Bangladesh

ফিল্মের গল্পকেও হার মানায়

অন্ধকার জেলখানা। কনডেম সেল। সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার নাটকীয় কৌশল। বালতির হাতল একমাত্র অস্ত্র। ঘরের দুর্বল ছাদ টার্গেট। ফুটো করার মহাপরিকল্পনা মাথায় আঁটে চার ফাঁসির কয়েদি দীর্ঘ এক মাসের চেষ্টা। সফলতাও আসে। নিজেদের ফুটো করা ছাদে বেরিয়ে আসে দুনিয়ার আলোয়। বিছানার চাদর, ব্যবহৃত পোশাক রশিতে রূপান্তর করে এরপর ছাদ থেকে নেমে পড়ে মাটিতে। তারপর পলায়ন।

বিজ্ঞাপন অবশ্য বেশি সময় থাকতে পারেনি আলোচিত ঘটনা সৃষ্টিকারী ওইসব কয়েদি। ১৫ মিনিটের ব্যবধানে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে আবার পুরাতন ঠিকানায় রাখা হয়। 

ঘটনা বগুড়া জেলখানায়। বুধবার ভোররাত ৩টা ৫৫ মিনিটে কারাগারের জাফলং ভবনের কনডেম সেলের চার আসামি এভাবে পালিয়ে যায় কারাগার থেকে। আসামিরা হলো- কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারী থানার আজিজুল হকের ছেলে মো. নজরুল ইসলাম মঞ্জুর (৬০), বগুড়া জেলার সদর থানার মো. ইসমাইল শেখের ছেলে মো. ফরিদ শেখ (২৮), কাহালু থানার মো. আব্দুল মান্নানের ছেলে মো. জাকারিয়া (৩১) ও নরসিংদী জেলার মাধবদী থানার ইসরাফিল খাঁর ছেলে আমির হামজা (৩৮) ।

বগুড়া জেলা পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী বলেন, ২৬ তারিখ রাত আনুমানিক ৪টার দিকে বগুড়া জেলা কারাগার থেকে ৪ জন মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত কয়েদি পালিয়ে যায়। তারা বালতির হাতল লোহা বা স্টিল নির্মিত সেটি সোজা করে ছাদের অংশ ফুটো করেছে। ধারাবাহিকভাবে তারা এটি করেছে। ভবনটিতে কোনো রড ছিল না। ইট-সুরকির অনেক পুরনো ভবন। ফুটোটি তারা ধীরে ধীরে বড় করেছে। এ ছাড়া পুরনো চাদর, গামছা ও কাপড় পর্যায়ক্রমে বেঁধে ছাদ পর্যন্ত একটি রশির মতো তৈরি করে। একটি পাটাতন তৈরি করে। মূলত পাটাতনে পাড়া দিয়ে রশি বেয়ে ছাদের ফুটো দিয়ে বেরিয়ে যায়। এরপর ছাদ থেকে নেমে প্রিজন সেলের সামনে একটি উন্মুক্ত প্রাঙ্গণ আছে। সেটি লোহার খাঁচা দিয়ে বদ্ধ। সেই লোহার খাঁচার উপর দিয়ে ক্রলিং করে কারাগারের প্রাচীরের কাছে যায়। এবং একইভাবে কাপড় জোড়া দিয়ে রশি তৈরি করে প্রাচীর টপকে যায়। তারপর পাশের করতোয়া নদীর ব্রিজ দিয়ে পাশের চাষিবাজারে পৌঁছে যায়। ওই চারজনই সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে কাজটি করেছে।

পুলিশ সুপার বলেন, আসামিরা অভিনব পন্থা অবলম্বন করেছিল। তারা প্রায় এক মাস ধরে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে। এই ভবনে পাশাপাশি চারটি ফাঁসির আসামির প্রকোস্ট রয়েছে। এর একটিতে এই চারজন ছিল। প্রতিটি প্রকোস্ট আলাদা। আসামিরা ছাদের যে জায়গাটি ফুটো করার জন্য বেছে নিয়েছে সেটি বাইরে থেকে দেখা যায় না। কারারক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিতে তারা ওই কর্নারের অংশটি বেছে নিয়েছিল। ওই ঘটনায় অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমান, বগুড়া জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল ইসলাম, পুলিশ সুপার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী, র‌্যাব’র কোম্পানি কমান্ডারসহ জেলখানা পরিদর্শন করেছেন।

এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক বলেন, ইতিমধ্যে আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি এতে অতিরিক্ত জেলা ম্যজিস্ট্রেটকে প্রধান করে পুলিশ থেকে একজন, ফায়ার সার্ভিস থেকে একজন, গণপূর্তের একজন, র‌্যাব’র একজন এবং জেলখানার একজন প্রতিনিধি থাকবেন। তাদেরকে নির্দেশনা দেয়া আছে যে, কারাগারে নিরাপত্তার কোনো ঘাটতি আছে কি না। তিনি আরও বলেন- ইতিমধ্যে আমরা কারাগার পরিদর্শন করেছি। তদন্তের প্রতিবেদন পেলেই আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করবো। এছাড়াও ডিআইজ প্রিজন থেকেও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে।

অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমান পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেন- এ বিষয়ে তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে এবং তদন্ত শেষে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি আরও বলেন- কারাগারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করতে হবে। কারাগারের বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, তাদের এহেন নৈতিকতা বিবর্জিত ভূমিকার কারণে গার্ডিং স্টাফরা নিজেদের দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করতেন না। প্রতিদিন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বন্দিদের সেল তল্লাশির বিধান থাকলেও ঠিকমতো তল্লাশি করা হতো না। প্রসঙ্গত জেলখানার প্রাচীরের ভেতরে আবারো থাকে একটি প্রাচীর অর্থাৎ কনডেম সেলেরও রয়েছে একটি প্রাচীর। এছাড়া প্রতিটি কনডেম সেলে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তাকর্মী রাখা হয়। এমন নিরপত্তা বেষ্টনীর ছাদ ফুটো করে এবং সু-উচ্চ প্রাচীর টপকিয়ে পালিয়ে যাওয়ার মতো ঘটনায় কারাগারে কর্মরত কারারক্ষী কিংবা কর্মকর্তাদের কোনো সহযোগিতা আছে কিনা তা অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা প্রয়োজন।

যেভাবে ধরা পড়ে তারা: বগুড়া সদর ফাঁড়ির এসআই খোরশেদ আলম বলেন, ‘আমি ও আমার ফোর্স নির্দেশ পাওয়ার পর জেলখানা থেকে প্রায় এক কিলোমিটার উত্তরে ফতেহ আলী বাজারের পাশে করতোয়া নদীর ধারে যাই। সেখানে দেখি চারজন একসঙ্গে নদীর পাশ থেকে চেলোপাড়া চাষিবাজারে হেঁটে উঠছেন। ‘তখনই আমার সন্দেহ হয়। কারণ, আমাদের জানানো হয়েছে চারজন পালিয়েছে। এরাও তো চারজন। তখন আমি ও টিমের অন্যরা দ্রুত সেখানে গিয়ে তাদের ঘিরে ফেলি। তাদের নানা প্রশ্ন করি কিন্তু তারা কোনো সদুত্তর দিতে পারেনি। ‘তখন তাদের দেহ তল্লাশি করে জেলখানার একটি কাগজ পাই। এতে আমরা নিশ্চিত হই এরাই সেই আসামি, যারা জেল থেকে পালিয়েছে। তখন বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাই এবং তাদের সবাইকে থানায় নিয়ে আসি।’

আসামিদের পরিচয়: কারাগার থেকে পালানো চার আসামির একজন জাকারিয়া। সে কাহালু পৌরসভার মেয়র আব্দুল মান্নানের ছেলে। মান্নান কাহালু উপজেলা বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত সভাপতি। কাহালু থানার ওসি সেলিম রেজা বলেন, ২০১২ সালের ৫ই এপ্রিল কাহালুর রোস্তম চাপড় গ্রামের রফিকুল ইসলামের স্কুলপড়ুয়া ছেলে নাঈমুল ইসলাম নাঈম (১৩) হত্যাকাণ্ডের দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন জাকারিয়া।’ নাঈম হত্যা মামলার বরাতে পুলিশ জানায়, নাঈমকে আসামি জাকারিয়া ও তার সহযোগীরা মিলে অপহরণ করেন। পরে তার মুক্তিপণ বাবদ পাঁচ লাখ টাকা দাবি করা হয় পরিবারের কাছে। টাকা না পেয়ে শিশুটিকে ইটভাটায় পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় মামলার পর ২০১৭ সালের ২৫শে জানুয়ারি বগুড়ার প্রথম অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক হাফিজুর রহমান রায় ঘোষণা করেন। রায়ে জাকারিয়া ও তার সহযোগী ডালিমকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।

বাকি তিন আসামি হলেন, কুড়িগ্রাম জেলার ভূরুঙ্গামারী থানার আজিজুল হকের ছেলে মো. নজরুল ইসলাম মঞ্জুর (৬০), বগুড়া জেলার সদর থানার মো. ইসমাইল শেখের ছেলে মো. ফরিদ শেখ (২৮) ও নরসিংদী জেলার মাধবদী থানার ইসরাফিল খাঁর ছেলে আমির হামজা (৩৮)।

Show More

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Related Articles

Back to top button