Science & Tech

ফিচ রেটিংসে ফের বাংলাদেশের ঋণমান অবনমন

মাত্র ৮ মাসের মধ্যে বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদি ঋণমান আবারও অবনমন করেছে ফিচ রেটিংস। বিশ্বের অন্যতম প্রধান এই ঋণমান নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের ফরেন কারেন্সি ইস্যুয়ার ডিফল্ট রেটিং (আইডিআর) ‘বিবি মাইনাস’ থেকে ‘বি প্লাস’ করেছে। তবে দেশের অর্থনীতি সম্পর্কিত পূর্বাভাস স্থিতিশীল রেখেছে ফিচ রেটিংস।
দীর্ঘমেয়াদি ঋণমান অবনমন করা হলেও বাংলাদেশের স্বল্পমেয়াদি ঋণমান ‘বি’ অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। এ ছাড়া স্থানীয় মুদ্রায় দীর্ঘমেয়াদি আইডিআর অবনমন করে ‘বিবি মাইনাস’ থেকে ‘বি প্লাস’; স্থানীয় মুদ্রায় স্বল্পমেয়াদি আইডিআর বি-তে অপরিবর্তিত এবং দেশের সীমা বা কান্ট্রি সিলিং বিবি মাইনাস থেকে অবনমন করে বি প্লাস করা হয়েছে। একটি দেশের দীর্ঘ ও স্বল্পমেয়াদি ঋণমান নির্ধারণের ক্ষেত্রে ফিচ এই কাঠামো ব্যবহার করে। এর আগে ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা ইস্যুয়ার ডিফল্ট রেটিং (আইডিআর) স্থিতিশীল থেকে নেতিবাচক (বিবি মাইনাস) করেছিল ফিচ। অর্থাৎ ৬ মাসের মধ্যে আবারও ঋণমান অবনমন করেছে মার্কিন এ প্রতিষ্ঠানটি। বিশ্বে যে তিনটি ঋণমান নির্ধারণী প্রতিষ্ঠান একত্রে ‘বিগ থ্রি’ হিসেবে পরিচিতি, ফিচ তাদের একটি। বাকি দুটি মুডিস ও এসঅ্যান্ডপি।
ফিচ রেটিংস বলেছে, ঋণমান বি প্লাসে নামিয়ে আনা হয়েছে। কারণ, বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ দীর্ঘ মেয়াদে দুর্বল। বাংলাদেশ রিজার্ভ ক্ষয় ঠেকাতে অনেক ব্যবস্থা নিলেও এই পরিস্থিতির শিগগিরই উন্নতি ঘটতে যাচ্ছে না। তাই অর্থনীতির বহিস্থ খাতে ধাক্কা লাগলে বাংলাদেশ আরও অরক্ষিত হয়ে পড়বে।
২০২২ সাল থেকে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভের পতন ঠেকাতে বাংলাদেশ যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে, তা যথেষ্ট নয় বলে মনে করে ফিচ রেটিংস। এসব নীতির কল্যাণে অভ্যন্তরীণ বাজারের ডলার-সংকট মোকাবিলা করাও সম্ভব হয়নি। এখন যে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে, তাতে মুদ্রার বিনিময় হারের নমনীয়তা বাড়বে। তবে এই নীতির কল্যাণে যে বিদেশি মুদ্রাবাজারের সংকট মোকাবিলা করা যাবে বা রিজার্ভের উল্লেখযোগ্য উন্নতি হবে, তা পরিষ্কার নয়।
ফিচ জানাচ্ছে যে তাদের স্থিতিশীল পূর্বাভাসের অর্থ হলো, নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকবে। এটা যে কারণে সম্ভব হবে সেটা হলো, বহিস্থ অর্থায়নের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতো নির্ভরযোগ্য ঋণদাতার সঙ্গে চুক্তি, সংস্থাটির নির্দেশিত সংস্কারকাজে হাত দেওয়া ও ব্যাংকিং খাতের সমস্যা মোকাবিলায় ব্যবস্থা নেওয়া, সরকারি ঋণ সীমার মধ্যে রাখা এবং মধ্য মেয়াদে প্রবৃদ্ধির ভালো সম্ভাবনা।
বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়ার মূল কারণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে পুঁজি পাচার হওয়া। এ তথ্য উল্লেখ করে ফিচ রেটিংস আরো বলেছে, প্রবাসী আয়ের বড় একটি অংশ অনানুষ্ঠানিক পথে (হুণ্ডি) দেশে আসছে। এই পরিস্থিতিতে জানুয়ারির পর দেশের রিজার্ভ কমেছে ১৫ শতাংশ। এখন রিজার্ভ নেমে এসেছে ১৮ দশমিক ৪ বিলিয়ন ডলারে।
