত্তি। তিনি বলেন, ওইদিন বিভাগীয় কমিশনারকে আমরা এ বিষয়ে বলেছিলাম। তিনি বলেছেন, আমাদের বক্তব্য পরে শুনবেন। আপাতত ইস্টার্ন হাউজিংয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য।  

বাড্ডা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ ইয়াসীন গাজী বলেন, ইস্টার্ন হাউজিং বলছে এই জমির উপর স্থগিতাদেশ আছে। চারজনকে বিবাদী করা হয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব, জেলা প্রশাসক, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রেভিনিউ) ও সহকারী কমিশনার (ভূমি)। এ নিয়ে কোর্টের একটি নির্দেশনা আছে। এখানে থানা পুলিশের করণীয় কিছু নাই। কোর্ট আমাদেরকে কোনো নির্দেশনা দেননি। শুনেছি সরকার পক্ষ এসব প্লট লিজ দিয়েছেন। কিন্তু এ সংক্রান্ত কোনো কাগজ কোনো পক্ষই আমাদেরকে দেখায়নি। সবকিছুই জেলা প্রশাসকের অধীনে। লিজ দিয়ে থাকলেও এটার অথরিটি তিনি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদেরকে ওইদিন কিছু্‌ বলা হয়নি। থানার টহল টিম জানতে পারে সেখানে সিনিয়র স্যাররা এসেছেন পরে তারা সেখানে যান।  কোনো কার্যক্রমে আমাদের ইনভলব হওয়ার সুযোগ ছিল না।  

ইস্টার্ন হাউজিংয়ের আফতাব নগর প্রকল্পের অপারেটিভ ডাইরেক্টর ও সাইট ইনচার্জ অবসরপ্রাপ্ত মেজর আলতামাস করিম বলেন, ১৯৮৬ সাল থেকে এসব জমির মালিক ইস্টার্ন হাউজিং। প্রতিটি প্লটই আমরা বিক্রি করে দিয়েছি। ১৪৮৯ দাগের জমি নিয়ে মামলা চলছে। হাইকোর্ট থেকে ৬ মাসের স্থগিতাদেশ আছে। কিন্তু হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের তোয়াক্কা না করে ৪টি প্লটে সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে বাউন্ডারি দেয়া হয়েছে। প্রথমদিন আমি উপস্থিত ছিলাম না। দ্বিতীয় দিন সেখানে যারা উপস্থিত ছিলেন তাদেরকে আমি আমাদের কাছে থাকা বৈধ কাগজপত্র দেখার জন্য অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তারা দেখতে চাননি। থানায় একটা জিডি করে রাখা হয়েছে। এখন প্লটের মালিকরাও আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button