Hot

ফসল রক্ষার নামে লুটপাট, তিন প্রকৌশলীর গোপন সমঝোতায় গচ্চা ৫শ কোটি টাকা

হাওড়াঞ্চলে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে ব্যয়বহুল কাজ নির্ধারিত সময়ে সম্পন্ন করা যাবে না। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে প্রায় প্রতিদিনই এই অঞ্চলে পানি বাড়ছে। ইতোমধ্যে হাওড়াঞ্চলে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। এই মুহূর্তে কাজের অগ্রগতি খুবই সামান্য। অথচ ব্যয়বহুল এই কাজ শেষ করতে সময় নির্ধারণ করা হয়েছে জুনের মাঝামাঝিতে। যখন বর্ষার পানিতে হাওড় থাকবে পানির নিচে। এসব বিষয় পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে অবগত আছেন পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়সহ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরাও। এরপরও ৬শ কোটি বরাদ্দ নিয়ে ঠিকাদারদের প্রায় ৫শ কোটি টাকার কাজের কার্যাদেশ দিয়েছে পাউবো। সময় বেঁধে দেওয়ায় তড়িঘড়ি করে কাজ সম্পন্ন করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে নিশ্চিত হচ্ছে না কাজের গুণগত মান। নিম্নমানের কাজ করেই বিল তুলতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন ঠিকাদাররা। এরই মধ্যে প্রায় সাড়ে তিনশ কোটি টাকার বিল উত্তোলন করা হয়েছে। নির্বিঘ্নভাবে বিল দেওয়ার নেপথ্যে রয়েছেন তিন প্রকৌশলী। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সরকারের এই পুরো অর্থই গচ্চা যেতে পারে-এমন আশঙ্কা সংশ্লিষ্টদের।

তাদের আরও অভিমত-চলমান এই প্রকল্প নিয়ে এখন হাওড়াঞ্চলে রীতিমতো হইচই শুরু হয়েছে। কাজ বাস্তবায়নের নামে বিপুল অঙ্কের এই টাকার অধিকাংশই ভাগাভাগি হচ্ছে। বন্যা ব্যবস্থাপনা পুনর্গঠন জরুরি সহায়তা প্রকল্পের (এফআরইএপি) আওতায় এই কাজ বাস্তবায়ন করছে পাউবো। শুধু তাই নয়, যেসব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করছে তাদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে মামলাও আছে। যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে উঠে এসেছে দুর্নীতির এমন ভয়াবহ চিত্র।

অনুসন্ধানে আরও জানা গেছে, বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, রেগুলেটর বা স্লুইসগেট নির্মাণ, ডুবন্ত বাঁধ সিসিব্লক দ্বারা সুরক্ষিত করা এবং ফ্লাড ফিউজ নির্মাণের নামে এই টাকা বরাদ্দ নেওয়া হয়। এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) ও সরকারের যৌথ অর্থায়নে এই কাজ পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু এসব কাজ শেষ করতে যে সময়ের প্রয়োজন হয় দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া ও পানির কারণে হাওড়াঞ্চলে তা সম্ভব হয় না। যে কারণে সরকার পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পিআইসি (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) গঠন করে প্রতিবছর স্থানীয় কৃষকের সমম্বয়ে খণ্ডকালীন বাঁধ নির্মাণ করে একমাত্র বোরো ফসল রক্ষার চেষ্টা করে। ২০১৭ সালে অকাল বন্যায় ফসল তলিয়ে যাওয়ার পর থেকে সরকার এই ব্যবস্থা করে আসছে। পাউবোর চলমান ৩৬টি প্রকল্পের কাজের বাইরে পিআইসির মাধ্যমে এবার ১২৬ কোটি টাকা খরচ ধরা হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে অতিরিক্ত ৫শ কোটি টাকার কাজ শেষ করা যাবে না জেনেও পাউবোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নিজেদের স্বার্থে ব্যয়বহুল এই প্রকল্প নিয়ে ঠিকাদার নিয়োগ করেছেন। জানা গেছে, উল্লিখিত বিল পরিশোধের নেপথ্যে যে তিন প্রকৌশলী রয়েছেন, তারা হলেন-পাউবো সিলেটের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম, সুনামগঞ্জ ডিভিশন-১ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার এবং ডিভিশন ২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী ইমদাদুল হক। মোটা অঙ্কের টাকার কমিশন নিজেদের মধ্যে এই তিনজন ভাগাভাগি করছেন-এমন অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্টরা। এমনকি তড়িঘড়ির এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে যে দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে, সেখানেও কাজ পাইয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে রয়েছে লেনদেনের অভিযোগ।