ফিচ আশা করছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সম্প্রতি যেসব ব্যবস্থা নিয়েছে, সে কারণে রিজার্ভ পরিস্থিতি স্থিতিশীল হবে। তবে বিদেশি মুদ্রার ব্যবস্থাপনায় নতুন যেসব পদক্ষেপের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো কীভাবে বাস্তবায়ন করা হবে এবং মুদ্রার আনুষ্ঠানিক বিনিময় হার অনানুষ্ঠানিক হারের সমান হবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য জানিয়েছে, পুরোপুরি বাজারভিত্তিক বিনিময় হার প্রবর্তনের আগে অন্তর্বতীকালীন ও সাময়িক ব্যবস্থা হিসেবে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি গ্রহণ করা হয়েছে। কিন্তু ফিচ বলছে, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মুদ্রার বিনিময় হার নমনীয় করার ক্ষেত্রে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া জটিল হবে।
বাংলাদেশ সরকারের ঋণের পরিমাণ ২০২২-২৩ অর্থবছরে জিডিপির ৩৬ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশে উঠলেও ফিচ রেটিংস বলছে, বি শ্রেণির ঋণমানে যেসব দেশ আছে, সেসব দেশের গড় সরকারি ঋণের তুলনায় বাংলাদেশের ঋণ এখনো কম। কিন্তু রাজস্ব আয়ে দুর্বলতার কারণে বাজেট বরাদ্দ বাড়ছে না। সেই সঙ্গে ঋণের উচ্চ সুদহার, ব্যাংকিং খাতে সহায়তা দেওয়া ও রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর ঋণ—এসব কারণে সরকারের রাজস্ব পরিস্থিতি ঝুঁকির মুখে পড়েছে।
এ ছাড়া বাংলাদেশ মধ্য মেয়াদে যে বিদেশি ঋণ নিয়েছে, সেগুলো মূলত দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় অংশীদারদের কাছ থেকে নেওয়া। এসব উৎস থেকে বাংলাদেশ ভবিষ্যতেও ঋণ পাবে। ফলে ডলার সংকট থাকলেও দেশের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা বিনষ্ট হবে না বলে মনে করে ফিচ। এ ছাড়া সমকক্ষ দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণও কম। বিদেশ থেকে যত ঋণ ও সহায়তা আসছে তার মাত্র ৯ দশমিক ২ শতাংশ; যেখানে বি ঋণমানভুক্ত দেশগুলোর ক্ষেত্রে গড় হচ্ছে ২০ শতাংশ।
আইএমএফের সঙ্গে ঋণ চুক্তির কারণে অন্যান্য বহুপক্ষীয় ও দ্বিপক্ষীয় উৎসগুলো থেকে ঋণ পাওয়া অব্যাহত আছে। এটি ইতিবাচক বলে মনে করছে ফিচ রেটিংস।
ঋণের দিক থেকে ভালো অবস্থানে থাকলেও রাজস্ব আয়ে পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। এটাকে দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের রাজস্ব দুর্বলতা হিসেবে আখ্যা দিয়েছে ফিচ রেটিংস। এখন বাংলাদেশের রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত ৮ দশমিক ২ শতাংশ, যদিও বি ঋণমানভুক্ত দেশগুলোর গড় রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত হচ্ছে ১৯ দশমিক ৫ শতাংশ। আইএমএফের পরামর্শে কর ব্যবস্থায় কিছু সংস্কার করা হচ্ছে। এতে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে।
গত এক বছরে বিশ্বের তিনটি প্রধান ঋণমান নির্ণয়কারী সংস্থা যেমন মুডিস, স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওরস (এসঅ্যান্ডপি) ও ফিচ বাংলাদেশের ঋণমানের অবনমন করেছে। অর্থাৎ এই অবনমনে বাংলাদেশের অর্থনীতি দুর্বল চিত্র উঠে এসেছে।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button