ফেব্রুয়ারিতে রোজার আগেই ভোট জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা

- সিইসিকে নির্বাচন আয়োজনে চিঠি দেওয়া হবে
- নির্বাচন হবে শান্তিপূর্ণ, উৎসবমুখর ও সর্বজনীন
- এবার প্রবাসীদের ভোট দেওয়া নিশ্চিত করা হবে
- অর্থনীতিতে গতিশীলতা ফিরেছে, সংকট কেটেছে
- বিচারের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও দৃশ্যমান রাখা হচ্ছে
আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে অর্থাৎ রোজা শুরুর আগেই জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। গতকাল রাতে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে এ ঘোষণা দেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে আমি প্রধান নির্বাচন কমিশনারের কাছে চিঠি পাঠাব, যেন নির্বাচন কমিশন আগামী রমজানের আগে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন করে।’ তিনি আরো বলেন, এই নির্বাচন হবে শান্তিপূর্ণ, উৎসবমুখর ও সর্বজনীন অংশগ্রহণমূলক।
বিশেষভাবে নারী ও প্রবাসী ভোটারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। এ নির্বাচনকে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ার ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করে সবাইকে প্রস্তুতি নেওয়ার আহবান জানান প্রধান উপদেষ্টা। তিনি এটিকে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরণীয় নির্বাচন করে তোলার প্রত্যয়ও ব্যক্ত করেন। নির্বাচন আয়োজন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর অব্যাহত দাবি, চাপ ও নানা সংশয়-সন্দেহের মধ্যে গতকাল প্রধান উপদেষ্টা তা পরিষ্কার করে জানিয়ে দিলেন।
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে বলেন, ‘এবার আমাদের সর্বশেষ দায়িত্ব পালনের পালা। নির্বাচন অনুষ্ঠান। আজ এই মহান দিবসে আপনাদের সামনে এ বক্তব্য রাখার পর থেকেই আমরা আমাদের সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে প্রবেশ করব। আমরা এবার একটি নির্বাচিত সরকারের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তরের প্রক্রিয়া শুরু করব।
সুন্দরভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘আপনারা সকলেই দোয়া করবেন যেন সুন্দরভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান করে এ দেশের সকল নাগরিক একটি নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজে সফলভাবে এগিয়ে যেতে পারে। আমরা সরকারের পক্ষ থেকে এই নির্বাচন যাতে সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ এবং উৎসবমুখরভাবে সম্পন্ন করা যায় সে জন্য সকল প্রকার সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করব।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এবারের নির্বাচন যেন আনন্দ-উৎসবের দিক থেকে, শান্তি-শৃঙ্খলার দিক থেকে, ভোটার উপস্থিতির দিক থেকে, সৌহার্দ্য ও আন্তরিকতার দিক থেকে দেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকে সে জন্য সকল আয়োজন সম্পন্ন করতে আগামীকাল (আজ) থেকে আমরা মানসিক প্রস্তুতি ও প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন শুরু করব।’
প্রবাসী ভোটারদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার কথা জানিয়ে অধ্যাপক ইউনূস তাঁর ভাষণে বলেন, ‘এবার আমরা প্রবাসী ভোটারদের ভোট দেওয়ার আয়োজন নিশ্চিত করতে চাই।’
তিনি বলেন, ‘দেশের মানুষের ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়ার কারণে ১৫ বছর ধরে নাগরিকরা ভোট দিতে পারেনি।
এবারের নির্বাচনে আমরা আমাদের বকেয়া আনন্দসহ মহানন্দে ভোট দিতে চাই। এবারের নির্বাচনে জীবনে প্রথমবার ভোট দিতে যাবে এ রকম ভোটাররা নানা উৎসবের মধ্য দিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবে তাদের এই দিনটি স্মরণীয় করে রাখার জন্য। এর মধ্যে নতুন নারী ভোটার থাকবে, নতুন পুরুষ ভোটার থাকবে। এর মধ্যে এমন ভোটার থাকবে যারা ১৫ বছর আগে থেকেই ভোট দিতে পারত, কিন্তু জীবনে একবারও ভোট দিতে পারেনি। এর মধ্যে আসবে যারা ১০ বছর আগে, পাঁচ বছর আগে ভোট দিতে পারত কিন্তু পারেনি। আর আসবে ভাগ্যবান ও ভাগ্যবতীর দল যারা এই প্রথমবার ভোটার হওয়ার যোগ্যতা লাভ করল এবং সঙ্গে সঙ্গে ভোট দেওয়ার সুযোগও পেয়ে গেল।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘নির্বাচনের দিনকে আমরা ঈদের উৎসবের মতো করতে চাই। এবারের ভোটের আনন্দ থাকবে সবার মধ্যে। আপনারা সবাই বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে ভোটকেন্দ্রে যাবেন।’ তিনি বলেন, নতুন বাংলাদেশ গড়ার কাজের ভিত্তি রচনা হবে এবারের নির্বাচনে। তার জন্য প্রস্তুতি নিন।