জানতে চাইলে পাউবোর সুনামগঞ্জের ডিভিশন ২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী ইমদাদুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘প্রকল্পের কিছু কিছু জায়গায় ঠিকাদাররা নিম্নমানের মালামাল ব্যবহার করায় সেগুলো ফেরত পাঠানো হয়েছে। এভাবে কিছু সময় নষ্ট হয়েছে। এ ছাড়া দুর্যোগপূর্ণ নানান কারণে নির্ধারিত সময়ের (আগামী জুন) মধ্যে কাজ শেষ না হওয়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। এ কারণে আগামী মার্চ পর্যন্ত প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। ঠিকাদার নিজ উদ্যোগে প্রকল্পের কাজ শেষ করবেন। বর্ষায় মাটি ধুয়ে গেলেও সেখানে ঠিকাদারের ভেরিয়েশনের (অতিরিক্ত বরাদ্দ) সুযোগ থাকবে না। দিরাই ও শাল্লায় ৪টি প্রকল্পে ঠিকাদারের সঙ্গে আপনাদের (তিন প্রকৌশলী) মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে গোপন সমঝোতা হয়েছে-এমন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অভিযোগটি সঠিক নয়।’

জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালক একেএম তাহমিদুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘কর্মকর্তা ও ঠিকাদারদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেলে কঠিন শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে। কোনো ধরনের অভিযোগ সহ্য করা হবে না। অবশ্যই উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে কাজ বাস্তবায়ন, বিল পরিশোধের বিষয়টি তদন্ত করে প্রকৃত চিত্র বের করার চেষ্টা করা হবে।’ তিনি বলেন, দরপত্রে কোনো ধরনের শৈথিল্যতা আছে কিনা তাও তদন্ত হবে। রাষ্ট্রের টাকা এভাবে অপচয় হতে দেওয়া হবে না।’

অনুসন্ধানে জানা গেছে, জেলার দিরাই ও শাল্লা উপজেলায় ৪টি প্রকল্পে প্রায় ৮০ কোটি টাকার কাজ বাস্তবায়ন করছেন আজাদ হোসেন। তিনি জেলার তাহিরপুর উপজেলার বালিজুরী ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও বাংলাদেশ স্থলবন্দর শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক। জেলা আওয়ামী লীগের নেতাও তিনি। সড়ক ও জনপথের একটি কাজ পান সিলেটে শফিকুল ইসলাম নামে এক ঠিকাদার। তাকে একটি আবাসিক হোটেলে ডেকে নিয়ে যান আজাদ। এ সময় সুনামগঞ্জ ও সিলেটের বিএনপির একাধিক উচ্ছৃঙ্খল নেতাকর্মী এই আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে ছিলেন। প্রায় ৯০ কোটি টাকার ওই কাজ শফিকের কাছ থেকে জোরপূর্বক স্ট্যাম্পে লিখে নিতে চেয়েছিলেন তিনি। সম্প্রতি রাজধানীর শান্তিনগর থেকে আজাদ হোসেনকে গ্রেফতার করে ডিবির একটি দল।

জানা যায়, সুনামগঞ্জে তিনি ‘বালুখেকো আজাদ’ হিসাবে পরিচিত। বিগত আওয়ামী লীগের ১৫ বছরের শাসনামলে ক্ষমতার প্রভাব দেখিয়ে অবৈধভাবে জাদুকাটা নদী থেকে বালু উত্তোলন করে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। অবৈধ টাকার প্রভাবে নৌকা প্রতীক নিয়ে হয়েছেন ইউপি চেয়ারম্যানও। অথচ এই প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা নিজের নাম-পরিচয় গোপন রেখে মোটা অঙ্কের এই কাজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিয়েছেন। তাকে সহযোগিতা করেছেন পাউবোর সুনামগঞ্জের ডিভিশন ২-এর নির্বাহী প্রকৌশলী ইমদাদুল হক। এই কাজের দরপত্রে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নোনা ট্রেডার্স এককভাবে দুটিতে এবং নোনা ও আহাদ যৌথভাবে দুটি কাজে অংশ নেয়। এই চারটি প্রকল্পে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৭৬ কোটি টাকা। এসব কাজে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র অংশগ্রহণ হয়নি। মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে একক দরদাতাকে সমঝোতার ভিত্তিতে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। নথিপত্রে নোনা ট্রেডার্স অংশ নিলেও কাজটি বাস্তবায়ন করছেন গ্রেফতারকৃত আওয়ামী লীগ নেতা আজাদ হোসেন। তার অবর্তমানে স্থানীয়ভাবে কাজ মনিটরিং করছেন আজাদ হোসেনের প্রতিনিধি ভজন তালুকদার। তিনিও স্থানীয় আওয়ামী লীগের পরিচয়ে প্রভাবশালী ঠিকাদার হিসাবে পরিচিত।

