ফাঁদ মামলার রায়ে হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ: হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির পেছনে না ছুটে অতি নগণ্যের পেছনে দুদক
হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির পেছনে না ছুটে অতি নগণ্য সাধারণ দুর্নীতির পেছনে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ছুটছে বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছে হাইকোর্ট। আদালত বলেছে, ‘দুদক শত শত হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে শ্রম, মেধা ও অর্থ ব্যয় না করে ৫ হাজার/১০ হাজার টাকার অতি নগণ্য সাধারণ দুর্নীতির পিছনে জনগণের লাখ লাখ টাকা ব্যয় করছে যা প্রতীয়মান। ৫ হাজার টাকার দুর্নীতির মামলা পরিচালনার জন্য দুদক ৫ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা খরচ করে মর্মে জানা যায়। জনগণের কষ্টের টাকার এমন অপব্যবহার কতটুকু সমীচীন?’
‘মো. কামরুজ্জামান সরকার ও অন্যান্য বনাম রাষ্ট্র ও অন্য’ মামলার পূর্ণাঙ্গ রায়ে বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ এ পর্যবেক্ষণ দেয়। গতকাল বুধবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে এ রায় প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদকে ১৫ দফা পরামর্শ দিয়ে এ সংক্রান্ত আটটি আইন ও বিধিমালায় প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা দরকার বলেও অভিমত হাইকোর্টের। আদালত বলেছে, পরামর্শগুলো গুরুত্বসহকারে আমলে নিয়ে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করলে ১০ বছরের মধ্যে দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে বাংলাদেশ।
রায়ে বলা হয়, ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্স (সংশোধিত ২০২০)-এর আওতাভুক্ত ব্যক্তিগণ যদি দুর্নীতিমুক্ত হন তাহলে বাংলাদেশে কোনো ব্যক্তির পক্ষে দুর্নীতি করা সম্ভব নয়। এর আওতাভুক্ত ব্যক্তিরা দুর্নীতিমুক্ত হলে বাংলাদেশ সম্পূর্ণরূপে দুর্নীতিমুক্ত দেশ হতে বাধ্য।’
মামলার বিবরণে জানা যায়, ঢাকার দক্ষিণখানস্থ নিপ্পন সোয়েটার্সে গ্যাস মিটার সংযোগের জন্য ১৫ হাজার টাকা ঘুষ দাবি করে তিতাস গ্যাসের উপ-সহকারী প্রকৌশলী কামরুজ্জামান সরকার ও টেকনিশিয়ান আ. রহিম। মিটার সংযোগের দিন ২০০৭ সালের ১৪ জুন টাকা গ্রহণের সময় র্যাব তাদের হাতেনাতে গ্রেফতার করে। ঐদিনই দক্ষিণখান থানায় আসামিদের সোপর্দ করা হয়। প্রথমে থানার দুই জন এসআই মামলাটি তদন্ত করেন। পরে ঐ বছরের ১৬ জুন মামলাটি দুদকে পাঠানো হয়। এই মামলায় ২০২০ সালের ১১ অক্টোবর কামরুজ্জামান ও রহিমকে দণ্ডবিধির ১৬১ এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় ৫ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২৫ হাজার টাকা জরিমানা করে। রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন তারা। গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর বিশেষ জজ আদালতের রায় বাতিল করে দেয় হাইকোর্ট।
রায়ে হাইকোর্ট বলেছে, এটি একটি ফাঁদ মামলা। মামলা তদন্তের দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিশনারের অনুমোদনক্রমে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাই ফাঁদ মামলা প্রস্তুত বা পরিচালনা করতে পারবেন। কিন্তু এই মামলার সংবাদদাতা ডি এম আসাদুজ্জামান মৌখিক সংবাদের ভিত্তিতে র্যাব কর্মকর্তারা দুদক হতে কোনো প্রকার ক্ষমতা বা অনুমতি ছাড়াই ফাঁদ মামলা পরিচালনা করেন। এতে দুদক বিধিমালার ১৬ ধারা ভঙ্গ হয়েছে। সার্বিক পর্যালোচনায় আসামিদের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হলো।
হাইকোর্টের উল্লেখযোগ্য পরামর্শ
সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিগণের মধ্য থেকে দুদকের চেয়ারম্যান এবং হাইকোর্ট বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতিগণের মধ্য থেকে কমিশনের সদস্য নির্বাচন করা দরকার। দুদকের জন্য একটি স্বতন্ত্র ক্যাডার সার্ভিস গঠন করা। দুদকের অন্যান্য কর্মচারী নিয়োগের ক্ষেত্রেও পৃথক, স্বতন্ত্র এবং স্বাধীন নিয়োগ বোর্ড গঠন করা। দুদকের কর্মকর্তা এবং কর্মচারী নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার পর কমিশনে যোগদান করার সময় তাদের সম্পদের বিবরণ দাখিল করা এবং প্রতি বছর বাধ্যতামূলকভাবে সম্পত্তির হিসাব জনসমক্ষে দুর্নীতি দমন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা। দুর্নীতি সংক্রান্ত মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তিতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিশেষ জজ নিয়োগ প্রদান করা। বিশেষত প্রত্যেক জেলায় মামলার সংখ্যার অনুপাতে এক বা একাধিক বিশেষ জজ নিয়োগ দেওয়া। দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর জন্য নির্ধারিত পদসমূহে কমিশনের বাইরের কোনো কর্মকর্তাকে পদায়ন না করা। দুর্নীতি বিষয়ক প্রতিটি অনুসন্ধান এবং তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক নীতিমালা অনুসরণ করার পরামর্শ দেয় হাইকোর্ট।