উল্লেখ্য, গত ১৩ জুন লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের পর এক যৌথ বিবৃতিতে প্রধান উপদেষ্টার বরাতে বলা হয়েছিল, ‘সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা গেলে ২০২৬ সালের রমজান শুরু হওয়ার আগের সপ্তাহেও নির্বাচন আয়োজন করা যেতে পারে।’ তার আগে গত ৬ জুন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা বলেছিলেন, ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্থে যেকোনো দিন ভোট হতে পারে। কিন্তু এই সময় সম্পর্কে বিএনপি ও তাদের সমমনা দল এবং বাম দলগুলো আপত্তি জানায়। এরপর তারেক রহমানের সঙ্গে লন্ডনে বৈঠকের পর এই সময় পরিবর্তন হতে পারে বলে জানানো হয়। গত ৬ জুলাই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা রাজধানীর উত্তরায় শিল্পাঞ্চল পুলিশ সদর দপ্তর ও উত্তরা পূর্ব থানা পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, পাঁচ-ছয় মাস পর নির্বাচন ধরেই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী প্রস্তুতি নিচ্ছে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিন প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে আসার পর গত ৮ জুলাই সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘নির্বাচনের জন্য ফুল গিয়ারে প্রস্তুতি চলছে।’ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, আগামী ১৮ মাসের মধ্যে যাতে নির্বাচন হতে পারে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন ওই সময়ের মধ্যেই পড়ে।
প্রধান উপদেষ্টা তাঁর ভাষণে নির্বাচন ছাড়াও দেশের অর্থনীতির পুনরুদ্ধারসহ সার্বিক কার্যক্রম নিয়েও কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের পর আমরা অনেক দূর পথ অতিক্রম করে এসেছি। আমাদের জাতীয় জীবনে শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে, অর্থনীতিতে গতিশীলতা এসেছে, সংকট দূর হয়েছে। মাত্র কয়েক দিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আমরা সফলতার সঙ্গে শুল্ক আলোচনা সমাপ্ত করেছি। এর ফলে আমাদের অর্থনীতির সম্ভাবনা বহু গুণ বেড়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘যখন এক বছর আগে অন্তর্বর্তী সরকার ১৬ বছরব্যাপী একটানা ধ্বংসযজ্ঞ এবং লুটপাটে বিধ্বস্ত এক অর্থনীতির দায়িত্ব নিয়েছিলাম, তখন কারোরই মনে হচ্ছিল না এই অর্থনীতিকে আবার সহজে চালু করা যাবে। মাত্র এক বছরের মধ্যে আমরা এত দূর রাস্তা অতিক্রম করতে পারব, যা চিন্তাই করা যায়নি। অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এখন দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাওয়ার পালা। আমরা এখন অন্তর্বর্তী সরকার থেকে একটি নির্বাচিত সরকারের হাতে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব তুলে দেওয়ার দিকে অগ্রসর হচ্ছি।’
অতীতের ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের তথ্য তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘দেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত যত বড় সংঘাত, সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে, তার সব কটির নেপথ্যে কারণ ছিল ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচন। ত্রুটিপূর্ণ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কোনো দল যদি গায়ের জোরে নির্বাচিত হয়ে ক্ষমতায় আসে তার চূড়ান্ত পরিণতি কী তা জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের দেখিয়ে দিয়েছে। আমরা ইতিহাসের কলঙ্কিত কোনো অধ্যায়ের পুনরাবৃত্তি আর করতে চাই না।’