পাউবোর সুনামগঞ্জের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, ‘কাজের বাস্তব অবস্থার চেয়ে বিল দেওয়া হয়েছে অনেক বেশি। জুনের মধ্যে সময়সীমা নির্ধারিত থাকায় টাকা ছাড় দেওয়া হচ্ছে বেশি। বিষয়টি সরাসরি দুর্নীতি। এই বিল প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত সিলেটের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী শফিকুল ইসলামসহ সুনামগঞ্জের দুই নির্বাহী প্রকৌশলী। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের উচিত হবে জরুরি ভিত্তিতে এই টাকা পরিশোধ বন্ধ করে সরেজমিন কাজের বাস্তব অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা। এছাড়া যেসব খাতে প্রকল্প চূড়ান্ত করা হয়েছে সেগুলোও পর্যবেক্ষণ করা। কারণ হাওড় রক্ষা বাঁধের বাইরে কেন ব্যয়বহুল এসব কাজ করা হচ্ছে তা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের বাইরে রেখে তদন্ত করতে হবে।’

সরেজমিন ঘুরে এবং দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শাল্লা উপজেলায় দুটি কাজ ৫৫ ভাগ অগ্রগতি দেখানো হয়েছে। বাস্তবে ৩০ ভাগও সম্পন্ন হয়নি। এছাড়া দিরাই উপজেলায় দুটি কাজের ক্ষেত্রে অগ্রগতি দেখানো হয়েছে ৪১ ভাগ। বাস্তবে এই কাজ ২৫ ভাগও হয়নি। এই চার প্যাকেজে যে পরিমাণ কাজ হয়েছে তার চেয়ে বেশি বিল উত্তোলন করা হয়েছে। এই চারটি কাজ থেকে অবৈধ সুবিধা নিয়ে নিম্নমানের মালামাল ব্যবহার করার অভিযোগ আছে। কাজের বাস্তব অগ্রগতি চলমান ৩৬টি প্রকল্পেই।

নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, ৩৬টি কাজের মধ্যে দরপত্রে প্রতিযোগিতামূলক অংশগ্রহণ হয়েছে ৩২টিতে। দিরাই-শাল্লার ৪টি কাজে একজন (নোনা ট্রেডার্স) করে দরদাতা অংশগ্রহণ করে। এই একক দরদাতাকেই ৩০ ভাগ কম দরে কার্যাদেশ দেওয়া হয়। এ কারণে প্রায় ১০ কোটি টাকা সরকারের ক্ষতি হয়।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সিলেটের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের পিডি শফিকুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, ‘ইজিপি দরপত্রে পক্ষপাতিত্ব করার কোনো সুযোগ নেই। যথাযথ নিয়ম মেনেই দরপত্র আহ্বান করা হয়। ৩২টি কাজে কয়েকজন করে অংশ নিলেও এই চারটি কাজে কেন একজন অংশ নিলেন তা বুঝতে পারছি না।’

তিনি বলেন, ‘আসন্ন বর্ষার আগে চলমান প্রকল্পের কাজ শেষ করা যাবে না এটা ঠিক। তাহলে এবারের বর্ষার পর অসমাপ্ত কাজ আগামী বছর টিকবে কিনা-জানতে চাইলে এই প্রকৌশলী বলেন, ‘টিকে না থাকার আশঙ্কাই বেশি।’ তাহলে আগামী বছর নতুন করে আবার এই কাজের বিপরীতে টাকা বরাদ্দ নেওয়া হবে কিনা-এমন প্রশ্নে এই প্রকৌশলী সরাসরি কোনো জবাব না দিয়ে বলেন, ‘ভুল-ত্রুটি হলে সংশোধনের সুযোগ দেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ভজন তালুকদার মূল ঠিকাদারের পক্ষে কাজ করছেন। আজাদ হোসেনের সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই।’

এদিকে উল্লিখিত অভিযোগের বিষয়ে মন্তব্য নিতে সোমবার ভজন তালুকদারের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হয়। কিন্তু তার সেলফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button
bacan4d toto
bacan4d toto
Toto Slot
slot gacor
slot gacor
slot toto
Bacan4d Login
bacan4drtp
situs bacan4d
Bacan4d
slot dana
slot bacan4d
bacan4d togel
bacan4d game
slot gacor
bacan4d login
bacantoto 4d
toto gacor
slot toto
bacan4d
bacansport
bacansport
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
slot gacor
slot77 gacor
Bacan4d Login
Bacan4d toto
Bacan4d
Bacansports
bacansports
slot toto
Slot Dana
situs toto
bacansports
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d
bacan4d