একটা গোষ্ঠী নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘তারা দেশের গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে ব্যাহত করতে দেশের বাহিরে বসে এবং ভেতরে থেকে নানা অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। আমাদের অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে, তারা যেন নির্বাচনকে সংঘাতময় করে তোলার কোনো রকমের সুযোগ না পায়। মাথায় রাখবেন, পরাজিত শক্তি নির্বাচনের আগ পর্যন্ত বারবার মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করবে। কিন্তু একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন সফলভাবে আয়োজন করা গেলে অপশক্তির পরাজয় চূড়ান্ত হবে।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘নির্বাচনসংক্রান্ত বিষয়ে প্রতিনিয়ত পরামর্শ নেওয়ার জন্য আমরা প্রযুক্তির সাহায্য নেব। এ জন্য একটি অ্যাপ তৈরির উদ্যোগ নিচ্ছি। দ্রুত এই অ্যাপটি চালু হবে। আপনারা আপনাদের সকল পরামর্শ, সকল মতামত, সকল আশঙ্কা এবং উদ্যোগের কথা এই অ্যাপের মাধ্যমে আমাদের জানাবেন।’
রাজনৈতিক দলগুলোকে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আমার আহবান থাকবে আপনাদের নির্বাচনী ইশতেহারে, আপনাদের প্রতিশ্রুতি-প্রতিজ্ঞা-পরিকল্পনা কোনো কিছুতেই যেন তরুণরা বাদ না পড়ে। নারীরা বাদ না পড়ে। মনে রাখবেন, যে তরুণ-তরুণীরা বাংলাদেশকে বদলে দিয়েছে তারা বিশ্বকেও বদলে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে। আপনার দল থেকে তাদের সেই সুযোগ দেওয়ার উদ্যোগ নিন। আগামী নির্বাচনে সবাই নিরাপদে যার যার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দেবে এটা নিয়ে কারো কোনো আপত্তির সুযোগ রাখা যাবে না। আমরা সবাই সবার পছন্দের প্রতি সম্মান দেখাব—এটাই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা।’
জুলাই সনদের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমরা দায়িত্ব গ্রহণের চার মাসের মাথায় জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে দেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করব। তবে নির্বাচনের আগে আমাদের অত্যাবশ্যকীয় কয়েকটি কাজ সম্পন্ন করতে হবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো জুলাই ঘোষণাপত্র ও জুলাই সনদ।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘আমাদের তিনটি দায়িত্ব ছিল সংস্কার, বিচার ও নির্বাচন। জুলাই অভ্যুত্থানের ছাত্র-শ্রমিক-জনতা দেয়ালে দেয়ালে যে প্রত্যাশার কথা লিখে রেখেছিল, তার অন্যতম ফোকাস ছিল রাষ্ট্রব্যবস্থার গণতান্ত্রিক সংস্কার। সেই লক্ষ্যে আমরা বেশ কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করেছিলাম। তাদের মধ্যে প্রধান প্রধান সংস্কার কমিশনগুলো যে সুপারিশ পেশ করেছে সেগুলোর মধ্যে স্বল্প সময়ের মধ্যে আশু বাস্তবায়নযোগ্য বহু সংস্কার আমরা এরই মধ্যে সম্পন্ন করেছি। এই সংস্কারগুলোর মাধ্যমে অর্থনৈতিক খাত, বিচারব্যবস্থা ও জনপ্রশাসনে গতিশীলতা আসবে; স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। দুর্নীতি, অনিয়ম ও হয়রানি হ্রাস পাবে।’
ঐকমত্য কমিশন গঠন ও কাজের প্রশংসা করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই কমিশনে ৩০টিরও অধিক রাজনৈতিক দল ও জোট স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে, তাদের মতামত দিয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে ঐকমত্য কমিশন ১৬৬টি সুপারিশ নিয়ে ৩০টির বেশি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে দুই মাস ধরে দলগত ও জোটগতভাবে আলোচনা করেছিল। এই প্রক্রিয়ায় যেসব বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, সেগুলো বাদ দিয়ে কমিশনের পক্ষ থেকে ১৯টি মৌলিক সংস্কারের বিষয় চিহ্নিত করা হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে ২৩ দিন ধরে আলোচনা শেষে ১৯টি বিষয়ের বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়েছে, যদিও কয়েকটি ক্ষেত্রে কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে।
তিনি বলেন, “সংস্কারের ক্ষেত্রে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে পেরেছি। ঐকমত্য কমিশনের পরিচালনায় দেশের সকল রাজনৈতিক দল মিলে দীর্ঘদিন ধরে প্রতিনিয়ত আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে ‘জুলাই সনদ’ চূড়ান্ত হওয়ার পর্যায়ে এসেছে।”
জুলাই সনদ একটি ঐতিহাসিক অর্জন উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এটা শুধু আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাসে নয়, বৃহত্তর পরিমণ্ডলের রাজনৈতিক ইতিহাসেও স্মরণীয় হয়ে থাকবে। দলিল তো স্মরণীয় হয়ে থাকবেই, এটা রচনার প্রক্রিয়াও স্মরণীয় হয়ে থাকবে।’ প্রধান উপদেষ্টা আশা প্রকাশ করেন. এই ঐকমত্যের ভিত্তিতে অচিরেই রাজনৈতিক দলগুলো জুলাই সনদে স্বাক্ষর করবে এবং এর বাস্তবায়নেও ঐকমত্যে পৌঁছবে। তিনি বলেন, জুলাই সনদ বাংলাদেশে সুষ্ঠুভাবে ক্ষমতা হসস্তান্তর, জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বাধীনতা ও সক্ষমতা, নাগরিক অধিকারের সত্যিকারের বাস্তবায়ন, রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও সামর্থ্যের ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করবে।
ভবিষ্যতের কোনো সরকারই যেন আর ফ্যাসিস্ট হয়ে উঠতে না পারে—এমন আশা প্রকাশ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘রাষ্ট্রকে এমনভাবে মেরামত করতে হবে, যাতে কখনো কোথাও ফ্যাসিবাদের লক্ষণ পাওয়া গেলেই সেটিকে যেন তাৎক্ষণিকভাবে সেখানেই নির্মূল করা যায়। আর যেন ১৬ বছরের জন্য অপেক্ষা করতে না হয়। বহু মানুষকে প্রাণ দিতে না হয়। আমাদের যেন আরেকটি গণ-অভ্যুত্থানের প্রয়োজন না হয়।’
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জুলাই-আগস্টের মানবতাবিরোধী অপরাধ মামলায় বিচারকাজ দৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলছে। বিচারের আনুষ্ঠানিক শুনানি পর্বও শুরু হয়েছে। ইতিহাসের নির্মম হত্যাযজ্ঞে যারা জড়িত তাদের বিচার এ দেশের মাটিতে হবেই। বিচারপ্রক্রিয়া ও এর ফলাফল ক্রমান্বয়ে মানুষের কাছে প্রকাশিত হতে থাকবে। বিচারের পুরো প্রক্রিয়া দেশবাসীর কাছে স্বচ্ছ ও দৃশ্যমান রাখা হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা জানান, সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় কার্যকর পদক্ষেপ নেয়, যার ফলে নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে থাকে। খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১৪ শতাংশ থেকে অর্ধেকে নেমে এসেছে এবং জুনে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি ৮.৪৮ শতাংশে পৌঁছায়, যা ৩৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। প্রবাসীদের আস্থায় রেমিট্যান্সে রেকর্ড অর্জিত হয়েছে এবং রপ্তানি আয় বেড়েছে, ফলে টাকার মান শক্তিশালী হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ায় ভিসা জটিলতা নিরসন হয়েছে। জাপানে এক লাখ কর্মী পাঠানোর প্রস্তুতি চলছে। ইতালি, কোরিয়া, সার্বিয়াসহ বহু দেশে দক্ষ কর্মী পাঠানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
শিক্ষায় সংস্কার ও নিরাপত্তা বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দলীয় রাজনীতি থেকে মুক্ত রাখতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আবাসিক হলের নির্যাতন ও টর্চার সেল বন্ধ করা হয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন গ্রেড উন্নীত হয়েছে।
জুলাইযোদ্ধাদের সহায়তার প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, ৭৭৫ শহীদ পরিবারকে প্রায় ১০০ কোটি টাকা, আহত ১৩ হাজার ৮০০ জনকে ১৫৩ কোটি টাকা সহায়তা দেওয়া হয়েছে। গুরুতর আহতদের বিদেশে চিকিৎসা নিশ্চিত করা হয়েছে।
প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ভাঙাচোরা প্রশাসন, আদালত, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠনের কাজ চলছে। বিচার বিভাগীয় ও পুলিশ সংস্কার বাস্তবায়িত হয়েছে। ১৬টি পুলিশ সংস্কার সম্পন্ন, আরো ৪৩টি চলমান। ফৌজদারি কার্যবিধি সংশোধন করে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে মানবাধিকার রক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে।
গণমাধ্যম ও ডিজিটাল অধিকার হিসেবে তিনি বলেন, সাংবাদিকদের হয়রানি রোধে সাইবার নিরাপত্তা আইন সংশোধিত ও মামলা প্রত্যাহার করা হয়েছে। ইন্টারনেটকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। গুজব রোধে সাংবাদিক প্রশিক্ষণ চালু হয়েছে।